জল, জঙ্গল, জমি দখলের বিরুদ্ধে যারা সব থেকে বেশি সোচ্চার, তারাই আজ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। লিখলেন অচিন পাখিরা
এ বারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের (৫ জুন ) আহ্বান— বন্ধ্যা জমির পুনরুদ্ধার (land restoration), মরুকরণ (desertification) রোধ এবং ক্রমবর্ধমান খরার সহনশীলতা বৃদ্ধি (droughtresilience)’। এই আহ্বানের উপর ভিত্তি করে যে জাতিসঙ্ঘের স্লোগান ‘আমাদের ভূমি আমাদের ভবিষ্যৎ’।
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রকৃতি এবং সহজ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক সম্পদের দখলদারিত্ব (expropriation) নেওয়ার চেষ্টা করে, ভূমির অবৈধ দখলের সময় যে ক্ষতি হয় তা পূরণ করার কোনো দায়বদ্ধতা বুর্জোয়ারা দেখায় না এবং বিশ্বাসও করে না। ১৮৪৭ সালে ফ্রান্সে (১৮৪৩ থেকে ১৮৪৯ পর্যন্ত যখন মার্কস নির্বাসিত ছিলেন) মার্কস লিখেছিলেন তাঁর The Poverty of Philosophy কলমে, ‘‘প্রকৃত শ্রম প্রকৃতির কদর (appropriation) করে এবং পাশাপাশি মানুষের চাহিদা পূরণ করতে চেষ্টা করে। এর মধ্য দিয়ে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যেকার বিপাক ক্রিয়া (metabolism) ভারসাম্য বজায় থাকে।” মার্কসের কথায় ধনতন্ত্রের উদ্দেশ্য হল “law of ‘expropriation’ not ‘appropriation’” অর্থাৎ ভূমির কদর করা নয় বরং দখল করা।’’
উনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত জার্মান রসায়নবিদ লেবিগ (Justus von Liebig)-এর “law of replenishment”-এ মৃত্তিকার ক্ষয় পূরণ করার তত্ত্বের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন মার্কস। তখনও কৃষি ভূমির এই ক্ষতি পূরণের জন্য সারের আবিষ্কার হয়নি। কৃষি জমির উর্বরশীলতা বৃদ্ধির জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে জমে থাকা সমুদ্রের পাখিদের মল (গুয়ানো) ছিল প্রধান ভরসা। এই মলকে ‘whitegold’ বলা হতো। সেই সময়ে লেবিগ ইউরোপে কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষিভূমির উৎপাদনশীলতা হ্রাসের বিষয়টি লক্ষ্য করেন। এর অনেক পরে আমরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই সমস্ত দ্বীপের দখল নিয়ে গুয়ানোর একচ্ছত্র বাণিজ্যের ব্যবস্থা করে। পরবর্তীতে এই ব্যবস্থা ‘গুয়ানো সাম্রাজ্যবাদ’ নামে খ্যাত হয়। এর পরেই আমরা দেখতে পাব, লেবিগের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার সঙ্গে রাসায়নিক সারের আবিষ্কার, ইউরোপের কৃষি ব্যবস্থায় এক ইতিবাচক পরিবর্তন।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই ইদানীংকালে ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট পুঁজির লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আমদের দেশে মাটির নীচের কয়লা, লোহাপাথর, বনজ সম্পদ ইত্যাদির উপর। ফলে এই প্রাকৃতিক সম্পদ জল, জমি, জঙ্গল যেমন শোষণের কারণ তেমনই দূষণের উৎস। দেশের সর্বত্রই নানা রং-বেরঙের সরকার বহুজাতিকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই আদিম শোষণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কি কেন্দ্র কি রাজ্য সরকারগুলো সমস্ত পরিবেশ রক্ষা আইনগুলোকে সরলীকরণ করে চলছে প্রতিনিয়ত।
