ওয়েবডেস্ক: সত্যি বলতে কী, যিশু খ্রিস্টর নির্দেশ দেওয়ার কথাও নয়! মৃত্যুকালে এ ধারণাও তাঁর ছিল না যে, পরবর্তীকাল ধুমধামের সঙ্গে পালন করবে তাঁর জন্মোৎসব!
অথচ আজ খ্রিস্টমাস ট্রি, ইয়ুল লগ, পাম পুডিং, মিসলটো, ঘণ্টা, মেরি খ্রিস্টমাস কার্ড- এসব অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে বড়োদিনের সঙ্গে। এই সব কিছুর সঙ্গত ছাড়া বিশ্বের কোনো প্রান্তেই বড়োদিনের উৎসবের আবহ রচিত হয় না।
কিন্তু কেন? সেটাই এবার দেখে নেওয়া যাক এক এক করে।
খ্রিস্টমাস ট্রি:
বড়োদিনে নয়, বরং শীতকাল এলেই চিরসবুজ গাছ দিয়ে বাড়ি সাজানো ছিল জার্মানির প্রথা। বড়োদিনের মরসুমে প্রথম এই গাছ দিয়ে গৃহসজ্জা দেখা গিয়েছিল স্ট্রাসবুর্গে। সময়টা ১৭৫০। তার পর ১৭৭১-এর বড়োদিনে জার্মানি ঘুরতে আসেন ওই সময়ের নামজাদা লেখক জোহান উলফগ্যাং ভন গেটে। স্ট্রাসবুর্গ ঘুরে খ্রিস্টমাস ট্রি-র সাজ দেখে মুগ্ধ হন তিনি, সে কথা তুলে আনেন ‘দ্য সাফারিং অব ইয়ং ওয়েরথার’ বইতে। এর পর খ্রিস্টমাস ট্রি নিয়ে হইচই পড়ে ১৮২০ সালে। সে বছরেই জার্মান রাজকুমার অ্যালবার্টের সঙ্গে বিয়ে হয় রানি ভিক্টোরিয়ার। বিয়ের পর অ্যালবার্ট ইংলন্ডকে চেনান খ্রিস্টমাস ট্রি দিয়ে বড়োদিন পালনের প্রথা। এর পর ১৮৪৮ সালে এক মার্কিন সংবাদপত্রে বড়োদিনের মরসুমে খ্রিস্টমাস ট্রি-র ছবি বেরোয়। দেখতে দেখতে এর পর তা জনপ্রিয় হয়ে যায় সারা বিশ্বে।
মিসলটো:
সেলটিক আর টিউটোনিক গোষ্ঠী পবিত্র গাছের পাতা একটা তোড়ায় বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত দরজার উপরে। তারা বিশ্বাস করত, এই তোড়া ক্ষত সারানোর ক্ষমতা তো ধরেই, সঙ্গে প্রজনন ক্ষমতাও বাড়ায়। এমনকী, তা অপদেবতার নজর থেকেও সুরক্ষিত রাখে সুখী গৃহকোণকে। ভিক্টোরিয় যুগে এই প্রথা প্রথমে ইংলন্ডে এবং পরে বিশ্বের সর্বত্রই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
খ্রিস্টমাস বেল:
সোনালি দুই ঘণ্টা যেন পরিণত হয়েছে বড়োদিনের প্রতীকে। কিন্তু এই প্রথার প্রচলনের জন্য বিশ্ব কৃতজ্ঞ থাকবে ফ্রান্সের কাছে। কেন না, ফরাসিতে বড়োদিনকে বলা হয় ‘নোয়েল’। এই ‘নোয়েল’ বলতে ঘণ্টাকেও বোঝায়। এই ভাবেই ‘নোয়েল’ শব্দের দুই মানে এক হয়ে গিয়ে বড়োদিনের অন্দরসাজে নিয়ে এল ঘণ্টার ব্যবহার।
মেরি খ্রিস্টমাস কার্ড:
মনে হতেই পারে, বড়োদিনে শুভেচ্ছা জানাতে কার্ড দেওয়া-নেওয়ার প্রচলন খুব পুরনো নয়। ঠিকই, তবে নয় নয় করেও এর উৎস খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে ১৮৩০ সালে। সেই বছরেই জন ক্যালকট হোর্সলে নামের এক ইংলিশম্যান ছোটো ছোটো রঙচঙে কার্ডে ‘মেরি খ্রিস্টমাস’ লিখে তা বিক্রি করতে শুরু করে। উৎসবের মরসুমে এই কার্ড দেওয়া-নেওয়া অচিরেই জনপ্রিয় হয়। প্রায় এক সময়ে আমেরিকাতেও শুরু হয় এহেন কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়। প্রচলন ঘটান আর এইচ পিস নামের এক ব্যক্তি। ধীরে ধীরে সারা বিশ্ব গ্রহণ করে শুভেচ্ছা জানানোর এই সুন্দর পন্থা।
ইয়ুল লগ:
‘ইয়ুল’ মানে চাকা আর ‘লগ’ মানে গাছের গুঁড়ি। ভেবে দেখেছেন কখনও, বিদেশে বড়োদিন পালনে কেন গাছের গুঁড়ি জ্বালিয়ে আগুন করা হয়? অথবা ঘরের ভিতরে চিমনিতে গুঁজে দেওয়া হয় একটা গাছের গুঁড়ি?
