Home প্রবন্ধ হঠাৎ যেন বেড়ে গিয়েছে গণপিটুনি, গণধোলাইয়ের ঘটনা, এ কি নিছকই গণমস্তানি?

হঠাৎ যেন বেড়ে গিয়েছে গণপিটুনি, গণধোলাইয়ের ঘটনা, এ কি নিছকই গণমস্তানি?

0

অঞ্জন মুখোপাধ্যায়

নেহাতই সাধারণ চেহারার, সাধারণ বুদ্ধির মানুষ। জীবনে কোনো দিন কাউকে একটি থাপ্পড়ও মারেনি, নিজেও খায়নি কোনো ঘুষি বা থাপ্পড়। কিন্তু অন্ধকার সিনেমা হলে বা হাতের মোবাইলের ওই অতি ছোট্ট পর্দায় যখন সিনেমার নায়ক প্রতিশোধ নিতে একা হাতে গুণ্ডা দমন করে, এই সাধারণ মানুষটিও তখন প্রবল উত্তেজিত। কোনোদিন চড় থাপ্পড় না-মারা সে, তখন রীতিমতো ঘুষি মেরে চলেছে মনে মনে ওই পর্দায়, যেন পারলে সামনে কাউকে পেলে ও রকম মেরে দিতে পারে।

সিনেমার চিত্রনাট্য তথা শট ডিভিশন এভাবেই তৈরি করে পরিবেশ। যেখানে কখনও কোনো সাতেপাঁচে না-থাকা মানুষ মানসিক ভাবে জড়িয়ে পড়ে তুমুল মারপিটের মধ্যে। একা হাতে নিকেশ করে সবাইকে। একেই বলে চিত্রনাট্যের খেল। কিন্তু এ তো ‘রিল’-এর কথা।

রিয়ালে যা হয় তার বিপরীত। দু’রকম হতে পারে সেটা।

প্রথমত, ওই ‘কখনও চড় ঘুষি না-মারা’ সাধারণ মানুষ রিল-এ একা হাতে দশ-বিশ জনকে পিটিয়ে মেরেছিল কল্পনায়। আর রিয়ালে, সেও দশ-বিশ জন একসঙ্গে, একজনকে তুমুল মারধর করে কখনও মেরে ফেলছে, কখনও ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে দশ-বিশ জনে ওই একা একজনকে।

কয়েক দিন ধরেই হঠাৎ যেন সিরিয়াল শুরু হয়েছে, কলকাতার আশেপাশে জেলায় এবং খোদ কলকাতাতেই। গণপিটুনি। বা গণধোলাই। সঠিক বলা হবে – গণনির্যাতন।

অথবা দ্বিতীয়ত, ওই গণনির্যাতনের খবর যখন ডিজিটাল মাধ্যমে বা খবরের কাগজে পড়ছে, তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। এ সব কী হচ্ছে, এ সবের মানে কী?

চোর সন্দেহে বা অন্য কিছু অস্বাভাবিক এক গুজবের পরে এক অতি সাধারণ চেহারার সাধারণ মানুষকে দশ-বিশ জন ঘিরে ধরে নির্দয় প্রহার করে কী করে? কেন করে? গণমস্তানি? না, তা-ও তো নয়।

পড়ুন। সালিশি সভায় পালিয়ে বিয়ের শাস্তি, চোপড়ায় যুগলকে রাস্তায় ফেলে মার

চোর সন্দেহে, বা অবৈধ সম্পর্কের জেরে বা এমনিই ‘ঘুর ঘুর করছিল লোকটা’ – এমন সন্দেহে হঠাৎই গণপ্রহার ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আজ বলে নয়, চিরকালই। চাঁদে রকেট পাঠানো গর্বিত মানুষ, হঠাৎ সংবাদ মাধ্যমে দেখে, গ্রামে কোনো অসহায় বৃদ্ধ মহিলাকে (বা কমবয়সিও হতে পারে) ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এমন সব খবরে অবসাদগ্রস্ত হবেই। তখন আর রিল নয়, রিয়ালেই সে পৌঁছে যায় ওই অসহায় ভিকটিমের কাছে। কঠিন শাস্তি দিতে চায় ওই নির্দয় ও নিষ্ঠুর লোকগুলিকে। এটাই অদ্ভুত মানবচরিত্র।

হিংসাতেও ষোলোআনা, বিচারেও তাই। একই সঙ্গে মানুষ দানী, ধ্যানী, মুখর ও খুনে। সুতরাং ঠিক কী মানসিক অবস্থার প্রেক্ষিতে, একটু আগে শান্ত হয়ে বসে থাকা মানুষটা হঠাৎ খেপে ওঠে, সেটা দেখতে গেলে প্রেক্ষিত দেখাটা জরুরি। এই প্রেক্ষিত তথা পরিবেশ তৈরির বড় অস্ত্র হল গুজব।

