প্রবন্ধ
গুরু শিষ্য সংবাদ
দিনের বাণী শুরু করতে গিয়ে ভক্তগণের উদ্দেশে মোদীজি বললেন…


অরুণাভ ঘোষ
আড়াই হাত লম্বা সাদা দাড়ি নিয়ে গেরুয়া বসনে সন্ন্যাসী মোদীজি উচ্চাসনে বসে আছেন। নীচে পদতলে বসে আছ ভক্তগণ, মোদীজির দিনের বাণী শোনার জন্য। তাদের মধ্যে থেকে মুহুর্মুহু উঠে আসছে, “জয় শ্রীরাম” স্লোগান।
দিনের বাণী শুরু করতে গিয়ে ভক্তগণের উদ্দেশে মোদীজি বললেন…
“হে ভক্তগণ,
আপনাদের মধ্যে একটি অশুভ গুঞ্জন প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। তা হল, যুক্তির পথে নেতাদের, বিশেষ করে আমার, কার্যকলাপ বুঝতে গিয়ে আপনারা না কি আজকাল খেই হারিয়ে ফেলছেন। তাই আপনাদের সামনে আজ রাজনীতির এবং ধর্মনীতির গোড়ার কথা একটু খুলে বলব যাতে আপনাদের যুক্তিবাদী মন আমাদের মুখ থেকে মাঝে মাঝে বিপরীত কথা শুনে বিভ্রান্ত না হয়ে পড়ে।
আপনাদের মধ্যে থেকে প্রায়শই অভিযোগ শোনা যায় যে আমি না কি কথায় যা বলি, বাস্তবে ঠিক তার বিপরীত কাজটাই করে থাকি। যেমন চিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোলাকুলি করার কিছু দিন পরেই ওদের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত নিয়ে ঝামেলা বেঁধে গেল। পাকিস্তান আমাদের শত্রু দেশ বলে চিহ্নিত। অথচ আমি ওদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মেয়ের বিয়েতে বিনা আমন্ত্রণে চলে গিয়েছিলাম এবং জনসমক্ষে ঘনিষ্ঠ কোলাকুলি সেরে ফেলি। বেশ কিছু দিন আগে আমি ঘোষণা করেছিলাম যে রেল ছোটোবেলা থেকে আমার জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, তাই রেলওয়ে বিলগ্নিকরণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এখন আমার সরকার ভারতীয় রেলের এক বৃহৎ অংশকে ব্যক্তিগত মালিকানার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক দিকে যখন চিনাদের হাতে আমাদের কুড়ি জন ভারতীয় সেনা নৃশংস ভাবে মারা গেল আমাদেরই জমিতে, তখন আমি বলেছি যে, চিনারা আমাদের ভূখণ্ডে পা রাখেনি। মহাত্মা গান্ধীকে এক দিকে আমি যখন বলছি জাতির জনক, তখন একই সঙ্গে আমাদের দলের লোকেরা নাথুরাম গডসের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে আমি বলেছিলেন, জিএসটি আমাদের দেশের সর্বনাশ ডেকে আনবে, এখন বলছি, ভারতের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করানোর জন্য শেষ কথা জিএসটি-ই। ক্ষমতায় আসার আগে মনমোহন সিং সরকারের ৫১ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্তকে ধিক্কার জানিয়ে আমি বলেছিলাম যে এতে দেশের সর্বনাশ হবে। এখন বলছি, দেশের উন্নতিসাধনে একশো শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ দরকার, যা আমার সরকার অনুমোদন করেছে।