ভারতের পশ্চিম অংশে আছে বিশাল মরুভূমি। কিন্তু মরুকরণের প্রক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে অনেক রাজ্যে। সংখ্যাতথ্য জানাচ্ছে দেশের ৩২ শতাংশ জমি এখন ভুমিক্ষয়ের শিকার এবং ২৫ শতাংশ জমি মরুকরণের দিকে দ্রুত এগোচ্ছে। জমিকে বন্ধ্যাত্বর দিকে ঠেলে দেওয়ার ঘটনায় সরকার নির্বিকার। পরিবেশবিদরা ভবিষ্যতের দিকে আঙুল তুলে জানাচ্ছে গুজরাত, গোয়া এবং দিল্লি-সহ ঝাড়খণ্ড, রাজস্থানের আরও কিছু অংশ, আগামী ২০-২৫ বছরের মধ্যে অনুর্বর হয়ে যাবে। আর তারপর পরই রয়েছে পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের নাম। এ কথা মনে করলে ভুল হয়ে যাবে যে এই ক্ষয় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। ভুমিসম্পদের অপব্যবহার করে যারা মুনাফা লুটছে, তাদের আড়াল করছে নানা রঙের শাসক সরকার আর এই জল, জঙ্গল, জমি দখলের বিরুদ্ধে যারা সব থেকে বেশি সোচ্চার, তারাই আজ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।
পৃথিবী জুড়ে জল-জঙ্গল-জমি রক্ষার লড়াইয়ের খবর যাঁরা জনসমক্ষে আনার চেষ্টা করেন, সেই পরিবেশ সাংবাদিকরাও আজ আক্রান্ত সৈনিক। একই ভাবে আমাদের দেশেও, পরিবেশ রক্ষার জন্য যাঁরা সংগ্রামের খবর সংগ্রহ করেন এবং আমাদের পরিবেশন করেন তাঁরাই আজ আক্রান্ত। সম্প্রতি ইউনেস্কো (UnitedNationsEducational,ScientificandCulturalOrganization)-এর দেওয়া তথ্য থেকে পরিবেশ সাংবাদিক হত্যর ঘটনার একটি হিসাব পাওয়া যাচ্ছে।
এ ছাড়াও গুরুতর ভাবে আহত বা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা খুব কম ঘটেনি। মূলত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পরিবেশগত সমস্যা জনসমক্ষে আনার অপরাধে গত এক দশকে মোট ২০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জনকে হত্যা করা হয়েছে গত পাঁচ বছরে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়। ইউনেস্কোর দেওয়া পাঁচটি দেশের হিসাব হল এই রকমই কলম্বিয়া (২ জন), মেক্সিকো (১ জন), ফিলিপাইন (১ জন), মায়ানমার (১ জন) এবং ভারত (৪ জন)। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের সৈনিকের কোনো দেশ নেই, কোনো ধর্ম নেই বা কোনো লিঙ্গ নেই।
ভারতের চারটি হত্যার মধ্যে অধিকাংশটাই ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে। উত্তরপ্রদেশের হিন্দি-ভাষায় প্রকাশিত ‘কাম্পু মেল’ নামে এক সান্ধ্য দৈনিকের প্রতিবেদক শুভম মণি ত্রিপাঠি। ২০২০ সালের জুন মাসে তাঁকে হত্যা করার জন্য ছ’টি গুলি করা হয়েছিল— তিনটি করা হয়েছিল তাঁর মাথা লক্ষ্য করে। অপরাধ ছিল, তিনি মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে একটি ফেসবুক পোস্ট করে বলেছিলেন যে তিনি ‘বালি মাফিয়াদের’ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। এই ঘটনার এক বছর আগে শুভম এবং তাঁর ভাইয়ের একটি মোবাইল সারানোর দোকানের উপর আক্রমণ করা হয়। আসলে অবৈধ বালি উত্তোলন ছিল রাজনৈতিক মদতপুষ্ট। তিনি ভয় পাননি, বালি ও জমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরতে ছাড়েননি, ফলে তাঁর উপর আক্রমণ ছিল অবধারিত।
তার কিছুদিন আগে অর্থাৎ ২০১৫ সালে যোগেন্দ্র সিং নামে একজনকে হত্যা করা হয়। তৎকালীন এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর উদ্যোগে জমি দখল করে বেআইনি খনি থেকে খনিজ উৎপাদনের উপর কাজ করছিলেন তিনি। যোগেন্দ্রর হত্যাকে আত্মহত্যা হিসাবে চালিয়ে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য হত্যা প্রমাণিত হওয়ায় তিনজন গ্রেফতার হন।
