দু’শো বছরে পা প্রেসিডেন্সি কলেজ, হিন্দু স্কুলের

0
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna.

শীর্ষ গুপ্ত
“…. ছাত্ররা এখানে সকলেই হিন্দু, জাতিগত কোনো ভেদ মানা হয় না; কোনোরকম পার্থক্য না রেখেই সবাই মেলামেশা করে; একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে, একসঙ্গে খেলাধুলো করে; ছাত্রদের নিজেদের স্বত্রন্ত্র হওয়ার কোনোরূপ প্রয়াস নেই।…. বহুসংখ্যক কিশোর ও তরুণের গলায় দেখেছি, তাদের পারিবারিক উচ্চমর্যাদার প্রতীক চিহ্ন ব্রাহ্মণের পৈতে ঝুলছে।…. সকলের পরনেই ভারতীয় ধরনের পোশাক, ইয়োরোপীয় পোশাকের কোনো কিছুই মেনে নেওয়া হয়নি।…. কেউ কেউ খুবই ফিটফাট, কিন্তু কোনোরকম জাঁকালো ভাব নেই, খুব অপরিষ্কারও কেউ নেই।…. চল্লিশটি কিশোরের অর্ধেকের বেশিরই মুখশ্রী সুন্দর, প্রায় সকলেরই হাত দুটো সুন্দর।…. তাদের গায়ের রঙ বেশ পাঁচমিশেলি হলেও, কলকাতায় যেখানে রঙের পার্থক্য বিরাট, সেখানকার পক্ষে লক্ষণীয়ভাবে একরকমের। বেশির ভাগেরই লম্বা চুল সর্বক্ষণ লটর পটর করে বলে তারা চুলে খোঁপা বেঁধে রাখে, খোঁপাগুলো দেখতে সৌষ্ঠবহীন বা আভিজাত্যহীন নয়; তবু আমার পছন্দ হল দু-চার জনের ইয়োরোপীয় ছাঁটে কাটা ছোট চুল। ওরা গা ঢাকার চেয়ে গায়ে বেশি জড়িয়েছে মোটা কিন্তু মোলায়েম ধুতিচাদর। তাদের অনেকগুলোর গোলাপি বা বেগুনি পাড়।….”
কলকাতার হিন্দু কলেজের ছাত্রদের এই বর্ণনা দিয়েছেন ফরাসি উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও ভূতত্ত্ববিদ ভিকতর জাকমঁ। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১৮২৮ সালে ভারতে আসেন তিনি। কলকাতায় ১৮২৯-এ। কলকাতায় থাকাকালীন গেছিলেন হিন্দু কলেজে। কেমন পড়াশোনা হয়, কারা সেখানে পড়তে আসে, সে সব বুঝতে। হিন্দু কলেজের পড়াশোনার খ্যাতি ছিল সে সময়। নিয়মিত রোজনামচা লিখতেন ভিকতর। সেই রোজনামচাতেই তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্রদের সম্পর্কে লেখেন। (রোজনামচায় কলকাতা থেকে বারাণসী পর্যন্ত ভ্রমণের অংশটুকু ‘কলকাতা ছাড়িয়ে’ শিরোনামে বাংলায় অনুবাদ করেন অবন্তী কুমার সান্যাল।)
ভিকতর যেমন হিন্দু কলেজের ছাত্রদের সম্পর্কে লিখেছেন, কেউ কেউ আবার তাঁদের ছবিও এঁকেছেন। এমনই এক জন হলেন বড়লাট অকল্যান্ডের বড় বোন এমিলি ইডেন। বিদুষী এমিলি ভালো লিখতেন, ভালো আঁকতেন। তিনি লিখেছিলেন, হিন্দু কলেজে যা ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া হয়, তা তাঁর নিজের দেশের অনেক স্কুলকে লজ্জা দিতে পারে। এমিলির আঁকা কয়েকশো ছবির মধ্যে দু’টি ছবির ক্যাপশন ‘হিন্দু কলেজের ছাত্র’। ছবি দেখে সন্দেহ হয়। সত্যি কি এরা হিন্দু কলেজের ছাত্র ? এক জনের মাথায় মোগলাই পাগড়ি, আরেকজনের মাথায় টুপি। পায়ে নাগরা। পরনে নকশাওয়ালা জামা-পাজামা, মখমলের মতো। গলায় একাধিক হার, হিরে বা নানা দামি পাথরের। এদের বাঙালি বলে মনে হয় না। মনে হয় ভিন্‌ রাজ্যের। আসলে তখনকার দিনে রাজা-মহারাজা-জমিদারবাড়ির ছেলেরা ওই রকম বেশেই পড়তে যেত স্কুলে।
এ হেন হিন্দু কলেজ থেকেই পরবর্তী কালে জন্ম প্রেসিডেন্সি কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) এবং হিন্দু স্কুলের। হিন্দু কলেজের গোড়াপত্তনের তারিখ ধরলে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ও হিন্দু স্কুল ২০০ বছরে পা দিল। ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করেছিল হিন্দু কলেজ।