আসলে এই ইয়ুল লগের প্রথা এসেছে নরওয়ে থেকে। শীতে সূর্যদেবকে প্রসন্ন রাখতে তাঁর উদ্দেশে নিবেদন করা হত গোল, চাকার মতো আকারে কাটা গাছের গুঁড়ি। কেন না, ওখানকার অধিবাসীরা ভাবত, সূর্য এক প্রকাণ্ড আগুনের চাকা যা শীত এলে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যায়। তাই ফের কাছে আসার কথা মনে করিয়ে দিতেই এই ইয়ুল লগের আয়োজন। পরে তা পরিণত হয় বড়োদিনের উৎসব পালনের অঙ্গে। আসলে, বড়োদিনেও তো শীতের প্রকোপ থাকেই!
আর এই গাছের গুঁড়িকে মাথায় রেখেই জন্ম নেয় ইয়ুল লগ কেক। দেখতে ঠিক যেন একটা কাটা গাছ, অথচ আদতে মিষ্টিমুখের মাধ্যম। ধীরে ধীরে ইয়ুল লগের আকারে কেক ছাড়াও চিজও বানানো হতে থাকে।
পাম পুডিং:
বড়োদিনে খ্রিস্টীয় মিষ্টিমুখের অন্যতম অঙ্গই হল পাম পুডিং। অনেক সময় আবার পুডিং-ও নয়, পাম কেক হয়েই তা ধরা দেয় বড়োদিনের পাতে। তবে এই পাম পুডিং বা কেকের ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলার আগে একটা বিষয় না জানালেই নয়। এই পুডিং বা কেকে কিন্তু পাম ফল থাকে না। তাহলে ব্যাপারটা কী? কেন তাকে বলা হয় পাম পুডিং বা পাম কেক?
সে রহস্য উদঘাটিত হবে এই পুডিং তৈরির প্রণালীতে এলেই! সাবেক কাল থেকেই ইংলন্ডে পালাপার্বণে বানানো হত এই পুডিং। গরু বা ভেড়ার চর্বি, ময়দা, চিনি, কিসমিস, বাদাম আর কিছু মশলা একসঙ্গে মিশিয়ে একটা কাপড়ে বাঁধা হতো। তার পর তা ফেলে দেওয়া হত গরম জলে। জলের ভাপে একসময় ফুলে-ফেঁপে উঠত মিশ্রণটা, রূপ নিত পুডিংয়ের। আদতে এই ফুলে-ফেঁপে ওঠাকেই বলা হয় পাম (plum)!
কালে দিনে এই পাম পুডিং বড়োদিনের বিশেষ সুখাদ্যের তালিকায় ঠাঁই করে নেয়। যাঁরা পুডিং পছন্দ করেন না, তাঁরা অনেকটা এরকম ভাবেই বানান পাম কেক। লক্ষ্য করে দেখবেন, এখনও অনেক দোকানে পাম কেককে বলা হয় রিচ ফ্রুট কেক! ওই যে, এতে পাম ফল থাকে না!