জন্মজয়ন্তী
নেতাজি সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তি ছিল এক অদ্ভুত রাজনৈতিক সংমিশ্রণ

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন ‘লিডার অব দ্য লিডার্স’। তাঁর মতো প্রতিভাশালী ও নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে খুব কমই জন্মেছেন। এই নিবন্ধে তাঁর বৃহত্তর সংগ্রামের জন্য দেশত্যাগের অব্যবহিত আগে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে দেশের অভ্যন্তরে কয়েক বছরের রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে কিছু স্বল্প আলোচিত প্রসঙ্গ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সুস্নাত দাশ
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন নতুন মোড় নিয়েছিল সুভাষচন্দ্রের দেশেফেরা এবং ১৯৩৭ সালে সাময়িক কারামুক্তির পর। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সাল, এই তিন বছর কাল ভারতবর্ষের জাতীয় রাজনীতি বাম-অভিমুখী হয়েছিল এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের শীর্ষে উপনীত হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুকে কেন্দ্র করে। কার্যত নেহরুর পরিবর্তে সুভাষচন্দ্রই তখন হয়ে উঠেছিলেন ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থার অন্যতম প্রতীক। কমিউনিস্ট পার্টিও এই পর্যায়ে সম্পূর্ণতই সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ছিল এবং ১৯৩৯-১৯৪০ সালে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা সর্বদাই সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন জুগিয়েছে। লেনার্ড গর্ডন তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, পক্ষান্তরে সুভাষচন্দ্রও কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিতে উদগ্রীব ছিলেন। বসুর কংগ্রেস সভাপতিত্ব কালে সোমনাথ লাহিড়ী, বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতা তাঁর সঙ্গে নানা সময়ে সক্রিয় ভাবে কাজ করেছিলেন।
তবে সুভাষচন্দ্র বসু তাত্ত্বিক ভাবে সে অর্থে সোশ্যালিস্ট ছিলেন না। জাতীয়বাদ, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ এমনকী কিয়দংশে ফ্যাসিবাদের এক অদ্ভুত রাজনৈতিক সংমিশ্রণ সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তি ছিল। এই প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে অধ্যাপক হীরেন মুখোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ হয়তো অনেকটাই সঠিক। লক্ষ্য সাধনই তাঁর কাছে মূল বিষয় ছিল, মত-পথ-তত্ত্ব ও আদর্শ নিয়ে সুভাষচন্দ্র সে ভাবে মাথা ঘামাননি। তবে তাৎপর্যময় বিষয় হল, ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৯ সালের ওই পর্বে সমগ্র দেশের আপামর বামপন্থী সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট সকলেরই রাজনৈতিক চেতনার আইকন বা প্রতীক হয়ে ওঠেন সুভাষচন্দ্র বসু।
সুভাষচন্দ্র বসু গুজরাতের হরিপুরায় ১৯৩৮ সালের ১৯ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের ৫১তম অধিবেশনে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তা বস্তুতই ছিল দেশের বামপন্থী শক্তির মনের কথা। সভাপতির ভাষণে সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতার দাবিতে সক্রিয় প্রতিরোধের কথা তুললেন, যদিও তা হবে অহিংস। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ একটি সাময়িক পদক্ষেপ। বৃহত্তর সমস্যা হল ব্রিটিশদের ফেডারেশন চক্রান্ত এবং তা ঠেকাতে আরও বড়ো আইন অমান্য আন্দোলন করা।