গুজব ও তার পরিমার্জিত রূপ, মিথ্যে খবর তথা ফেক নিউজ, সাধারণ মানুষ খুব খায়। এটা শুধু সংবাদ মাধ্যম জানে তা নয়, জানে অত্যন্ত চালাক এক শ্রেণির মানুষও। তারা রাজনীতিতে কাজে লাগায় বা ধর্মীয় সংঘতের পরিবেশ তৈরিতে কাজে লাগায়।

ধর্মীয় উৎপাতে গত দশ বছরে ঠিক কত জনকে গরু ও গোস্তের জন্য হেনস্থা হতে হয়েছে বা গণপিটুনিতে প্রাণ দিতে হয়েছে, তার সংখ্যা কিছু কম নয়। ধর্মীয় গুজবের জন্য প্রথমেই বিষাক্ত করতে হয়েছে পরিবেশ। এই পরিবেশ তৈরির আগেও পরিবেশের ভিত্তি তৈরি করতে হয়। তার জন্য লাগে নিরন্তর ঘৃণার প্রচার। ‘ওদের বহুত বাড় বেড়েছে’ – এই প্রচার। সঙ্গে ‘ওরা সংখ্যায় বহুত বেড়ে গেছে’ – এই প্রচারও। এ ক্ষেত্রে মানুষের বোধবুদ্ধিও হারিয়ে যায় অদ্ভুত ভাবে। শেষ সেন্সাস হয়েছে সেই ২০১১ সালে। ফলে কার কোথায় বৃদ্ধি হ্রাস হল, তার কোনো প্রামাণ্য হিসেবও নেই।

তিন দশক আগে সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। ফেক নিউজের বাড়বাড়ন্তও ছিল না বলা বাহুল্য। তবে গুজবের শক্তি তো চিরকালীন। ফলে কন্যাকুমারি থেকে উত্তরাখণ্ড – এক দেড় ঘণ্টাতেই পৌঁছে গিয়েছিল সেই খবর বা গুজব। ‘গণেশ দুধ খাচ্ছেন’। কী অদ্ভুত ভাবে এই খবর ছড়িয়েছিল। গুজব বা ফেক নিউজ পরিবেশ তৈরির চমৎকার হাতিয়ার নিঃসন্দেহে। কিন্তু খবর শুধু শুধু ছড়িয়ে দিলেই হবে না। সেটা ‘খাবে’ কে? এর উত্তরেই লুকিয়ে আছে গণপিটুনির নির্দয় ঘটনাগুলি কেন ঘটেছে।

অরবিন্দ কেজরীওয়াল প্রায়ই বলে থাকেন এই উত্তরটি। ‘দেশের সব মানুষের শিক্ষার ব্যবস্থা করুন, সবাই শিক্ষিত হলে, দেশ থেকে দারিদ্র্য চলে যাবে’। দারিদ্র্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক এই চারধারে ঘটে চলা গণপিটুনির কোনো সম্পর্ক আছে কি? তা আছে বই-কি। এই গণমানসিক বৈকল্যের কোনো সরল উত্তর হয় না। কিন্তু মানুষের নিজস্ব হতাশার, অপ্রাপ্তির দিন যাপনের পর মনের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকে চাপা হিংসা। থাকবেই, মানুষ তো, পশু তো নয়। এই হিংসার হঠাৎ হঠাৎ উদ্গীরণ হয় এক একজনের চরিত্র অনুযায়ী।

আসলে শিক্ষিত একটি দেশে এইসব গণপ্রহার বা ছ্যাঁচড়ামোর অবকাশ কম থাকে। (শিক্ষিত দেশগুলিতে অপরাধ হয় না? অবশ্যই হয়। তবে সে আলোচনা ভিন্ন)।

একটা সময় ছিল সাইকেল চুরির ‘সন্দেহ’। সরকারের সবুজ সাথির কল্যাণে প্রতি বছর দশ লক্ষ সাইকেল বাঙালির ঘরে ঢোকে। এখন আর সাইকেল নয়, মোবাইল চুরির ‘সন্দেহ’। সেই সঙ্গে ছেলেধরার গুজব চিরকালীন। জ্যোতি বসুর সেই অমর সংলাপ মনে পড়ে যাবে।

ঘটনা ঘটেছিল বানতলায়। তিন সম্ভ্রান্ত মহিলা সরকারি আধিকারিককে গ্রামবাসী ছেলেধরা সন্দেহে বানতলায় সম্পুর্ণ বিবস্ত্র করে খুন করেছিল। নড়ে গিয়েছিল বাংলার সভ্য সমাজ এই খবরে। আর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু নির্লিপ্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘এ রকম তো কতই হয়’!

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version