আমার নামে অভিযোগ রয়েছে যে আমার না কি দু’টি জন্মতারিখ। প্রথমটা, ২৯ আগস্ট, ১৯৪৯, যা আমার গ্র্যাজুয়েশন সার্টিফিকেটে লেখা রয়েছে, বিরোধীরা যাকে জাল বলে অভিহিত করে। দ্বিতীয় তারিখটি হল ১৭ সেপ্টেম্বর, যা আমার নির্বাচনী হলফনামায় দাখিল করেছিলাম। আমার বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ হল, আমি যখন ৬ বছর বয়সে ভাঁড়ে চা বিক্রি করতাম ট্রেনের কামরার বাইরে ভবনগরে রেল স্টেশনে, যেখানে ওই নামে কোনো স্টেশনই ছিল না। ভারতীয় রেলের রেকর্ড অনুযায়ী, ভবনগর স্টেশনটি উদ্বোধন হয় ১৯৭০ সালে। যখন আমার বয়স ছিল ২১ কি ২২।
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল অবধি আমি দেশে জরুরি অবস্থার সময় গ্রেফতারি এড়াতে আত্মগোপন করেছিলাম। ১৯৭৮ সালে আমি স্নাতক হই। বিরোধীরা প্রশ্ন তোলে, দুই বছর আত্মগোপন করার পর, কোনো ক্লাস না করে আমি কী করে পরীক্ষায় বসলাম? এবং পাশ-ও করে গেলাম। এটা কী করে হয়। ১৯৮৩ সালে আমি গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে entire political science-এ স্নাতক ডিগ্রি পাই, যা পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না।
অভিযোগ, এমন কোনো মানুষকে আমি দেখাতে পারি না, যাঁরা এসে বলবেন যে তাঁরা আমায় পড়িয়েছেন অথবা আমার সঙ্গে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ক্লাসে পড়াশোনা করেছেন। এটা ঠিক যে আমি একটি টেলিভশন সাক্ষাৎকারে বলেছি যে আমি ক্লাস টেনের গণ্ডি পেরোইনি, ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর। তাই অনেকে আমাকে নন-মেট্রিক গ্র্যাজুয়েট বলে থাকে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যখন প্রশ্ন উঠল আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে, তখন মন্ত্রী অরুণ জেটলি আমার স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষার দু’টি মার্কশিট প্রকাশ করেন, যা মাইক্রোসফট কম্পিউটারে তৈরি, যে কম্পিউটার ১৯৯০ সালে ভারতে আসে। প্রশ্ন ওঠে, ১৯৭৮ ও ১৯৮৩ সালের পরীক্ষার সার্টিফিকেট কী করে ছাপা হয় সেই সময়ে, ১৯৯০ সালের বিদেশি মাইক্রোসফট কম্পিউটারের মাধ্যমে?
এ বার আমি বলি?
আমার এই কথার আর কাজের ফারাকের ব্যাপারটা হল গিয়ে টাকার এ-পিঠ আর ও-পিঠের মতন। এ-পিঠে এক রকম ছাপ আবার ও-পিঠে আরেক রকম ছাপ। কিন্তু ছাপ আলাদা বলে তো টাকাটা আলাদা নয়। এ-পিঠেও টাকা, ও-পিঠেও সেই টাকা। আপনারা যে মুহূর্তে যুক্তির ছুরি শানিয়ে চুলচেরা বিচারে বসবেন, তখনই বস্তুর খণ্ড রূপটি চোখের সামনে বড়ো হয়ে দেখা দেবে। অমনি ভ্রান্তি আসবে। মায়ের বাঁ বুকের দুধে পুষ্টি বেশি, না ডান দিকে – খিদের সময় শিশু যদি তার মায়ের বুক ফালাফালা করে বিচার করতে যায়, তা হলে কি তার খিদে মিটবে। তার আবার অত চুলেচেরা হিসাবে যাওয়া কেন?