স্বাধীনতার পর ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো কী হবে তারও রূপরেখা দিলেন তিনি। এমনকী ভাবী স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষেধক রূপে তিনি বহুদলের কথা বললেন, গণতান্ত্রিক ভিত্তিও মেনে নিলেন, জাতীয় পরিকল্পনার ওপর জোর দিলেন এবং দেশের দারিদ্র্য দূর করতে ভূমিব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার, জমিদারি প্রথা বিলোপ, কৃষিঋণ মুকুব, গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত করতে সস্তা মূলধনের ব্যবস্থা, সমবায় প্রথার বিস্তার, বৈজ্ঞানিক কৃষির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পায়নের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ-সহ, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা স্থান পেয়েছিল।
হরিপুরা কংগ্রেসে দেওয়া সুভাষচন্দ্রের সভাপতির ভাষণ থেকে স্পষ্ট হল যে, প্রত্যক্ষ ভাবে সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রী না হয়েও সুভাষচন্দ্র বসু ক্রমশ সেই দিকেই ঘেষছিলেন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সাফল্যে তিনি যথেষ্টই অনুপ্রাণিত। অমলেশ ত্রিপাঠী সঠিক ভাবেই ব্যখ্যা করেছেন যে, ‘ইন্ডিয়ান স্ট্র্যাগেলের অপরিণত চিন্তাভাবনা ইউরোপে কয়েক বছর (১৯৩৪-৩৮) কাটানোর ফলে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। বারবার রাশিয়ার উল্লেখ, এমনকী শেষ উদ্ধৃতিতে সিপিজিবি-র উল্লেখ, ট্রেড ইউনিয়ন, কিষাণ সভা, সাম্যবাদী দলগুলির কংগ্রেসে সাময়িক যোগদানে সম্মতি, কংগ্রেস-সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন, সকল বামপন্থী শক্তিকে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে তাকে আরও গণতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী করার আহ্বান, সবই যেন একই রাগিণীর বিচিত্র বিস্তার।‘
বস্তুত জওহরলাল নেহরুর লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসে সভাপতির ভাষণের সঙ্গে (১৯৩৬) তুলনা করলে সুভাষের ভাষণকেই বেশি স্পষ্ট ভাবে বামপন্থী বলতে হবে– ‘দেশের বামপন্থী শক্তির কাছে আমার আবেদন যে তাঁরা যেন কংগ্রেসের গণতন্ত্রীকরণ এবং সাম্র্যাজ্যবাদ বিরোধী ব্যাপক মঞ্চে তাদের টেনে আনার জন্য সর্বশক্তি ও সামর্থ্য নিয়োগ করেন। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির কার্যাবলীতে আমি সত্যিই দারুণ ভাবে উৎসাহিত… …।‘
হরিপুরায কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসু সভাপতি রূপে যে ভাষণ দেন তার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিল, – ১) সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজের অগ্রগতির প্রভাবে ভারতের কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা কমিশন গঠনের প্রস্তাব, ২) কংগ্রেসেও দলকে দ্রুত পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ও আশু গণ আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিক ভাবে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী মতাদর্শে প্রস্তুত করার ডাক, ৩) অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ১৯৩৫-এর শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ও ফেডারেশনে বিরোধিতা।