সমস্ত উদ্যোগেরই একটা সলতে-পাকানো পর্ব থাকে। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে গোড়ার দিকে এ দেশে শিক্ষা বিস্তারের কোনও চেষ্টা হয়নি। কর্তৃপক্ষ তাদের প্রয়োজনে ১৭৮১ সালে খুলেছিল কলকাতা মাদ্রাসা, ১৭৯২ সালে বারাণসী সংস্কৃত কলেজ এবং ১৮০০ সালে কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। কোম্পানির বোর্ড অফ ট্রেডের সদস্য চার্লস গ্রান্ট ১৭৯০ সালে দেশে ফিরে প্রস্তাব করেছিলেন ভারতে ইংরিজি ভাষায় শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা হোক। কিন্তু গ্রান্টের ওই প্রস্তাবে কেউ রাজি হননি।
শেষ পর্যন্ত এ দেশে ইংরিজি ভাষায় শিক্ষা বিস্তারের উদ্যম দেখা গেল বেসরকারি স্তরে। এগিয়ে এলেন ডেভিড হেয়ার, যিনি ঘড়ি নির্মাতা হিসাবে নিজের ভাগ্য গড়ার উদ্দেশ্যে বাংলায় এসে এখানকার সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধনের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। আর অন্যতম প্রেরণা রাজা রামমোহন রায়ের। একটা উপযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া নিয়ে ১৮১৫ সালের এক সন্ধ্যায় দু’জনের কথা হল। দু’জনের মনের একটা মিল ছিল। হেয়ারের যেমন পাদরিদের দিয়ে প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতিতে আস্থা ছিল না, তেমনই রামমোহনও নিছক সংস্কৃত শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। এই বৈঠকের পরেই গুরু রামমোহনের ডাকে সাড়া দিলেন আত্মীয় সভার সদস্য বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি যোগাযোগ করলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যর এডওয়ার্ড হাইড ইস্টের সঙ্গে। ইস্ট সাহেব তাঁর ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটের বাড়িতে প্রস্তাবিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন নিয়ে মিটিং ডাকলেন ১৮১৬ সালের ১৪ মে। শহরের সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের অনেকেই সে দিনের সভায় হাজির। এমনকী বহু সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতও। প্রথম সভাতেই উদার হাতে চাঁদার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন অনেকেই। সমাজের এই বিপুল উৎসাহ দেখে এক সপ্তাহ পরেই দ্বিতীয় সভা ডাকা হল। ঠিক হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম হবে হিন্দু কলেজ। ৩০ জনের কমিটি তৈরি হল। আরও সভা হল, সাব কমিটি হল, কলেজের জন্য নিয়মাবলি তৈরি হল। কলেজ হবে দু’ ভাগ — স্কুল বা পাঠশালা আর অ্যাকাডেমি বা মহাবিদ্যালয়। কলেজের ইউরোপীয় সম্পাদক হলেন ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস আরভিন এবং হিন্দু সম্পাদক হলেন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। প্রধান শিক্ষক হলেন জেমস আইজাক ডি’ আনসেলম। কলেজের গভর্নর হলেন গোপীমোহন ঠাকুর এবং বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্র। ম্যানেজিং কমিটিতে থাকলেন গোপীমোহন দেব, জয়কৃষ্ণ সিংহ, রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, গঙ্গানারায়ণ দাস ও হরিমোহন ঠাকুর।
এই সময় কলকাতা শহরে ইংরিজি শিক্ষার স্কুল যে ছিল না, তা নয়। ড্রামন্ডের স্কুল, সোরবোর্ন সাহেবের স্কুল, হাটম্যানের স্কুল, আরাটুন পিদ্রুস সাহেবের স্কুল। কিন্তু এই সব স্কুলে ইংরিজি বিদ্যার চর্চা সঠিক ভাবে হত না। কী ভাবে পড়ানো হত সেখানে ? শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, “সে সময়ে বাক্য-রচনা প্রণালী বা ব্যাকরণ প্রভৃতি শিক্ষার দিকে দৃষ্টি ছিল না। কেবল ইংরাজী শব্দ ও তাহার অর্থ শিখাইবার দিকে প্রধানত মনোযোগ দেওয়া হইত। যে যত অধিক সংখ্যক ইংরাজী শব্দ ও তাহার অর্থ কণ্ঠস্থ করিত, ইংরাজী ভাষায় সুশিক্ষিত বলিয়া তাহার তত খ্যাতি-প্রতিপত্তি হইত। এরূপ শোনা যায়, শ্রীরামপুরের মিশনারীগণ এই বলিয়া তাহাদের আশ্রিত ব্যক্তিদিগকে সার্টিফিকেট দিতেন যে, এই ব্যক্তি দুইশত বা তিনশত ইংরাজী শব্দ শিখিয়াছে। এই কারণ সে সময় কোনও কোনও বালক ইংরাজী অভিধান মুখস্ত করিত।”