বিচার নয়, বিশ্বাস চাই। বিচারের পথ বড়ো শক্ত। ও বড়ো কঠিন পথ। ও পথে চলতে গেলে বিদ্যে চাই, বুদ্ধি চাই, নিজের উপর আস্থা চাই। ওটা হল কাকের পথ। কাক ডিমে তা দেবে, তার কত আয়োজন। খড় আনো, কুটো আনো, শক্ত জায়গায় ভালো করে বাসা বাঁধো। তবে ডিম পেড়ে তা দিতে বসো। কিন্তু কোকিলের অতশত বালাই নেই। সে কাকের বাসায় ডিম পেড়ে রেখে এসেই খালাস। তার অটল বিশ্বাস, এ ডিম ফুটে বাচ্চা হবেই, যেই তা দিক। এটা হল সহজ পথ। বর্তমানে আমাদেরও এই রকম সহজ পথ- ‘বিশ্বাসের পথ’।
পূজারি বামুন নারায়ণ শিলাকে কখনও চাদরের খুঁটে বেঁধে, কখনও বা ফুলের সাজিতে বসিয়ে নিয়ে যায়। তার পর বাড়িতে গিয়ে সেই শালগ্রামটিকে টাটে বসিয়ে দেয়। আমি হচ্ছি সেই শালগ্রাম। আমাকে টাটে বসানোই আপনাদের কাজ। তা আপনারা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান তুলে বসান বা অন্য কোনো পথে বসান, তাতে শালগ্রামের কিছু এসে যায় না। তিনি গদিতে বসতে পেলেই খুশি। এর মধ্যে বিভ্রান্তি ঘটার অবকাশ কোথায়? বরের লক্ষ্য ছাঁদনাতলা। তা আপনারা বরকে মোটরে করে নিয়ে যান, নৌকা করেই নিয়ে যান আর পালকি করেই পোঁছে দিন, বর গিয়ে ছাঁদনাতলায় দাঁড়াতে পারলেই হল। এর মধ্যে বিভ্রান্তিটা আসছে কোথায়?
পোয়াতির ব্যথা উঠেছে। একেবারে এখন তখন। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। তখন কি অ্যাম্বুলেন্স আসছে না বলে তাকে ঘরে ফেলে রাখবে? আমার গদিতে বসার ব্যাপারটাও ওই পোয়াতির গর্ভযন্ত্রণার মতোই আর্জেন্ট। কবে জনগণ চাইবে, তার জন্য অপেক্ষা করা মূর্খতা। আদর্শের ভিত্তিতে ক্ষমতা দখল হলে ভালো, যদি তা না হয় তা হলে বিপরীত আদর্শের কোলে চেপেই ক্ষমতায় আমাকে বসিয়ে দিতে হবে।
আশা করি এই রূপ সদুপদেশে পেয়ে আপনাদের ভ্রান্তি দূর হয়েছে। এ বার হৃষ্টচিত্তে যে যার এলাকায় গিয়ে মনোযোগ সরকারে কাজে নেমে পড়ুন। জয় শ্রীরাম।
(শ্রী গৌরকিশোর ঘোষের ‘গুরু শিষ্য সংবাদ’-এর ছায়া অবলম্বনে)
*লেখক বিশিষ্ট আইনজীবী এবং কংগ্রেস নেতা
আরও পড়তে পারেন: ভরা ব্রিগেডের জনসভা কি প্রত্যাশা পূরণের কোনো ইঙ্গিত দিতে পারল?
প্রবন্ধ
First Man In Space: ইউরি গাগারিনের মহাকাশ বিজয়ের ৬০ বছর আজ, জেনে নিন কিছু আকর্ষণীয় তথ্য
আজ থেকে ঠিক ৬০ বছর আগে ১৯৬১-এর ১২ এপ্রিল মহাকাশে হিয়েছিলেন গাগারিন।


খবরঅনলাইন ডেস্ক: ‘মানুষ চূর্ণিল আজ নিজ মর্ত্যসীমা’ – ১৩ এপ্রিল, ১৯৬১। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় আট কলম জুড়ে ব্যানার হেডিং। মানুষ বিস্মিত, হতচকিত – মহাকাশে পৌঁছে গিয়েছে মানুষ?