ফৈজপুরে নেহরুর থেকে এ বিষয়ে হরিপুরায় সুভাষের ঘোষণা ছিল আরও স্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে নেহরু যে সময় দক্ষিণপন্থীদের মূলত গান্ধীর চাপে পিষ্ট হয়ে ভারত ছেড়ে ইউরোপকেই তাঁর রাজনৈতিক ক্ষেত্ররূপে বেছে নিতে চেয়েছিলেন সে সময় সুভাষচন্দ্র যে ভাবে সোশ্যালিস্ট ও কমিউনিস্টদের দু’পাশে রেখে দেশীয় রাজন্যবর্গের প্রজা দমননীতির বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্রের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও দ্বিধাহীন। সুভাষচন্দ্রের এই সব কার্যকলাপ দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী ঘনশ্যাম দাস বিড়লা প্রমুখের এ সব মোটেই ভালো লাগেনি। গান্ধীও বুঝতে পারছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু আর জওহরলাল এক রকম নন। এই সময় পর্বে কংগ্রেস সভাপতি রূপে সুভাষচন্দ্র বসু কমিউনিস্টদের কাছে আগের তুলনায় অনেক বেশি গ্রহণ যোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। হরিপুরা কংগ্রেসকে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী প্রভাব প্রতিষ্ঠা করার প্রধান ক্ষেত্র রূপে দেখে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা থেকে এআইসিসিতে মুজফফর আহমেদ ছাড়াও বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় এবং সহ-সম্পাদকের মধ্যে পাঁচুগোপাল ভাদুড়ি এবং কমল সরকারও মনোনীত হন।
তবে সংঘাতও কিছু ছিল। ১৯৩৮ সালের মে মাসে ‘ন্যাশনাল ফ্রন্টে’ সোমনাথ লাহিড়ী অভিযোগ করেছিলেন যে, বিপিসিসিতে কমিউনিস্ট (তখন রেড নামে পরিচিত) ও সোশ্যালিস্ট গোষ্ঠী তাদের সংখ্যানুপাতিক হারে কার্য নির্বাহী সমিতিতে স্থান পাননি। ‘ন্যাশনাল ফ্রন্টের মাধ্যমে আরও অভিযোগ করা হল যে, কমিউনিস্ট ও সোশ্যাললিস্টদের সমর্থন নিয়ে সুভাষচন্দ্র সভাপতিত্ব লাভ করলেও তিনি তাঁদের প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারেননি। হরিপুরা কংগ্রেসে উপস্থিত এবং এআইসিসি সদস্য তৎকালের তরুণ কমিউনিস্ট অধ্যাপক হীরেন্দ্র নাথমখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণকে উড়িয়ে দেওয়া যায়? হরিপুরায় দেখলাম সর্দার পটেল সুভাষচন্দ্রকে আপাতদৃষ্টিতে মর্যাদা দেখালেও দিন গুনছেন তাঁকে হঠিয়ে দেওয়ার। সুযোগের অপেক্ষায় আচার্য কৃপালনী, রাজেন্দ্র প্রসাদ, গোবিন্দ বল্লভ পন্থ প্রমুখের সুকৌশল সহায়তা নিয়ে এবং স্বকীয় সমীক্ষায় স্বভাব সিদ্ধ ধূর্ততা সহকারে মগ্ন গান্ধীজির আশীর্বাদকে পুঁজি করে।‘ কমিউনিস্টরা এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই সেই সময় বিপিসিসি-র সভাপতি সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে তাঁদের অভিমান বোধ জাগলেও তা ক্ষোভে পরিণত হয়নি।
১৯৩৮ সাল জুড়ে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে শ্রমিক কৃষক আন্দোলনকে বাদ দিলে মধ্যবিত্ত ও নগর কেন্দ্রিক যে দু’টি আন্দোলন সংগ্রামে বাংলায় বামপন্থী শক্তি সব থেকে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল সে দু’টি ছিল – ১) রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন , ২) ফেডারেশন বিরোধী আন্দোলন। বামপন্থীরা ফেডারেশনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আন্দোলন চেয়েছিলেন। কিন্তু দক্ষিণপন্থীদের কৌশলের সঙ্গে তাঁরা এঁটে উঠতে পারেননি। নীরদ সি চৌধুরির লেখা থেকে জানা যায়, ব্যক্তিগত ঝোঁকের মাথায় এই সময় সুভাষচন্দ্র সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, যে “কংগ্রেস নেতারা ‘ফেডারেশন স্কিম’ গ্রহণ করার অভিসন্ধি রাখেন।“ অগ্রজ শরৎচন্দ্র সকালে সংবাদ পত্রে পড়ে অত্যন্ত চিন্তিত হলেন, কথাটা সত্যি কিন্তু প্রমাণ নেই। এ নিয়ে গোল সত্যই ঘটল। কংগ্রেস নেতারা অত্যন্ত ক্রুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করলেন, বললেন, অপবাদ। বিতর্কটা গুরুতর হয়ে উঠতে বিলম্ব হল না।

কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সুভাষকে সব দিক থেকে কোণঠাসা করার আয়োজন দক্ষিণপন্থীরা করেছিলেন এবং বিশেষত এই ‘অপবাদের’ অভিযোগকে কেন্দ্র করেই ১৯৩৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচিত সুভাষচন্দ্রের ওয়ার্কিং কমিটি থেকে দক্ষিণপন্থী নেতারা এক যোগে পদত্যাগ করলেন। সুভাষচন্দ্রের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল একরোখা বা একবগ্গা মনো ভাব। তাই সভাপতি থাকাকালীন দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে নানা বিষয়ে তাঁর আপস হয়নি। তাঁর আশঙ্কা অমূলক ছিল না যে, স্বার্থান্বেষী জমিদার ও ক্ষমতালিপ্সু কংগ্রেস নেতৃত্ব ফেডারেশনের সুযোগে সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক ও উপনিবেশিক সংসদীয় গণতন্ত্রের ফাঁদে পা দেবেন। পূর্ণ স্বরাজের লক্ষ্য যাবে দূরে সরে। কমিউনিস্টরা অবশ্য সীমিত সামর্থ্য নিয়েই এই প্রশ্নে সুভাষচন্দ্রের পিছনে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ ও ‘নিউ এজ’ মুখপত্র সেই সময় হয়ে উঠেছিল ‘ফেডারেশন’ বিরোধিতার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। ছোটো লাট লর্ড ব্রেবোর্ন জানিয়েছিলেন, (জানুয়ারি, ১৯৩৯) যে গত নয় মাসে অন্তত ছয় হাজার সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী মিছিল বেরিয়েছে, যার পেছনে রয়েছেন বামপন্থীরা।
সুভাষচন্দ্র আলাদা ভাবে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠনের আগে পর্যন্ত সন্দেহ নেই কমিউনিস্টরাও জাতীয় আন্দোলনে বিপ্লবী শক্তির প্রতিনিধিরূপে সুভাষচন্দ্রকেই মেনে নিয়েছিলেন। হীরেন মুখোপাধ্যায়ের মতে, ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে ন্যাশনাল ফ্রন্টই (কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র) সর্বপ্রথম সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতির পদে পুনঃনির্বাচনের স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেছিল। ত্রিপুরী কংগ্রেসে সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট ও বামপন্থী অধ্যুষিত প্রদেশগুলি থেকেই সুভাষচন্দ্র অধিক ভোট পেয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালের ২৫ জানুয়ারি কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতারা ত্রিপুরী কংগ্রেসে সমর্থন জানিয়েছিলেন পট্টভি সীতারামাইয়া কে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরা ত্রিপুরী কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রকে অসহায় ও অসুস্থ অবস্থায় পরিত্যাগ করেননি। কমিউনিস্টরা ‘পন্থ প্রস্তাবের’ বিপক্ষে ভোট দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন তা তাঁদের পূর্বঘোষিত নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পিসি যোশির তরফে বিবৃতি দেওয়া হয় –‘ভারতীয় কমিউনিস্টরাই প্রথম রাষ্ট্রপতি বসুর পুনঃ নির্বাচন দাবি জানিয়ে ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি বসু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন বলিয়া আমরা আনন্দিত……আমাদের জয় সুনিশ্চিত…’।
