আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সামাল দিচ্ছে পুলিশ। ছবি: রাজীব বসু
একদিকে যেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন চলছে, অন্যদিকে পুলিশের মধ্যে সম্ভাব্য অসন্তোষ সরকারকে প্রশাসনিক দিক দিয়ে বিপাকে ফেলতে পারে। লিখলেন জয়ন্ত মণ্ডল
সম্প্রতি টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলের গ্রেফতারির পর পুলিশের মধ্যে যে ক্ষোভের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তা রাজ্য সরকারের জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এই ঘটনা শুধু পুলিশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে সামনে আনেনি, বরং প্রশাসনিক স্তরে গভীর একটি সমস্যা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ইঙ্গিত বহন করছে।
আরজি কর কাণ্ড এবং পুলিশি অসন্তোষ
আরজি কর কাণ্ড নিয়ে প্রথম থেকেই কোণঠাসা পুলিশ। কলকাতা পুলিশ এবং পুলিশ কমিশনারের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহের শেষ নেই মানুষের। এরই মধ্যে ১৪ আগস্ট ‘রাত দখল’-এর রাতে আরজি করে হামলা এবং সেখানে কর্মরত পুলিশকর্মীদের আতঙ্কের কথা ছড়িয়ে পড়ে মিডিয়ায়। ওই রাতেই বাগুইআটিতে শম্পা প্রামাণিক নামে এক মহিলা পুলিশকর্মীর আক্রান্ত হওয়া এবং ২৭ আগস্ট নবান্ন অভিযানের দিন আরেক পুলিশকর্মী দেবাশিস চক্রবর্তীর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। উর্দি নিয়ে বরাবরই থাকে, এখন পুলিশের ঘরের মেয়েকে টেনে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিচ্ছে তাদেরই সামনে দাঁড়িয়ে। এরই মধ্যে টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করা হয় আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্তে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগের ভিত্তিতে। তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই দাবি করছে যে অভিজিৎ মণ্ডল বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ। কিন্তু পুলিশ বিভাগের একাংশ মনে করছে অভিজিৎ নির্দোষ এবং তিনি রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার। এই ধারণা পুলিশকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ এবং প্রতিবাদের সৃষ্টি করতে পারে।
জানা যাচ্ছে, অভিজিৎ মণ্ডলকে সমর্থন জানিয়ে কলকাতার নিচু তলার পুলিশকর্মীরা এবং প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকরা একত্রিত হচ্ছেন। সূত্রের খবর, তাঁরা সহকর্মীর আইনি লড়াইয়ের জন্য তহবিল তৈরি করার পরিকল্পনা করছেন। এই আন্দোলন শুধু কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ নয়, রাজ্য পুলিশেও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পুলিশের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সম্ভাবনা
রাজ্যের পুলিশি ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। সাধারণত, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা বা অসন্তোষ সরকারকে বিপাকে ফেলতে যথেষ্ট। কারণ পুলিশ প্রশাসনের কাজে বাধা সৃষ্টি হলে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। অভিজিৎ মণ্ডলের গ্রেফতারি নিয়ে যে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে, তা যদি বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তবে রাজ্য সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে অভিজিৎ মণ্ডলের সমর্থনে কলকাতা পুলিশকর্মীদের একত্রিত হওয়াও একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করছে। এই বার্তাটি হল, পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে ভাঙন ধরলে তা সরকারের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এখনই নিশ্চিত বলা সম্ভব না হলেও এটা স্পষ্ট যে, সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহে পুলিশের মধ্যেও গভীর ক্ষোভ বিরাজ করছে।
রাজনৈতিক পরিণতি এবং সরকারের অস্বস্তি
রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এবং আরজি কর হাসপাতালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের আন্দোলনের চাপে রয়েছে, এখন পুলিশ বিভাগের এই অস্থিরতা নতুন সংকটের জন্ম দিতে পারে। রাজ্য সরকারকে এই আন্দোলন মোকাবিলা করতে হলে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। একদিকে জুনিয়র ডাক্তার এবং একটা বড় অংশের সাধারণ মানুষের ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, অন্যদিকে পুলিশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ থামাতে হবে।
পুলিশের মধ্যে এই অসন্তোষ যদি আরও ছড়িয়ে পড়লে তা সরকারের কর্তৃত্বে আঘাত হানতে পারে। রাজ্য পুলিশের মধ্যে আন্দোলন শুরু হলে তা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে। এর ফলে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ওপর বিরোধী দলগুলোর আক্রমণের ঝাঁঝ আরও বাড়তে পারে।
বিরোধী দলগুলি, বিশেষত সিপিএম এবং বিজেপি—ইতিমধ্যেই তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে নানা ইস্যুতে আক্রমণ শানাচ্ছে। আরজি কর হাসপাতালের ঘটনার পরে পুলিশের মধ্যে এই অসন্তোষ বিরোধীদের হাতে আরও একটি শক্তিশালী অস্ত্র তুলে দেবে। তারা সহজেই দাবি করতে পারবে যে, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং সরকার প্রশাসনিক স্তরে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
শোনা যাচ্ছে, অভিজিতের হয়ে সমাজ মাধ্যমে প্রচার চালানোর জন্য একটি ডেডিকেটেড টিম গঠনের কথাও ভাবা হচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিকদের টেলিভিশন শো-তে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যাঁরা অভিজিৎ মণ্ডলের পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করবেন। এর মাধ্যমে পুলিশ বাহিনী তাদের নির্দিষ্ট সদস্যের প্রতি যে সংহতি দেখাচ্ছে, তা সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়াবে। পুলিশ বিভাগে এই ধরনের একত্রীকরণ প্রশাসনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ এ ভাবে কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত পুলিশদের মধ্যে একটি বিপজ্জনক মনোভাব তৈরি হলে সরকারের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা
রাজনৈতিক ভাবে, তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য এটি একটি গভীর সংকটের মুহূর্ত। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে, সরকার নিজের প্রশাসনিক শিথিলতার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এর ফলে বিরোধী দলগুলো সহজেই রাজ্যের শাসক দলকে দুর্বল প্রমাণ করতে সক্ষম হবে।
পুলিশ বিভাগে এই ধরনের বিশৃঙ্খলা তৃণমূল সরকারের ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করতে পারে। পুলিশের এই অস্থিরতা যদি বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা রাজ্যের শাসক দলকে রাজনৈতিক ভাবে আরও দুশ্চিন্তায় ফেলতে পারে। পুলিশের নিচু তলার কর্মীদের মধ্যে এই অসন্তোষ যদি আরও বাড়তে থাকে এবং তা যদি আন্দোলনের রূপ নেয়, তবে তা সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতার ওপর গভীর আঘাত হানতে পারে।
রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এবং আরজি কর হাসপাতালের ঘটনার চাপে রয়েছে। পুলিশের মধ্যে নতুন করে এই অস্থিরতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য এটি এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংকটের মুহূর্ত। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে সরকারকে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায়, বিরোধী দলগুলো এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে তৃণমূল সরকারকে রাজনৈতিক ভাবে বিপাকে ফেলতে সক্ষম হবে।