বোর্নেওর ইন্দোনেসিয়া অংশের একজন সাংবাদিক মহম্মদ ইউসুফ Kemajuan Rakyat এবং Berantas News নামে দুটি বহুল প্রচারিত অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লাগাতার ভাবে একটি পাম চাষ কোম্পানির বিরুদ্ধে তিনি লিখতে থাকেন। এই কোম্পানিটি অরণ্য ধ্বংস করে সেই জমিতে বেআইনি ভাবে পাম চাষ করত। সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে কোম্পানিটি বনবাসীদের বঞ্চিত করে বনভূমি দখলের কাজ করত। পাম তেল কোম্পানির সন্মানহানি করা হচ্ছে এই মিথ্যা অপবাদে ইউসুফকে ২০১৮ সালে আটক করে জেলে রাখা হয়। ওখানেই তাঁর মাথার পিছনে আঘাত করে মেরে ফেলা হয়।
দক্ষিণ সুদানে একটি আন্তর্জাতিক তেল উৎপাদনকারী সংস্থা পেট্রোনাস-এর সীমাহীন জমি ও জল দূষণের ঘটনার বিরুদ্ধে Nation Media Group নামে একটি পত্রিকায় লাগাতার ভাবে লিখতেন জোসেফ অদুহা নামে একজন সাংবাদিক । তিনি ওই পত্রিকার একজন স্থায়ী সাংবাদিকও ছিলেন। সুদানের সরকার জোসেফকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক’ হিসাবে ঘোষণা করে। পরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, ব্যপক হয়রানি করা হয়। তিনি গা ঢাকা দিয়ে দেশ ছাডেন। একইভাবে আলবার্টো কাস্টানো ওবন মারিয়া লউরদেস জিমরমান হত্যার হুমকির কারণে দেশ ছাড়েন। এঁদের লড়াই ছিল ভূমির বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ।
চেন্নাইয়ের ফ্রিলান্স সাংবাদিক সন্ধ্যা রবিশঙ্কর। পরিবেশ সাংবাদিকতার জন্য ২০১৯ সালে রামনাথ গোয়েঙ্কা এক্সেলেন্স পুরস্কার পান তিনি। কর্পোরেটদের উদ্যোগে সমস্ত খনিজ সম্পদ নিংড়ে নেওয়ার পর সেই জমির বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পুনরুদ্ধার না করে বন্ধ্যাত্বের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঘটনাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসাই ছিল তাঁর মূল কাজ । তিনি বলছেন, “যখন সাংবাদিকরা এই ধরনের ঘটনা সামনে আনেন এবং এই প্রাকৃতিক সম্পদ যথেচ্ছ লুঠের বিরুদ্ধে সরকারের উপর চাপ দেন তখন শক্তিশালী কর্পোরেটদের স্বার্থে আঘাত লাগে। এ কারণেই সাংবাদিকদের উপর আঘাত আসে”।
২০১৪ সালে, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে, ঘোষণা করেছিলেন “স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের পরিবেশ ব্যতিরেকে গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না”। আরএসএফ (Reporters Without Borders) তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্ট “Hostile climate for environmental journalists”-এ বলছে যে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী আমাদের দেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২তম স্থানে।
‘আমাদের ভূমি আমাদের ভবিষ্যৎ’ স্লোগান আসলে আমাদের জল, জঙ্গল, জমি রক্ষার আন্দোলনের আর এক নাম। পরিবেশরক্ষার আন্দালনের কর্মীরা আওয়াজ তুলেছেন শুধু এ বছরের ৫ জুন নয়, প্রতিদিন আমাদের লড়াইয়ের স্লোগান হোক ‘‘জল, জঙ্গল, জমির উপর থেকে হাত হঠাও, এ লড়াই চলছে চলবে। ’’
আরও পড়ুন: শহরে অত্যধিক গরমের অনুভূতির কারণ ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’