
মোদী সরকারের শেষ বাজেটটিও প্রতিশ্রুতিতে ভরা, ভোটের দিকে তাকিয়ে তৈরি একটি রাজনৈতিক ইস্তাহারের মতো। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে একে কখনোই একটি দেশের ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট বলা যায় না।
এখানে দু’টি দিকের ওপর আমি জোর দিতে চাইছি – এক, এই বাজেটে দেশের স্বার্থ কতটা দেখা হয়েছে? আর দুই, আর্থিক ও অর্থনৈতিক হিসেবে এই বাজেট কতটা ভারসাম্যপূর্ণ।
দু’টি দিকের বিচারেই বলা যায়, এই বাজেট দেশকে পিছিয়ে দেবে।
আরও পড়ুন বাজেট ২০১৯: বরাদ্দ কমল রাজ্যের দু’টি মেট্রো প্রকল্পে
প্রথমত, নির্বাচনে ভোটারের মন পেতে এই বাজেট সাজানো হয়েছে। দেশের তিন কোটি করদাতা মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের মন জয় করে ফের ক্ষমতায় ফেরাই উদ্দেশ্য। তার জন্য ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত করযোগ্য আয়ে ১২৫০০ টাকা পর্যন্ত রিবেট মিলবে। এর ওপর আরও আছে – বছরে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ছাড়ের সুযোগ ৮০সি ধারায় নির্দিষ্ট লগ্নির মাধ্যমে। স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন ১০ হাজার বাড়িয়ে ৫০ হাজার করা হল। এ সবের জন্য হিসেবমতো রাজকোষ ঘাটতি হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। তাতে কী আসে যায়, ক্ষমতায় ফেরার জন্যই তো বাজেটের প্রস্তাবনা।
এর সঙ্গে মোদী সরকারের দ্বিতীয় টার্গেট ক্ষুদ্র ও প্রান্টিক কৃষককুল। গত বছর কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কৃষকের আয় দ্বিগুণ তো হয়ইনি, বরং ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে, এমনই খরচ বেড়েছে কৃষিকাজে। অন্য দিকে আত্মহত্যাও বেড়েছে উর্ধ্ব গতিতে। কারণ দাম কমেছে ফসলের। মোদীর বহু বিজ্ঞাপিত ইলেকট্রনিক কৃষি বিপণন ব্যবস্থা কাজে লাগেনি চাষির। খেতের ফসল খেতেই পচেছে দামের অভাবে। তাদের জন্য দরকার ছিল কৃষির খরচ কমানো এবং কৃষিজ ফসলের বিপণনে বরাদ্দ বৃদ্ধি।
সে দিকে না হেঁটে, প্রকৃত অর্থে কৃষকের উপকারে বরাদ্দ না করে, মন খুশি করতে মাসে মাসে ৫০০ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন নতুন অন্তর্বর্তী অর্থমন্ত্রী। তার মানে, দিনে ১৭ টাকা। কৃষকের গোটা পরিবারের জন্য। তাও, প্রতি মাসে নয়, চার মাস অন্তর।
আরও পড়ুন গয়ালের বাজেটে গরু-গোয়ালের কী হল? একলা মোদী চাপড়ালেন টেবিল
এমন একটি বাজেটে এই প্রস্তাব দেওয়া হল, যার প্রস্তাব চার মাস পর কার্যকর হবে কিনা তা কেউ জানে না। নতুন সরকার এসে যাবে মে মাসে। জুন-জুলাইয়ে নতুন বাজেট। তার মধ্যে এই প্রস্তাব কার্যকর হতে হতে ১ এপ্রিল। তার মানে দু’ মাসের সময়ের ব্যবধানে এই প্রস্তাব বাস্তবে কতখানি কী রূপ পাবে তা মোদী সরকারই জানে। কিন্তু এর জন্য বরাদ্দ হল ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ যদি আগামী দিনগুলোতে ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ হত, গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠন ও বিকাশে খরচ হত, তা হলে সেই খরচ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারত, যা থেকে গ্রামের মানুষ ও কৃষিজীবী সম্প্রদায় উপকৃত হতে পারত।
এ বার আসি বহুচর্চিত কৃষিঋণ মকুব প্রসঙ্গে। তাতেও বলা হয়েছে, শুধুমাত্র সুদে ছাড় দেওয়া হবে ২ শতাংশ। সেখানে জমিহীন কৃষকরা বাদ।
আরও পড়ুন সম্মানের নামে কৃষককে অপমান করেছে নরেন্দ্র মোদীর বাজেট, দাবি রাহুল গান্ধীর
১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত যাদের আয় সেই সব শ্রমিকদের জন্য এই বাজেটে চমক, মাসে মাত্র ১০০ টাকা জমা দিলে পেনশন পাবে ৩০০০ টাকা প্রতি মাসে।
এ সবেই প্রমাণিত হয়, এই বাজেটে কিছু চমক সৃষ্টিকারী প্রতিশ্রুতি দেওয়াই লক্ষ্য ছিল, উদ্দেশ্য সামনের ভোটে জিতে ফেরা।
এই সব চমক দেখাতে গিয়ে বাজেটের অর্থনৈতিক দিকটি ব্রাত্য হয়েছে। ঘাটতি বাড়বে, জিডিপির ৩.৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। আর্থিক নিয়ন্ত্রণের যে রোডম্যাপ সামনে রাখা ছিল, তা থেকে সরে আসার বার্তা রয়েছে এই বাজেটে। এই বাজেট দেশের আর্থিক বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও মুদ্রাস্ফীতির সম্পর্কের ক্ষেত্রে চাপ বাড়াবে, যার নিট ফল বাজার থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া বাড়বে। তাতে ভুল বার্তা যাবে শিল্পমহলে।
আরও পড়ুন কেমন হল সাধারণ বাজেট? আলোচনায় খবর অনলাইন
বন্ডের বাজারের জন্যও এটা সুখবর নয়। শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক বার্তা আছে। যে হেতু মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের আয়করবাবদ কিছুটা সাশ্রয় হচ্ছে, সে হেতু হাতে জমে যাওয়া সঞ্চয় মিউচুয়াল ফান্ডের বাজারে বা সরাসরি শেয়ারবাজারে লগ্নি হবে।
কিন্তু সমস্যা হল, এই বাজেটে রিয়াল এস্টেট, ইস্পাত ছাড়া অন্য কোনো শিল্পের জন্য বিশেষ কোনো সুখবর নেই।
সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বাজেটকে কখনোই একটি ভালো বাজেট বলা যাবে না। উলটে বলা যায়, যে ভাবে ভোটারদের মন পেতে যে ভাবে ঘাটতি বাড়ানোর রাস্তায় হেঁটেছে মোদী সরকার, তাতে টাকার দাম কমা বা জিনিসের দাম বাড়া এবং সার্বিক ভাবে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলির কাছে ভারতের রেটিং আরও নেতিবাচক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।