তখনকার দিনে ঘরে ঘরে সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার সব চেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল সংবাদপত্র। রেডিও ছিল, তবে তা ঘরে ঘরে ছিল না। আর টিভি তো ক’টা দেশে ছিল, তা হাতে গোনা যায়। তাই সংবাদপত্রই মূলত পৌঁছে দিল সেই খবর।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার প্রত্যেকটি কাগজে সে দিন প্রথম পাতার খবর – মানুষের মহাকাশ জয়। মানব-ইতিহাসে সব চেয়ে স্মরণীয় ঘটনা।
দিনটা ছিল ১২ এপ্রিল, ১৯৬১। সোভিয়েত নভশ্চর ইউরি গাগারিন মহাকাশযান ভস্তক ১-এ চেপে মর্ত্যের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে পৌঁছে গেলেন মহাকাশে। মহাকাশজয়ী প্রথম মানব হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকলেন গাগারিন।
যুদ্ধবিমানের বিমানের পাইলট গাগারিন মহাকাশে ছিলেন ১ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট। তাঁর মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল অধুনা কাজাখস্তানের বৈকনুর কসমোড্রোম থেকে। পশ্চিম রাশিয়ার সিটি অফ এঞ্জেলস-এর কাছে গাগারিনের মহাকাশযান পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করে। মহাকাশযান থেকে প্যারাশ্যুটে লাফিয়ে পড়েন গাগারিন, নিরাপদে পৌঁছে যান ভূপৃষ্ঠে।
৬০ বছর আগে গাগারিনের সেই মহাকাশ-অভিযান মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে মানুষের গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দিল। এর পর থেকে মানুষ মহাকাশ নিয়ে কী করল, সে সব আজ আর কোনো অজানা তথ্য নয়।
ভস্তক ১ মিশন নিয়ে কিছু আকর্ষণীয় তথ্য
(১) বৈকানুর কসমোড্রোম থেকে যে মুহূর্তে ভস্তক ১ যাত্রা শুরু করেছিল, সেই মুহূর্তে গাগারিনের মুখ থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে এসেছিল – “পোয়েখালি!” (যাওয়া যাক)।
(২) যে ভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, ঠিক সেই ভাবে চালিত হয়নি মিশন। যে উচ্চতায় কক্ষপথে ভস্তক ১-এর প্রবেশ করার কথা ছিল, তার চেয়ে বেশি উচ্চতায় প্রবেশ করেছিল। এর অর্থ মহাকাশযানটির ব্রেক ফেল করতে পারত। তা হলে আরও বেশি ক্ষণ গাগারিনকে মহাকাশে থাকতে হত। তবে তা হয়নি। ব্রেক ভালো ভাবেই কাজ করেছে এবং ফেরার সময় গাগারিন পরিকল্পনামাফিকই পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করেছেন।
(৩) জানা যায়, ভূপৃষ্ঠ ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাগারিনকে প্রথম দেখেছিলেন এক কৃষক ও তাঁর কন্যা। সেই সময়টা ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের। গাগারিনকে তাঁরা মার্কিন গুপ্তচর মনে করেছিলেন। তাঁদের বোঝাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল গাগারিনকে।
(৪) গোটা মিশনটা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন চরম গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিল। গাগারিন পৃথিবীতে নিরাপদে পৌঁছে যাওয়ার পরে ইউরি গাগারিনের এই অবিস্মরণীয় কৃতিত্বের খবর প্রকাশ করা হয়। সারা বিশ্ব যেন একটা ধাক্কা খায়, বিশ্বাস করে উঠতে পারে না ঘটনাটা – মনে মনে ভাবে, এমনও হয়!
