প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী
জেনেছিলাম ফেসবুক থেকে। তার পর এক ফাঁকা কাজের দিনে হঠাৎ কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম। নাটক দেখি খুব কম। খোঁজ রাখি আরও কম। তবু তো ভোলার নয় সে টাটকা যৌবনবেলার স্মৃতি। মরাঠি ভাষা বুঝিনি। তবু যা দেখেছিলাম, বুকে করে রাখার মতো। সারা দেশেবিদেশে কত ভাষায় কত হাজার শো যে হয়েছে ঘাসিরাম কোতয়ালের, তার হিসেব কেই বা রাখে। আর কেনই বা রাখবে। মহাভারত কত লোক পড়েছে, তার কি হিসেব হয়!
সেই ১৯৭২ সালে পুনে শহরে প্রথম অভিনীত হয়েছিল এই নাটক। সে ছিল শিবসেনার উত্থানের কাল। সেখানে বেশ কিছু দিন নিষিদ্ধ ছিল বিজয় তেন্ডুলকরের এই চিরকালীন সৃষ্টি। মরাঠি ব্রাহ্মণ আর মরাঠি আইকন নানা ফড়নবিশকে নিয়ে বেয়াদপি কি ক্ষমতা সহজে সহ্য করে ? তার পর সে নাটক প্রায় বিশ্বজয় করেছে। অথচ বাংলায় চলে গিয়েছে সিদ্ধার্থ জমানা, চলে গিয়েছে আহা বাঙালির বড় প্রাণের বাম শাসন, এমনকি মা-মাটি-মানুষের ঝোড়ো পাঁচ সাল। তার পর এত দিনে বাংলায় প্রযোজিত হল ঘাসিরাম কোতোয়াল। ঘাসিরামের বাংলায় প্রাসঙ্গিক হতে লেগে গেল তবে অর্ধ শতক, হে নানা।
তবু তো হল। প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক পরিচালনা করলেন চেতনার সুজন মুখোপাধ্যায়। এবং মুগ্ধ করলেন। অনুবাদেও অবন্তী চক্রবর্তীর সঙ্গে সুজন ছিলেন। এই মিউজিক্যালের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ তার সুর-গান। দেবজ্যোতি মিশ্র, যাকে বলে মাতিয়ে দিয়েছেন। মঞ্চ, ব্যাকড্রপ, আলো তত বুঝি না, তাই বলছি না কিছু। তবে যেন কবিতার মতো সব কিছু। নানার কামনা, ফড়নবিশের ক্ষমতা, ব্রাহ্মণদের লাম্পট্য ও নৃশংসতা আর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ঘাসিরামের ক্ষমতার পুতুল হয়ে যাওয়া ও পথের কুকুরের মতো মৃত্যু, সব মিলেমিশে যে চিরসত্যকে সুজন মঞ্চে এনে ফেললেন, তাকে নতুন করে সমকালীন বললে নেহাৎই ক্লিশে শোনাবে।
আর অভিনয় ? টানা দু’ঘণ্টা ধরে মঞ্চে উড়ল তারুণ্যের জয়ধ্বজা। কী তার ঢেউ, কী তার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য, কী তার সমর্পণ! ঘাসিরামবেশী অধিকারী কৌশিক মনে থেকে যাবেন অনেক দিন। নানার চরিত্রে শঙ্কর চক্রবর্তী চমৎকার। তবে কিনা,হীরকরাজ উৎপল দত্তকে বাঙালি যে ভাবে ভালবেসেছে, তাতে তার শঙ্করকে ভালো না বেসে উপায়ই বা কী! আর প্রথম সূত্রধরের ভূমিকায় নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়। কী তার দাপট। এই নাটকের পোশাক পরিকল্পনাও তাঁর।
নাচ হোক বা প্যান্টোমাইম, দুই-ই আমার বোধের বাইরের জিনিস। তবু আমার মতো দর্শককেও চমৎকৃত করে দিয়েছেন সুদর্শন চক্রবর্তী। এই নাটকের নৃত্য পরিকল্পনা তাঁরই।
বাংলা নাটকে এখন অ্যাডাপ্টেশন আর গতানুগতিকতার হাওয়া। সঙ্গে নিজেকে ডিফেন্স করা তো আছেই। দেখতে দেখতে কত কিছু ঘটে গেল এ দেশে, এ বঙ্গভূমে, তবু শক্তিশালী নাটকের মানুষজন রাজনীতির আলোচনা-সমালোচনায় যতটা ক্ষুরধার, কাজের জায়গায় ততই যেন মৌলিকতার অভাব। আশ্রয় সেই রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার আর কখনও বা আধুনিক ইউরোপ। ওদের চির প্রাসঙ্গিকতার অজুহাত দিয়ে কত কিছুই তো ঢেকে দেওয়া যায়। চেতনাও তাই করল ঘুরপথে। তবু ক্ষমতা, ব্রাহ্মণ্যবাদ, হিংসা আর পুতুলনাচের ইতিকথার এ আখ্যানকে কেন যেন বড় আপন লাগে। আসলে কোনও কিছুকে জোর করে প্রাসঙ্গিক করে তোলার ব্যায়াম আর করতে ইচ্ছা হয় না, এই মেগা সিরিয়াল আর বিগ বসের রুপোলি সময়ে।
ছবি: চেতনা-র ফেসবুক পেজের সৌজন্যে
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।