নেহরু সুভাষচন্দ্রকে সভাপতি পদের প্রার্থী হতে বারণ করেছিলেন। কমিউনিস্টরা বুঝেছিলেন যে, বাম ঐক্যে যে ভাঙন তৈরি হয়েছে তাতে মধ্যপন্থাগ্রহণ ছাড়া কংগ্রেসের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী। সেই মধ্যপন্থা বা অফসরফায় সুভাষচন্দ্রের আপত্তি ছিল। কমিউনিস্টপার্টি ‘পন্থ প্রস্তাব’-এর বিরুদ্ধে সংশোধনী আনে ‘জাতীয় দাবি সমূহ’ বা ‘ন্যাশনাল ডিমান্ড’ প্রস্তাব উত্থাপন করে। কমিউনিস্টদের উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাব পরাজিত হয়। ‘পন্থ প্রস্তাব’ বিপুল ভোটাধিক্যে ত্রিপুরীতে গৃহীত হয়। তথাপি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষিত এই ‘প্ল্যান অব অ্যাকশন’ ছিল জাতীয় কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রায় বৈপ্লবিক।

ত্রিপুরী কংগ্রেসে যে ‘প্ল্যান অব ওয়ার্ক’ কমিনিস্টরা রেখেছিল পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লকের যে কর্মসূচি প্রনয়ণ করেন্তা ছিল এরই প্রতিলিপি। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে হরিপুরা থেকে ত্রিপুরী কংগ্রেসের মধ্যবর্তী পর্যায়ে সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে কমিউনিস্টদের আদর্শগত সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। কমিউনিজমের প্রতি আগ্রহ এবং কমিউনিস্টদের প্রতি আস্থা১৯৩৮ সালে সুভাষের মধ্যে দেখা যায়, এমনকী শ্রেণি সংগ্রামের প্রতিও তাঁর আগ্রহ বাড়ে। জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে ভারতীয় কমিউনিস্টদের পূর্বেকার বিচ্ছেদের সমালোচনা করলেও তাঁদের পর্বর্তীকালের ‘ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট’ এবং পরে ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ – এর তত্ত্ব সুভাষচন্দ্রের কাছে অনেক গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ত্রিপুরীর পর থেকে কমিউনিস্টরা সুভাষচন্দ্রের সঙ্গেই মোটামুটি ভাবে ‘লেফট কনসোলিডেশনে’ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। গোপাল হালদার প্রমুখ কয়েক জন কমিউনিস্ট সুভাষের ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকার পরিচালনাতেও নিযুক্ত ছিলেন। এই সময় ন্যাশনাল ফ্রন্টেও সুভাষচন্দ্রের প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হয়। কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে ১৯৪১ সালে সুভাষের দেশত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় কমিউনিস্টরা তা৬র সঙ্গ ছাড়েননি। হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের মতো ব্যাপক ভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন কমিউনিস্ট ছাত্ররাও উৎসাহ সহকারে যোগদান করেছিলেন।
পঞ্জাবের বিপ্লবী ভগৎরাম তলোয়ারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে সুভাষচন্দ্রকে নিরাপদে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ব্যবস্থায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সেই সময় সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সুভাষচন্দ্রের ঘোষিত নীতিই ছিল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রয়োজনে বৈদেশিক শক্তির সাহায্য লাভ। শুধু নাৎসি জার্মানি নয়, ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ইউরোপে থাকাকালীন তিনি বারবারই জার্মানি-ইতালি-জাপান এমনকী সোভিয়েত রাশিয়া তথা কমিন্টার্নের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। দেশের বাইরে অক্ষশক্তির কাছ থেকে সুভাষচন্দ্রের সাহায্য লাভ জাতীয় কংগ্রেস অনুমোদন করেনি। কমিউনিস্ট পার্টি ও সুভাষচন্দ্রের বিচ্ছেদের সূচনাও তখন থেকেই। হয় তো ঘটনা অন্যরকম কিছু ঘটত, যদি সুভাষ দেশেই থাকতেন ও সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী আন্দোলনকে নেতৃত্ব দান করতেন। তবে কী হতে পারত ইতিহাস তা নিয়ে কখনও ভাবে না। তবে সুভাষচন্দ্র বসুর আত্মোৎসর্গকে দল-মত নির্বিশেষে সকলেই আজ এক মহান দেশপ্রেমিকের মাতৃভূমির জন্য পালিত কর্তব্য বলেই বিবেচনা করে ও শ্রদ্ধা জানায়।