(৫) গাগারিনের মহাকাশ-বিজয় উপলক্ষ্যে উৎসব-সমারোহের আয়োজন করা হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে। হাজার হাজার লোক তাতে যোগ দেন। অসংখ্য মডেল রকেট আকাশে ছোড়া হয়। সেই সঙ্গে চলে আতসবাজির নানা খেলা।
প্রবন্ধ
Bengal Polls 2021: কোচবিহার জেলার ন’টি বিধানসভা কেন্দ্রে লড়াইয়ে কে কোথায়
২০২১-এ প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গোটা রাজ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে বিজেপি। তার নিরিখে বুঝতে হবে কোচবিহারের ফলাফল।


তপন মল্লিক চৌধুরী
উত্তর বাংলার কোচবিহার জেলায় ন’টি বিধানসভা কেন্দ্র। ২০১৬-তে ন’টির মধ্যে ৮টি জিতেছিল তৃণমূল, একটিতে বামেরা। ২০১৯-এর লোকসভায় পাশা উলটে যায়। তৃণমূলকে টেক্কা দিয়ে বিজেপি লিড নিয়েছিল মাথাভাঙা, কোচবিহার উত্তর ও দক্ষিণ, দিনহাটা ও নাটাবাড়িতে। ২০২১-এ প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গোটা রাজ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে বিজেপি। তার নিরিখে বুঝতে হবে কোচবিহারের ফলাফল।
এ বার কোচবিহারে দিনহাটা ও নাটাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্র দু’টি আলোচনায় সব থেকে এগিয়ে। এখানে আগে যাঁরা ছিলেন তৃণমূলে, একুশে তাঁরাই বিজেপির হয়ে ভোটে লড়ছেন। তাঁদের মধ্যে একজন নিশীথ প্রামাণিক, অন্য জন মিহির গোস্বামী। নিশীথ দিনহাটায় তৃণমূলের উদয়ন গুহের বিরুদ্ধে ভোটে লড়ছেন আর মিহির নাটাবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঘোষের বিরুদ্ধে। তার মানে এখানে জেলা তৃণমূলের দুই প্রাক্তন সভাপতির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে রবিবাবু ১৬ হাজারের বেশি ভোটে জয় পেলেও গত লোকসভায় সাড়ে ১৮ হাজারের বেশি ভোটে পিছিয়ে পড়ে তৃণমূল। তার পর থেকে বিজেপি এখানে সাংগঠনিক শক্তি যথেষ্ট মজবুত করেছে। করোনা পরিস্থিতিতে রবিবাবু দিনরাত মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে আসা মিহির গোস্বামীও কম যাচ্ছেন না।
দিনহাটার প্রার্থী উদয়ন বাবা কমল গুহের হাত ধরে রাজনীতি শুরু করে রাজ্যে পালাবদলের পর ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। এই কেন্দ্রের বিধায়কও হন। বাম ও ডান, দু’ দলের বিধায়ক হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর। উদয়নকে কোণঠাসা করতেই যে সাংসদ নিশীথকে বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী করা সেটা সকলেই বুঝছেন। দিনহাটায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মারাত্মক। দলের বিধায়ক-প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে পথে নেমে আন্দোলন করেছে কর্মী-সমর্থকরা। অন্য দিকে সাংসদপদ ছেড়ে বিধায়কপদের জন্য প্রার্থী হওয়া নিশীথকেও খুব সহজে মেনে নিতে পারছে না দিনহাটাবাসী। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সংযুক্ত মোর্চার আব্দুর রাউফের (ফরওয়ার্ড ব্লক) সম্ভাবনা রয়েছে।