বলা বাহুল্য সঠিক পদ্ধতিতে ইংরিজি ভাষা শেখানোই প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু কলেজের। তবে পাশাপাশি বাংলা ও ফারসি ভাষা শেখানোরও ব্যবস্থা হল। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মাধ্যম ছিল ইংরিজিই।
চাঁদা তোলা চলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত এক লক্ষ তেরো হাজার একশো ঊনআশি টাকা চাঁদা উঠল। ২০ জন ছাত্র নিয়ে স্কুল খোলা হল ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি, ৩০৪ নম্বর চিৎপুর রোডে গোরাচাঁদ বসাকের বাড়ীতে। তার পর ঠাঁই বদল হল কয়েক বার। মনিষী রাজনারায়ণ বসু জানিয়েছেন, “প্রথম গরাণহাটার গোরাচাঁদ বসাক-এর বাড়িতে (যেখানে এক্ষণে ওরিয়েন্টাল সেমিনারী আছে সেইখানে) স্কুলটি সংস্থাপিত হয়। তাহার পর ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়ীতে (এক্ষণে যাহা বাবু হরনাথ মল্লিকের বাটী ও যেখানে সর্বপ্রথম ব্রাহ্ম সমাজ কিছুদিন হইয়াছিল) লইয়া যাওয়া হয়, তথা হইতে স্কুল টেরিটী বাজারে স্থানান্তরিত হয়।”
১৮২৩ সালে হিন্দু কলেজ সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হল। ইতিমধ্যে সংস্কৃত শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে সরকার কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছে। রাজা রামমোহন কিন্তু সরকারের এই উদ্যোগে সন্তুষ্ট হননি। তাঁর মতে, সংস্কৃত শিক্ষাব্যবস্থার ফলে এ দেশ তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে থাকবে। সরকারি উদ্যোগের বিরোধিতা করে বড়লাট লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি দিলেন রাজা। তবে তাঁর চিঠির বক্তব্য বিবেচিত হল না। ১৮২৪ সালের ১ জানুয়ারি বউবাজারের একটা ভাড়া বাড়িতে খোলা হল সংস্কৃত কলেজ। এবং কলেজের নিজস্ব বাড়ির জন্য গোলদিঘির উত্তর পাড়ে পাঁচ বিঘা সাত কাঠা জমি কেনা হল। তার মধ্যে দু’ বিঘা কেনা হল ডেভিড হেয়ারের কাছ থেকে। ঠিক হল, সংস্কৃত কলেজের জন্য যে বাড়ি উঠবে সেই বাড়িতেই হিন্দু কলেজ ও স্কুলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ইতিমধ্যে অবশ্য হিন্দু কলেজকে মাসে মাসে ২৮০ টাকা করে দিতে রাজি হয়েছে সরকার।
১৮২৫ সালে হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ-সভার সদস্য হয়ে এলেন হেয়ারসাহেব। এই প্রথম কোনও অহিন্দু হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ-সভার সদস্য হলেন। এ দিকে কলেজের তহবিলদার ব্যারোটো অ্যান্ড সন্স ফেল পড়ল। হিন্দু কলেজ আরও বেশি করে সরকারি সাহায্যের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হল। ১৮২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংস্কৃত কলেজের নতুন বাড়ির শিলান্যাস হয়েছিল। দু’ বছর লাগল বাড়ি উঠতে। ১৮২৬ সালের ১ মে গোলদিঘির গায়ে নতুন বাড়িতে উঠে এল সংস্কৃত কলেজ এবং সেই সঙ্গে হিন্দু কলেজ।
তার পর প্রায় ৩০ বছর পর ১৮৫৪ সালের ১৫ মে হিন্দু কলেজ থেকে জন্ম হল দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। কলেজ-বিভাগ হল প্রেসিডেন্সি কলেজ, স্কুল-বিভাগ হল হিন্দু স্কুল। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজ কী ভাবে রাস্তা পার হয়ে চলে গেল তার নতুন ঠিকানায়, সে কাহিনি আপাতত থাক।
(ছবি : গোলদিঘির পাড়ে হিন্দু কলেজ-সহ সংস্কৃত কলেজের ভবন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ফ্রান্সিস ফ্রিথ-এর তোলা।)

dailyhunt

খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল

বিজ্ঞাপন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.