জন্মজয়ন্তী
নেতাজির অনুগামী ছিলেন গুমনামি বাবা: রিপোর্ট

ওয়েবডেস্ক: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান নিয়ে একাধিক অনুমান ছড়িয়ে রয়েছে। কারও মতে, তিনি ১৯৪৫ সালে জাপানের তাইহোকু বিমানবন্দরের দুর্ঘটনায় মারা যান। কেউ মনে করেন, নেতাজি রাশিয়ায় ছিলেন। আবার কারও মতে, উত্তরপ্রদেশের ‘গুমনামি বাবা’ই নেতাজি। তবে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচনে গঠিত কোনো কমিশনই গুমনামি বাবাকে নেতাজি হিসাবে মেনে নেয়নি। তবুও তা নিয়ে জড়িয়ে রয়েছে জল্পনা।
উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে (বর্তমানে অযোধ্যা) থাকতেন গুমনামি বাবা ওরফে ভগবানজি। তাঁকেই কেউ কেউ নেতাজি বলে ধারণা করেন।
২০১৬ সালে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব প্রাক্তন বিচারপতি বিষ্ণু সহায়ের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। এলাহাবাদ হাইকোর্ট গুমনামি বাবাকে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতেই সেই কমিশন গঠিত হয়।
ওই কমিশন বছর তিনেক বাদে সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেয়। বিধানসভায় রিপোর্টটি প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
কমিশনের রিপোর্টে বেশ কয়েকটি তথ্য তুলে ধরা হয়। যেগুলির মধ্যে অন্যতম কয়েকটি-
১. গুমনামি বাবা একজন বাঙালি। তিনি বাংলা, ইংরাজি এবং হিন্দি জানতেন।
২. তিনি ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী।
৩. গুমনামি বাবার রামভবন থেকে বাংলা, ইংরাজি এবং হিন্দিতে লেখা একাধিক বই উদ্ধার করা হয়।
৪. যুদ্ধ, রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনা প্রসঙ্গে অগাধ জ্ঞান ছিল গুমনামি বাবার।
৫. কারও মতে, গুমনামি বাবার কণ্ঠস্বর অনেকটাই নেতাজির মতোই।
৬. গুমনামি বাবার অসীম ধৈর্য্য ক্ষমতা ছিল।
৭. অযোধ্যায় তিনি প্রায় ১০ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন।
৮. আধ্যাত্মিকতা এবং যোগের মধ্যেই সময় কাটাতেন গুমনামি বাবা।
৯. গান শোনা, সিগার এবং খাওয়া ছিল তাঁর পছন্দের।
১০. গুমনামি বাবা নিজে নেতাজির অনুগামী ছিলেন, কিন্তু তাঁকে নিয়ে খবর ছড়িয়ে পড়তেই তিনি নিজের বাসস্থান পরিবর্তন করে নেন।
সহায় কমিশন রিপোর্টের সমাপ্তিতে বলা হয়েছে, গুমনামি বাবা একজন মেধাবী মানুষ এবং তাঁর মতো মানুষ খুবই বিরল, যাঁরা নিজের পরিচয়ের গোপনীয়তা প্রকাশের পরিবর্তে মৃত্যু পছন্দ করেন। তবে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটি এমন ভাবে আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে শুধুমাত্র ১৩ জন নিয়েছিল। গুমনামি বাবার পরিচয় এখনও অচিহ্নিত।
এ কথা বলেছে খোদ বিষ্ণু সহায় কমিশনের রিপোর্ট। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সুস্নাত দাশ বলেন, “নেতাজি একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব। কোনো মাপকাঠিতেই তাঁকে মাপা সম্ভব নয়। ফলে তাঁর মতো বিরল ব্যক্তিত্বকে নিয়ে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে রসালো গল্প-উপন্যাস লেখা হতেই পারে”।
একই সঙ্গে তিনি বলেন, “এখনও পর্যন্ত নেতাজিকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছে, সেগুলির কোনোটাতেই বলা হয়নি, ‘গুমনামি বাবা’ই নেতাজি”!