কোচবিহার দক্ষিণের লড়াইটা তৃণমূলের নবীন প্রার্থী অভিজিৎ দে ভৌমিক বনাম বিজেপির অভিজ্ঞ প্রার্থী নিখিল রঞ্জন দের। কারণ তৃণমূল বিধায়ক মিহির গোস্বামী এ বার দল বদলে নাটাবাড়িতে বিজেপি প্রার্থী। তাঁর জায়গায় তৃণমূল যুব কংগ্রেসের জেলা সভাপতি অভিজিত দে ভৌমিককে (হিপ্পি) লড়তে হচ্ছে বিজেপির প্রাক্তন জেলা সভাপতি নিখিলরঞ্জন দের বিরুদ্ধে। অন্য দিকে বামপন্থী প্রার্থী অক্ষর ঠাকুর এক সময় এই এলাকার বিধায়ক ছিলেন। সব মিলিয়ে এই কেন্দ্রে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা।
প্রসঙ্গত, উত্তর কোচবিহার কেন্দ্রে ২০১৬-তে তৃণমূলের পরিমল বর্মনকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের নগেন্দ্রনাথ রায়। এ বারও তিনি বামেদের প্রার্থী। ২০১৯-এ এই কেন্দ্র থেকে ২৭ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতেছিলেন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া নিশীথ প্রামাণিক। এ বার এখানে বিজেপি প্রার্থী দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক সুকুমার রায়। উলটো দিকে তৃণমূল মাথাভাঙার বিধায়ক তথা অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মনকে প্রার্থী করেছে। সব মিলিয়ে জোরদার লড়াই।
মাথাভাঙা বিধানসভা কেন্দ্রেটি তফশিলি উপজাতির জন্য সংরক্ষিত। ২০১৬ সালে তৃণমূল প্রার্থী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন ৩২ হাজারের বেশি ভোটে জয় পেলেও গত লোকসভা নির্বাচনে এখানে ২১ হাজারের বেশি ভোটে পিছিয়ে পড়েছিল তৃণমূল। এ বার বিনয়কৃষ্ণ বর্মনের পরিবর্তে হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক গিরীন্দ্রনাথ বর্মন হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী। বিজেপি প্রার্থী করেছে পেশায় কৃষক সুশীল বর্মনকে। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী অশোক বর্মন (সিপিএম)। এখানে ভোটের হাওয়া ততটা গরম নয়।
লোকসভায় কোচবিহারে ভরাডুবি হলেও সিতাইয়ে তৃণমূল বিজেপির থেকে প্রায় ৩৫ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল। কিন্তু জেতার পর এক মাসের বেশি বাড়িছাড়া ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক জগদীশ বর্মাবসুনিয়া। এ বারও জগদীশবাবু দলের প্রার্থী। বিজেপি এখানে প্রার্থী করেছে দীপক রায়কে। তাঁকে ঘিরে বিজেপির মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। সংযুক্ত মোর্চর প্রার্থী কেশব রায় (কংগ্রেস)। এখানে প্রচারে হাওয়া গরম হচ্ছে কান্তেশ্বর সেতু কার আমলে তৈরি তা-ই নিয়ে। তৃণমূল বিধায়ক জগদীশবাবুর দাবি সেতুর শিলান্যাস হয় তাঁর হাত দিয়ে। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী কেশববাবু বলছেন, তৃণমূল মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে।
তুফানগঞ্জে বিজেপি যথেষ্ট শক্তিশালী। এ বার এখানে প্রার্থী জেলা সভাপতি মালতী রাভা। মালতী দেবী ২০০১ ও ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন। তিনি সম্প্রতি কোচবিহারে থাকলেও তাঁর আসল বাড়ি তুফানগঞ্জে। অন্য দিকে তৃণমূল এখানে প্রার্থী করেছে প্রণবকুমার দেকে। কিন্তু তিনি আলিপুরদুয়ারের লোক হওয়ায় দলের অন্দরে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী কংগ্রেসের রবিন রায়কেও মানতে নারাজ কংগ্রেস, নিজেদের মধ্যেই চলছে লাগাতার অসন্তোষ।
মেখলিগঞ্জে এ বার ফরওয়ার্ড ব্লকের দুই প্রাক্তন পরেশ অধিকারী বনাম দধিরাম রায়ের লড়াই। মেয়ের চাকরি নিয়ে বড়োসড়ো বিতর্কে জড়ানো পরেশ অধিকারীকে লোকসভায় প্রার্থী করার খেসারত দিয়েছে তৃণমূল। তার পরেও তিনি বিধানসভায় প্রার্থী। উলটো দিকে বিজেপি প্রার্থী দলের মণ্ডল সভাপতি দধিরাম রায়। ২০১৬-র বিধানসভায় তৃণমূল ৬০০০ ভোটে জিতলেও লোকসভা ভোটে পিছিয়ে ছিল। এখানে প্রচারে সেতু কারা তৈরি করল তা নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে দ্বন্দ্ব বেঁধেছে। দু’ জনেই দাবি করেন এই সেতু তাঁদের তৈরি। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী গোবিন্দ রায় অন্য জেলার বাসিন্দা হওয়ার দরুন প্রথম থেকে কিছুটা ব্যাকফুটে।
শীতলকুচি কেন্দ্রে মূল লড়াই তৃণমূলের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের। তৃণমূল প্রার্থী পার্থপ্রতিম রায় মানুষকে উন্নয়নের বার্তা দিতে চাইছেন। অন্য দিকে সংযুক্ত মোর্চার সিপিএম প্রার্থী সুধাংশু প্রামাণিক তাঁর বাবা প্রয়াত সুধীর প্রামাণিক ৩০ বছর বিধায়ক থেকে এলাকার উন্নয়নে কত কাজ করেছিলেন সেটাই প্রচারে সামনে রাখছেন। বিজেপি প্রার্থী বরেনচন্দ্র বর্মনও হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। এই আসনটিতে বিজেপি খুব একটা এগিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করছে না রাজনৈতিক মহল।
আরও পড়ুন: Bengal Polls 2021: উত্তরবঙ্গের চা বাগানে অ্যাডভান্টেজ মমতা
প্রবন্ধ
Bengal Polls 2021: এই ভোটে মুকুল রায় কোথায়?
মুকুল রায়ের এই পরিণতির প্রধান কারণ, শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগ দেওয়া।


শৈবাল বিশ্বাস
এই ভোটে কোথাও নেই মুকুল রায়। কৃষ্ণনগর উত্তর আসনে প্রার্থী করে ভোট-ময়দান থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন? কারণ অনেকগুলি রয়েছে বটে, তবে প্রধান কারণ মুখ্য প্রচারকের দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্য জুড়ে সফর করলে তাঁকে স্টার ক্যাম্পেনারের মর্যাদা দিতেই হতো এবং সেই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে তাঁর নাম প্রথমে উঠে আসত। কিন্তু দিলীপ ঘোষ হয়তো তা চান না। বিজেপি রাজ্য সভাপতি তৃণমূল-ছোঁয়া কোনো লোকের প্রাধান্য মেনে নিতে রাজি নন। আরএসএস-এর কাছে তিনি মুকুল রায়ের কেস হিস্ট্রি এমন ভাবে পেশ করেছেন যে স্বয়ং অমিত শাহর সাধ্য হয়নি মুকুলবাবুকে সমান্তরাল নেতা হিসাবে তুলে ধরতে। কিন্তু তাঁকে ছুড়ে ফেললে সংগঠন দুর্বল হবে তাই ৩০ হাজার ভোটে লোকসভায় লিড নেওয়া কৃষ্ণনগর উত্তর আসনটি দিয়ে তাঁকে কার্যত ছেলে-ভোলানো হল।
