ইন্দ্রাণী সেন বোস
বাঁকুড়া: “উপরে খই নীচে দই, তুই আমার চিরকালের সই” – আমৃত্যু বন্ধুত্বের শপথবাক্য। সাক্ষী মহাদেব-কন্যা মনসা ও আপামর জনগণ। উৎসবের আক্ষরিক নাম ‘সহেলা’।
বর্তমান সময়ে বদলেছে বন্ধুদের সংজ্ঞা। জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়াগুলির দৌলতে এখন এক ক্লিকেই ‘ফ্রেন্ড’, আবার সেই এক ক্লিকেই ‘আনফ্রেণ্ড’ অর্থাৎ বন্ধুবিচ্ছেদ! কিন্তু এই গতিশীল জীবনের মধ্যেও বছরের পর বছর ধরে একেবারে অন্যরকম বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন বাঁকুড়া-বর্ধমান সীমানাবর্তী দক্ষিণ দামোদর এলাকার মানুষ। প্রতি পাঁচ/ছয়/দশ/বারো বছর অন্তর বাঁকুড়ার ইন্দাস ব্লক এলাকার মানুষ যোগ দেন অভিনব ‘সয়লা’ উৎসবে। মঙ্গলবার থেকে ইন্দাস ব্লকের আকুই গ্রামে শুরু হয়েছে তিন দিনের ‘সয়লা’ উৎসব। সয়লা উপলক্ষ্যে তিন দিনব্যাপী একাধিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
আকুই গ্রামের মানুষ মঙ্গলবার থেকে শতাব্দী প্রাচীন ‘সয়লা’ উৎসবে মেতেছেন ধর্মীয় ভেদাভেদ ভূলে। ‘সহেলা’ বর্তমানে লোকমুখে ‘সয়লা’য় রূপান্তরিত হয়েছে। সম্ভবত সই বা বন্ধুত্ব স্থাপনের অনুষ্ঠান বলেই এইরকম নামকরণ বলে মনে করেন অনেকেই। কারণ এই শব্দটির মধ্যেই সখা-সই-সাঙ্গাত (বন্ধু) শব্দের উপস্থিতি রয়েছে।
‘সয়েলা’ উৎসবে আচার-অনুষ্ঠান।
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আশ্বিনের শেষ মঙ্গলবার আকুইয়ের গ্রাম্যদেবী মা মনসার ‘সয়লা’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় যদি লক্ষ্মীপুজো বা দুগ্গাপুজো বা মলমাস থাকে তবে তা পরের বছর হয়। স্থানীয় মা মনসাকে বাকুল থেকে শোভাযাত্রা সহকারে আকুই স্কুলমাঠের অস্থায়ী মন্দিরে আনা হয়। দেবীর স্থায়ী মন্দির থেকে অস্থায়ী মন্দির ৫০০ মিটার। মা মনসাকে নিয়ে এই পথ আসতে ভক্তদের সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা।
গ্রামের সব বয়সের নরনারী ‘সয়লাডালা’ দেবীকে উৎছুগ্গ (উৎসর্গ) করে তবেই আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধু পাতানোর উৎসবে মাতেন বা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। একজন পুরুষ অন্য কোনো পুরুষ এবং একমাত্র মহিলা শুধুমাত্র মহিলাদের সঙ্গেই এই ‘সয়লা’ স্থাপন করতে পারেন। তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে এখানে ধর্মের সমস্ত ভেদাভেদ ভেঙে যায়। শেখ ইমরান আলির সঙ্গে শান্তনু ভট্টাচার্যের ‘সয়লা’ স্থাপনে কোনো আপত্তি নেই। এটাই এখানকার অন্যতম প্রাচীন রীতি। বর্তমান এই অস্থির সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির হতে পারে বাঁকুড়ার ইন্দাস ব্লক এলাকার আকুই গ্রামের এই ‘সয়লা’ উৎসব।
চলছে ‘সয়েলা’ উৎসব।
