কেন বিজেপির নিশানায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়?

0

রুদ্র রায়

দিলীপ ঘোষ আর রেজ্জাক মোল্লার বক্তব্যের মধ্যে ফারাক কোথায়? রেজ্জাক মোল্লা দিলীপবাবুর দল বিজেপি-র অন্যতম নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে গালি দেওয়া অর্থে ‘দ্রৌপদী’ বলেছিলেন। অর্থাৎ যাঁর একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। তিনি আরও বলেছিলেন রূপা বড় বড় সিগারেট খায়। এ কথা তিনি বলেছিলেন নির্বাচনের আগে এক সংবাদ চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়।

গত শনিবার দলের রাজ্য দফতরে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বললেন, “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা নিজেরাই বেহায়া, নিম্ন স্তরের। সব সময় ছেলেদের গায়ে পড়ে থাকে, আবার শ্লীলতাহানির অভিযোগ করে। ওরা যদি নিজেদের আত্মসম্মান নিয়ে এতই ভীত, তা হলে ওখানে যায় কেন?”

আপাত ভাবে মনে হবে দু’জনের বক্তব্যের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। কারণ, দু’জনের বক্তব্যের মধ্যেই পুরুষতান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট। সে সময় রেজাক্কের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে রূপা গঙ্গোপাধ্যায় শুধু বলেছিলেন, ‘ননসেন্স’। দলের রাজ্য সভাপতি এই মন্তব্যের পর তিনি কী বলবেন জানি না। আমার মনে হয় ‘ননসেন্স’ নিশ্চয়ই বলবেন না। কারণ, ভালো করেই জানেন যথেষ্ট ‘সেন্স’ সহকারে এই বক্তব্য রাখা হয়েছে। যেমন অন্য এক বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দিলীপ ঘোষের এই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি মেনে নিয়েছেন ‘দিলীপদা’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁর চেয়ে বেশি চেনেন। অর্থাৎ এ হল প্রতিবাদ জানিয়েও প্রকান্তরে রাজ্য সভাপতির বক্তব্যকে মেনে নেওয়া যে, সেখানে সব সময় ‘ছেলেদের গায়ে পড়ে থাকে’ মেয়েরা।

দীর্ঘ দিন বামপন্থী রাজনীতি করার পরও রেজ্জাক মোল্লা রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে যা বলেছিলেন, সে তাঁর মনের কথা। অনেক বামপন্থী পুরুষতান্ত্রিকতাকে মনে মনে সযত্নে লালিতপালিত করেন। আবার, রেজ্জাক জানেন এটা ভোটারদের অনেকেরই মনের কথাও। তাই ‘খাপে খাপ’ মিলিয়ে বিরোধী দলের উঠতি নেত্রীকে ‘হেয়’ করতে এই মন্তব্য করেছিলেন। ঠিক যে ভাবে একদা তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘কালীঘাটের ময়না’ বলেছিলেন। এটা ঠিক তাঁর রাজনৈতিক এজেন্ডা নয় বরং বলা যেতে পারে একটা কৌশল।

কিন্তু দিলীপ ঘোষ যা বললেন, সেটা একবারেই তাঁর দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা। বিজেপির একাধিক নেতা-নেত্রী ধারাবাহিক ভাবে মহিলাদের সম্পর্কে নানা ধরণের মন্তব্য করে আসছেন। এ মাসেরই গোড়ার দিকে তো বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজ প্রকাশ্যে এক যুবতীকে জিন্সের প্যান্ট খোলালেন। যাদবপুরের ছাত্রীদের সম্পর্কে দিলীপ ঘোষের মন্তব্য তারই ধারাবাহিকতা।

ভোট শেষ হয়েছে অনেক দিন। ভোটে লড়া রাজনৈতিক দলগুলির নেতা-নেত্রীরা দাঁতে নখ কাটতে কাটতে ফল প্রকাশের প্রহর গুণছেন। কিন্তু বিজেপি নিশ্চুপ নয়। তাদের লক্ষ্য সুদূর। সে লক্ষ্যেই এই রাজনৈতিক ‘গরমের ছুটি’র কালে তারা ছুটোছুটি করছে।

বাজারে জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। আরও হাজার সমস্যায় মানুষ জেরবার। সে সব নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতো তাদেরও কোনও মাথাব্যথা নেই। তাদের এজেন্ডায় যাদবপুর।

কেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়?

কারণ, যাদবপুর থেকে রাজ্যে মেরুকরণের রাজনীতির ফ্ল্যাগঅফ করা অনেক বেশি সহজ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে সেখানে ছাত্রছাত্রী অনেক বেশি সক্রিয়, প্রতিবাদী। তাই ক্রিয়া হলেই প্রতিক্রিয়া হবে। সে কারণেই ভোটপর্ব মিটে যাওয়ার পর হঠাৎ এভিবিপি-র সিনেমা দেখানো। হাতে গোনা কয়েক জন এভিবিপি সদস্য থাকলেও বাকিরা সবাই বিজেপির লোক। এমনকি গণ্ডগোলের সময় যে ভাবে বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায় দলবল নিয়ে যাদবপুর থানায় চলে এলেন তাতে পরিষ্কার যে সিনেমা দেখানোর পরিকল্পনা এভিবিপি-র অফিসে বসে হয়নি, হয়েছে বিজেপির রাজ্য সদর দফতরে বসে।

কিন্তু কোন মেরুকরণ চাইছে তারা ?

আপাতত ‘দেশপ্রেমী’ না ‘দেশদ্রোহী’। কারণ, মধ্যবিত্ত বাঙালি থেকে খেটে খাওয়া মানুষ সবার কাছে বিষয়টা নিয়ে এক লপ্তে পৌঁছে যাওয়া যাবে। গরু নিয়ে এখানে বেশি ‘লাফালাফি’ করলে খুব একটা সুবিধা হবে না। তাই ‘দেশপ্রেম’। ‘দেশপ্রেম’ থাকলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ জোরালো করা যায় এবং তার সূত্র ধরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ। তার পর তো কেল্লা ফতে! হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি। আসল মেরুকরণ। সেই মেরুকরণের উপর দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের মসনদ দখল করাই লক্ষ্য বিজেপির। ঘটনা পরম্পরাকে জুড়ে একটু তলিয়ে ভাবলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

এর আগেও দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, “যারা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়েছে তাদের উপর থেকে ছ’ ইঞ্চি কেটে ফেলা উচিত।” বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জুতোপেটা করা উচিত।

ভোটের আগে বিরোধী দলের উদ্দেশে অনুব্রত মণ্ডল, মণিরুল ইসলামরা হুমকি দেন। গণতন্ত্র শঙ্কিত হয়। সক্রিয় হয় নির্বাচন কমিশন। এফআইআর হয়, নজরদার বসে। কিন্ত দিলীপ ঘোষ যে ভাষায় কথা বলছেন তাতে তো ফ্যাসিবাদের সুর। আধুনিক ফ্যাসিবাদ। তার নজরদার কে? এর  নজরদার হতে হবে আপনাকে-আমাকেই।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

dailyhunt

খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল

বিজ্ঞাপন