শীর্ষ গুপ্ত
দু’টো কাজেই ভগবানের স্পর্শ আছে। একটি কাজে পরিষ্কার জানা যায়, কীসের পরশ। সেটি ছিল হাতের পরশ। আর একটি কাজে কিন্তু পরিষ্কার জানা যাচ্ছে না, কোন অঙ্গের সাহায্যে ভগবান কাজটি সমাধা করেছেন। দু’টি কাজের মধ্যে অমিল আরও আছে। একটি কাজ একটি দেশের পক্ষে সৃষ্টি করেছে এক গৌরবময় অধ্যায়। আর একটি কাজ অত্যন্ত লজ্জার, গভীর দুঃখের, মর্মান্তিক।
প্রথম কাজটি হল দিয়েগো মারাদোনার গোল, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে। সে দিনের সেই গোলের সুবাদেই শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা সে বার বিশ্বকাপ ঘরে এনেছিল। আর দ্বিতীয় কাজটি হল কলকাতার ফ্লাইওভার ভেঙে ফেলা। এই কাজ যে ভগবানের তা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন নির্মাণকারী সংস্থা আইভিআরসিএল-এর গ্রুপ হেড (এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন) কে পান্ডুরং রাও। তিনি বলেছেন, “এটা কিছুই না, ভগবানের কাজ।” কী ভাবে পান্ডুরং জানলেন এই কাজ ভগবান ঘটিয়েছেন ? তা তাঁর বক্তব্যেই পরিষ্কার। তিনি কোনও রাখঢাক না করেই বলেছেন, “২৭ বছরে আমরা অনেক সেতু নির্মাণ করেছি। এ রকম ঘটনা তো আগে কখনও ঘটেনি।” সত্যিই তো। ২৭ বছরে যখন ওদের হাত দিয়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি, সুতরাং এত বছর পরে এই কাজ ভগবানের ছাড়া আর কার হতে পারে ? পান্ডুরং অবশ্য এটুকু জানাতে পারেননি ভগবান কী ভাবে কাজটি করেছেন। জানতে পারলে ওটুকুও নিশ্চয়ই বলে দিতেন মারাদোনার মতো, এতে ভগবানের হাত ছিল।
আর এই দেশের মানুষ কেমন দেখুন! একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে ফাঁস করে দেওয়ার দরুন কোথায় পান্ডুরংকে বাহবা দেওয়া হবে তা নয়, কেমন সব বাঁকা বাঁকা কথা ধেয়ে আসছে তাঁর দিকে। পরেশ রাওয়াল নামে বলিউডে কে এক অভিনেতা আছেন, তিনি তো বলেই বসেছেন, “হ্যাঁ, আইভিআরসিএল ঠিক বলেছে, এটা ভগবানের কাজ। ভগবানের তো আর কিছু করার নেই। ভেঙে ফেলার জন্য খালি ফ্লাইওভার খুঁজে বেড়াচ্ছেন।” কী আস্পর্ধা দেখুন, ভগবানের সঙ্গে মস্করা। এক জন সাংবাদিক আছেন, বরখা দত্ত নাম। তাঁর আবার পাণ্ডুরঙের কথা শুনে বলিউডি ফিল্ম ‘জানে ভি দো ইয়ারোঁ’-এর কথা মনে পড়ে গেছে। পাণ্ডুরঙের স্পষ্টাস্পষ্টি কথা শুনে প্রখ্যাত সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনের আবার ভগবানের জন্য দরদ উছলে উঠেছে। তিনি বলেছেন, “দুর্ভাগ্য ভগবানের। সমস্ত খারাপ জিনিসের জন্য উনিই দায়ী।” ফ্যাশন ডিজাইনার কিরণ মজুমদার শ-ও চুপ থাকতে পারেননি। বলেছেন, “লজ্জা হয় আইভিআরসিএল-এর জন্য। এত নিচু মানের ইঞ্জিনিয়ারিং।”
বিখ্যাত বিখ্যাত লোকেরা সব ময়দানে নেমে পড়েছেন, তা হলে আর চুনোপুঁটিরা কি চুপ থাকতে পারেন ? কেউ বলেছেন, “নির্মাণকারী সংস্থা এই ঘটনাকে ভগবানের কাজ বলে পার পাবে ?” কেউ আবার বলেছেন, “আইভিআরসিএল-এর কর্মকর্তা বলছেন, ভগবানের কাজ। লজ্জার কথা। চূড়ান্ত অদক্ষতা আর অবহেলা।” কারও মন্তব্য, “ভূমিকম্প, সুনামি ভগবানের কাজ হতে পারে, ফ্লাইওভার ভেঙে পড়া দুর্নীতির কাজ।” ইত্যাদি ইত্যাদি নানা মন্তব্য।
হাতের কাছেই সোশ্যাল মিডিয়া আছে, টুইটার, ফেসবুক। মন্তব্য করা থেকে কে আর আটকাচ্ছে ? কিন্তু একটা কথা কেউ ভেবে দেখছে না। দুর্ঘটনা নিয়ে তো তদন্ত-টদন্ত অনেক হবে। কিন্তু আর আগেই তো একটা বড় ক্লু দিয়ে দিয়েছেন পান্ডুরং। তদন্তের কত সুবিধা করে দিলেন ভদ্রলোক। আসল কালপ্রিটটিকে তো সহজেই ধরা যাবে। ঘটনার জন্য অপরাধী কে তা তো বলেই দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এর মধ্যে আবার গীতিকা নামে একজন টুইটারে জানতে চেয়েছেন, “বলছেন তো ভগবান করেছেন। কিন্তু কোন ভগবান ?” এইটাই একটু মুশকিল। আমাদের আবার ৩৩ কোটি দেবতা। কোন ভগবানের কাজ বা তাঁর ডেরা কোথায় সেটা যদি পান্ডুরং একটু বলে দিতেন, তা হলে আর অপরাধীকে চিহ্নিত করতে বেশি ঝামেলা পোহাতে করতে হত না। তবে বিশেষ চিন্তা নেই। একটু কাঠখড় পোড়ালেই অপরাধীকে ধরা যাবে। এ ব্যাপারে সেটুকু সহযোগিতা কি আর করবেন না পান্ডুরং ? পান্ডুরং আর তাঁর কোম্পানির কর্মকর্তাদের একটু জেরা-টেরা করলেই তো ধরা পড়ে যাবে এই বিশাল ক্রাইমের পিছনে আসল কালপ্রিট কে ? কোন ‘ভগবানের’ হাত ?
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।