‘সয়লা’র অন্যতম অঙ্গ হল ‘গোয়া চালানো’। গোয়া হল ‘সয়লা’র ঝাঁপি। এই ঝাঁপির মধ্যে থাকে দই, পঞ্চশস্য, গোটা হলুদ, সিঁদুর, খই, গোটা সুপারি, পান বাতাসা। ‘সয়লা’ শুরুর একমাস আগে থেকেই গ্রামবাসীরা স্থানীয় সমস্ত দেবদেবীর মন্দিরে যান এবং তাঁদের আমন্ত্রণ জানান। এটিও এই উৎসবের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ঢাক-ঢোল-শাঁখ বাজিয়ে প্রথমে স্থানীয় শুভচণ্ডী মন্দিরে যাওয়া হয়। পরে দামু স্বরূপনারায়ণ, সিংহবাহিনী ও অন্যান্য মন্দিরে যাওয়া হয় এবং পুরাতন বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করা হয়।
দেবদেবীর পাশাপাশি গ্রামবাসীদেরও মধ্যেও চলে ‘গোয়া চালানো’। পান, সুপারি, গোটা হলুদ আর কড়ি নিয়ে এক সই যায় তার পুরোনো সইয়ের বাড়ি। দই, তেল-হলুদ আর সিঁদুরের ফোঁটায় অক্ষুণ্ণ থাকে তাদের বন্ধুত্ব। পুরুষদের জন্য আবার অন্য নিয়ম। শোলার মালাবদল, কোলাকুলি আর মিষ্টিমুখে হয় পুর্নমিলন উৎসব। এই নিয়মটিই পালন করা হয় নতুন সই-সাঙ্গাতের ক্ষেত্রেও।
আমরাও সাঙ্গাত হলাম। সাক্ষী মা মনসা।
স্থানীয় বাসিন্দা প্রবীণ রমাপ্রসাদ সেন বলেন, “আকুই গ্রামের এই ‘সয়লা’ উৎসব কত দিনের পুরোনো তা জানা যায়নি। তবে বর্তমান ভোগসর্বস্ব সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ হতে পারে এই ‘সয়লা’। বাপ-ঠাকুরদার কাছে শুনেছি তৎকালীন জমিদার বিজয়প্রসাদ সিংহ এলাকায় উচ্চ-নীচ সম্প্রদায়ের বিভেদ ঘোচাতে এই উৎসব শুরু করেন। প্রামাণিক (তেঁতুলেবাগদি) পরিবারের যাঁরা মা মনসার সেবাইত-পুরোহিত ছিলেন তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে, গ্রামের সমস্ত মানুষের সহমতে এই উৎসব শুরু করেন। এই জন্যই এখানে ধর্মের কোনো ভেদাভেদ থাকেনা। এলাকার উচ্চ-নীচ হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের মানুষ একসঙ্গে এই উৎসবে শামিল হন। পরস্পরের মধ্যে ‘সয়লা’ স্থাপনে এখানে ধর্ম বা সম্প্রদায় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।”
আকুই সয়লা কমিটির সম্পাদক সুদীপ তা এবং সদস্য দিলীপ কুমার দাঁ, শ্যামা রক্ষিত, তুহিন দলুই, তাপস দত্তদের কথায়, “এই ‘সয়লা’ উৎসবের জন্য আমরা পাঁচ বছর অপেক্ষায় থাকি। বহু দিন আগে এটি বারো বছর অন্তর হত। পরে ছয় বছর, বর্তমানে পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাঁকুড়া জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের তরফে আমরা সাহায্য পেয়েছি। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রয়েছে যথেচ্ছ পুলিশ ও সাধারণ মানুষের সাহায্যর্থে অনুসন্ধান অফিস ও সহায়তা কেন্দ্র খোলা হয়েছে।”
মেলায় আগত দর্শনার্থীদের জন্য বিনামূল্যে পানীয় জল সরবরাহের দায়িত্ব পালন করছেন স্থানীয় দলুই পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা জানান, শুধু আকুই এলাকা নয়, আশেপাশের দশ-বারোটি গ্রামের মানুষ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হন, ‘সয়লা’ স্থাপন করে তা আমৃত্যু বহন করেন৷
ছবি: প্রতিবেদক