উঃ ২৪ পরগনা
‘আইএনএ-তে যতটা অবদান নেতাজির, ততটাই শাহনওয়াজ খানের’, সিএএ বিরোধী মিছিলে উঠল আওয়াজ

বরানগর: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৩তম জন্মদিবস উদ্যাপনের পাশাপাশি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিলেন কয়েকশো মানুষ। বৃহস্পতিবার বরানগরের মল্লিক কলোনির নেতাজি মূর্তির পাদদেশ থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ডানলপ মোড়ে ভগৎ সিংয়ের মূর্তির কাছে গিয়ে শেষ হয় এই প্রতিবাদ মিছিল।
এ দিনের মিছিলে অংশ নেয় বরানগর এবং সংলগ্ন কাশীপুরের বেশ কয়েকটি সংগঠন। নো এনআরসি/সিএএ, বরানগরের উদ্যোগে আয়োজিত মিছিলটি বনহুগলি, আলমবাজার, অশোকগড়-সহ বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে। মিছিল থেকে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী বিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠলেও ছিল না কোনো রাজনৈতিক পতাকা। মূলত ভারতের জাতীয় পতাকা হাতেই মিছিলে অংশ নেন প্রতিবাদকারীরা।
বিশ্বজিত হাজরা নামে এক প্রতিবাদকারী বলেন, “আজকের দিনটা বিশেষ একটা দিন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। তিনি ভারতের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। ঠিক একই ভাবে শাহনওয়াজ খান, লক্ষ্মী সায়গলরাও স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন”।
[ আরও পড়ুন: প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে গেরুয়া শিবিরকে আটকানোর কথা বলেছিলেন নেতাজি ]
বিশ্বজিতবাবুর কথায়, “ভারতের স্বাধীনতার জন্য নেতাজি আজাদহিন্দ বাহিনী (আইএনএ) গঠন করেছিলেন। ওই লড়াইয়ে নেতাজির অবদান যতটা, শাহনওয়াজ খান, লক্ষ্মী সায়গলের অবদানও কম নয়। আবার ভগৎ সিং-সহ অন্যান্য স্বাধীনতাকেও কেউ খাটো করতে পারবে না। এই দেশ সবার”।
জন্মজয়ন্তী
নেতাজির জন্মদিনে নাম না করে মোদীকে বিঁধলেন মমতা!

ওয়েবডেস্ক: হিন্দু মহাসভার বিভেদের রাজনীতির বিরোধিতা করে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ঐক্যবদ্ধ ভারতের জন্য লড়াই করেছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজির জন্মদিনে অংশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এহেন মন্তব্য করার পাশাপাশি নাম না করে বিঁধলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও।
মমতা বলেন, “নেতাজি তাঁর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সমস্ত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার বার্তা দিয়েছিলেন। তাঁর ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠনের লড়াইকে আজকের দিনে শ্রদ্ধা জানাই। একই সঙ্গে তিনি ২৩ জানুয়ারি দিনটিকে জাতীয় ছুটি ঘোষণার দাবি জানান”।
তিনি বলেন, “নেতাজি হিন্দু মহাসভার বিভেদের রাজনীতির বিরোধিতা বরাবর করে গিয়েছেন। তিনি এক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের হয়ে লড়াই করেছিলেন। আর এখন যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থন করেন, তাঁদের দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচনে কেন্দ্রের অনীহা রয়েছে বলে অভিযোগ করেন মমতা”।
[ আরও পড়ুন: প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে গেরুয়া শিবিরকে আটকানোর কথা বলেছিলেন নেতাজি ]
এ দিন তিনি নাম না করেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি কটাক্ষ ছুড়ে দেন। বলেন, “যিনি সবাইকে নিয়ে চলেন, তিনিই নেতাজি। কিন্তু এখন সেটা নিয়েই গা-জোয়ারি চলছে”।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার মমতা দার্জিলিংয়ে নেতাজির ১২৩তম জন্মদিবস উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
-
রাজ্য1 day ago
পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করল তৃণমূল
-
শিক্ষা ও কেরিয়ার3 days ago
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ মামলায় নয়া মোড়, ফের কলকাতা হাইকোর্টে রাজ্য
-
গাড়ি ও বাইক1 day ago
আরটিও অফিসে আর যেতে হবে না! চালু হল আধার ভিত্তিক যোগাযোগহীন পরিষেবা
-
ভ্রমণের খবর2 days ago
ব্যাপক ক্ষতির মুখে পর্যটন, রাঢ়বঙ্গে ভোট পেছোনোর আর্জি নিয়ে কমিশনের দ্বারস্থ পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন