পুলিশের প্রতি আস্থা ক্ষীণ, তীব্র হচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ। আরজি কর ঘটনার প্রেক্ষাপটে পুলিশের ভূমিকা ও সাধারণ মানুষের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলেন জয়ন্ত মণ্ডল
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জনমানসে দীর্ঘদিন ধরেই নানা প্রশ্ন উঠেছে, তবে সাম্প্রতিক আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঘটনা সেই বিতর্ককে আরও গভীর করে তুলেছে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে এই ঘটনা, যেখানে পুলিশের নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ তৈরি হয়েছে। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ভরসা যেভাবে ক্ষীণ হচ্ছে, তা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
পুলিশের দায়িত্ব ও শাসকের প্রতি আনুগত্য
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা পুলিশের মূল কাজ হলেও, ইতিহাসে দেখা যায় যে পুলিশ বরাবরই শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এসেছে। রাজা-মহারাজাদের সময় থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় নির্বাচিত সরকারের সময় পর্যন্ত, পুলিশ শাসক দলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পুলিশ শুধুমাত্র আইন মেনে চলা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তৈরি নয়, বরং শাসকের সুরক্ষা এবং শাসনের ক্ষমতাকে বজায় রাখার জন্যও তাদের প্রয়োগ করা হয়।
তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুলিশকে নিরপেক্ষ থাকতে হয়, কারণ তাদের কাজ মূলত জনগণের সুরক্ষায় নিবেদিত। যখন পুলিশ শাসকের পক্ষে বেশি ঝুঁকে পড়ে এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন জনগণের মনে সেই প্রতিক্রিয়া নেগেটিভ হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ মনে করে, পুলিশ তখন আর আইনরক্ষক নয়, বরং শাসকের স্বার্থরক্ষক হিসেবে কাজ করছে।
আরজি কর ঘটনা ও জনমনে প্রতিক্রিয়া
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে সাম্প্রতিক ঘটনাটি পুলিশি কার্যকলাপের উপর জনগণের প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র করেছে। চিকিৎসকদের সঙ্গে সংঘাত এবং বিক্ষোভের সময় পুলিশকে একাধিকবার জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া রক্তাক্ত পুলিশকর্মীদের ছবি, সেই সঙ্গে পুলিশের অসহায়ত্বের বার্তা, স্পষ্ট করেছে যে এই ঘটনাটি পুলিশের ভাবমূর্তির উপর এক বড় আঘাত এনেছে।
যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে তারা তাদের কর্তব্য পালন করছিল, কিন্তু জনসাধারণের মনে সৃষ্টি হওয়া শঙ্কা এবং ক্ষোভ সেই দাবিকে মানতে নারাজ। পুলিশের প্রতি মানুষের এই আস্থা হারানো নতুন কিছু নয়। অতীতেও পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং তা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে, কারণ জনগণের ক্ষোভ শুধুমাত্র পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নয়, বরং শাসকের প্রতি তাদের আনুগত্যের দিকে ঝুঁকে পড়া নিয়েও।
পুলিশের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সংকট
পুলিশের কাজ হচ্ছে আইন মেনে চলা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন পুলিশ কোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা শাসক দলের প্রতি পক্ষপাত দেখায়, তখন জনগণের আস্থা দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পুলিশকে মানুষের সেবায় কাজ করার শপথ নিতে হয়, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রায়ই রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পুলিশ শাসক দলের প্রতি আনুগত্য দেখায়। শাসক দলের প্রভাবিত হয়ে তদন্ত প্রক্রিয়া পরিচালনা করা, দোষীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য পুলিশি ব্যবস্থাকে প্রয়োগ করা হলে, জনমনে আস্থা হ্রাস পায়। আরজি কর ঘটনার পর জনগণের এই অনুভূতিই আরও তীব্র হয়েছে।
পুলিশের প্রতি ক্ষোভ নতুন নয়
কয়েক দশক আগে পুলিশবিরোধী স্লোগান ছিল, ‘পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো’। এই স্লোগান মূলত পুলিশকে দুর্নীতি ও কর্তব্যে গাফিলতি নিয়ে তিরস্কার করার উদ্দেশ্যে ছিল। কিন্তু এখন স্লোগান বদলেছে। এখন শোনা যায়, ‘পুলিশ তুমি চিন্তা করো, তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়’। এই পরিবর্তিত স্লোগানটি প্রকাশ করে যে পুলিশকেও জনতার অংশ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে মানুষ। অর্থাৎ, পুলিশের সদস্যরাও এই সমাজেরই একজন, তাদেরও পরিবার আছে, এবং তারাও সাধারণ মানুষের মতোই শঙ্কা এবং নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হতে পারে।
কিন্তু এই স্লোগানগুলি শুধুমাত্র পুলিশের দুর্দশা প্রকাশ করে না, বরং শাসকের প্রতি পুলিশের আনুগত্যের বিষয়েও একটি গভীর সন্দেহ প্রকাশ করে। শাসকের নির্দেশে কাজ করতে গিয়ে পুলিশ সাধারণ মানুষের আস্থা হারাচ্ছে এবং তাদের নিজেদের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
রাজনৈতিক পরিবর্তন ও পুলিশের অবস্থান
যে কোনও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পুলিশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখনই নতুন শাসক ক্ষমতায় আসে, তারা পুলিশকে আরও মানবিক এবং সামাজিকভাবে ন্যায়নিষ্ঠ বলে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। পুলিশ তখন পাড়ার পুজো-জলসায় যোগ দেয়, গাছ লাগায়, রক্তদান শিবির করে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কৃতী পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেয়। কিন্তু এই সামাজিক এবং মানবিক ভূমিকা অনেক সময় সাময়িক হয়। শাসক তাদের ‘ধর্মে’ ফিরে গেলে, পুলিশের ভোলও বদলে যায়।
এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষ শেষ কয়েক দশক ধরে দেখে আসছে। আরজি করের ঘটনার পর পুলিশের প্রতি মানুষের যে মনে তিক্ততা তৈরি হয়েছে, তা শুধুমাত্র শাসক দলের প্রভাবের প্রতিফলন নয়, বরং পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের বিশ্বাসের সংকটকেও তুলে ধরেছে।
আস্থা পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি স্পষ্ট করেছে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া কাজ করছে। একদিকে পুলিশ জনগণের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, অন্যদিকে শাসকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানোর অভিযোগও রয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে পুলিশের নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
পুলিশকে অবশ্যই শাসক দলের প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে জনসাধারণের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের নিরপেক্ষতা বজায় রেখে পেশাদারভাবে কাজ করতে হবে। পুলিশের পেশাদারিত্ব এবং নিরপেক্ষতা শুধুমাত্র জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনবে না, বরং সমগ্র সমাজের শান্তি এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা এখন সময়ের দাবি। যদি পুলিশ তার নিরপেক্ষতা বজায় রেখে পেশাদার ভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তবে জনমনে পুলিশ সম্পর্কে যে ক্ষীণ আস্থা অবশিষ্ট আছে, সেটাও মুছে যাবে।
বলে রাখা ভালো, আরজি করের ঘটনা শুধুমাত্র একটি উদাহরণ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে পুলিশের ভূমিকা এবং জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের সংকটকে উন্মোচন করে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠা পুলিশের দায়িত্ব। তাদের কাজ এখন শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা নয়, বরং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করাও।
আরও পড়ুন: জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে অস্বস্তিতে রাজ্য সরকার, এ বার কি সংকট ডেকে নিয়ে আসবে পুলিশ?