তা বলে বিজেপি সরকার গঠন করলে মুকুলবাবু কি মন্ত্রী হবেন না? না চাইলেও তাঁকে মন্ত্রী হতে বাধ্য করা হবে। শুধু তা-ই নয়, উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ দিয়ে তাঁর অভিমান ভাঙানো হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে দলের এই সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির সামনে পথ দু’টি। প্রথমত, হয় সারদা মামলার রাজসাক্ষী হওয়ার আর্জি জানিয়ে রাজনীতি-জীবনে সাময়িক বিরতি নেওয়া, নয়তো মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়ে রাজনৈতিক কেরিয়ারটা অজানা লক্ষ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া।
মুকুল রায়ের এই পরিণতির প্রধান কারণ, শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগ দেওয়া। এক সময় অভিষেক-মমতার তল্পিবাহক মুকুলবাবুর সঙ্গে শুভেন্দুবাবুর সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল। ‘যুবা’ সংগঠন খুলে যুব তৃণমূলের সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ না কি মুকুল রায়ের দেওয়া। এই কারণে যুব তৃণমূলের সভাপতি শুভেন্দু দ্রুত পায়ের তলার মাটি হারাচ্ছিলেন। এই ইতিহাস ভুলে মুকুল রায়কে মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। অনেকেই বলেন, বিজেপিতে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁর শর্তই ছিল, মুকুল রায়ের গুরুত্ব হ্রাস করতে হবে।
বিধানসভা নির্বাচনের পর্ব শুরু হওয়ার আগে মুকুল রায়ের হাত ধরে বহু ছোটোখাটো তৃণমূল নেতা বিজেপি শিবিরে নাম লিখিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তাঁর অনুগামী পুরোনো নেতারা তো আছেনই। এঁদের সবাইকে টিকিট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুকুল। কিন্তু একটা দু’টো আসন বাদ দিয়ে বাকি আসনে মোদী- শাহরা দিলীপ-কৈলাসের কথা মতোই চলেছেন। মুকুলবাবু টিকিট পাইয়েছেন কলকাতার শ্যামপুকুর কেন্দ্রের প্রার্থী সন্দীপন বিশ্বাস, বীজপুরে শুভ্রাংশু – এ রকম হাতে গোনা কয়েক জনকে। শুধু তা-ই নয়, এর আগে যাঁরা মুকুল রায়ের হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন যেমন শোভন-বৈশাখী, মনিরুল ইসলাম ইত্যাদি নেতাদের কোনো টিকিট পাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠেনি।
পরিস্থিতি বুঝে তৃণমূল শিবিরের পক্ষে মুকুল রায়ের সঙ্গে যোগাযোগের আপ্রাণ চেষ্টা চলেছে। মুখ্যমন্ত্রী তো বলে দিয়েছেন, “মুকুল তত খারাপ নন।” তৃণমূল শীর্ষ নেতারা চেষ্টা চালাচ্ছেন এই ভোটে তাঁকে নিষ্ক্রিয় রাখতে। বিভিন্ন জেলায় তৃণমূলের যে সব নেতা মুকুল রায়ের কথা শুনে বিজেপির কাছে এসেছিলেন তাঁরা যাতে সক্রিয় মমতা-বিরোধিতার রাস্তায় না যান সেটাই লক্ষ্য। তবে মুকুল-সন্ধি করার প্রশ্নে অভিষেক কতটা রাজি সেটা কেউ জানে না। একটা কথা মনে রাখা দরকার, নারদা-কাণ্ডে মুকুল রায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই স্ট্রিং অপারেশনের পিছনে হাত ছিল অভিষেকবাবুর খুড়শ্বশুর কেডি সিং-এর। অন্তত তেমনটাই ম্যাথু স্যামুয়েলের দাবি।
আরও পড়ুন: রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট, হুইলচেয়ারেই দুর্গরক্ষক মমতা
-
দেশ2 days ago
Vaccination Drive: এসে গেল তৃতীয় টিকা, স্পুটনিক ফাইভে অনুমোদন দিয়ে দিল কেন্দ্র
-
দেশ2 days ago
Sputnik V: এপ্রিলের শেষে ভারতের বাজারে চলে আসবে টিকা, জানাল রাশিয়া
-
প্রযুক্তি1 day ago
বাড়ির কাছাকাছি রেশন দোকান কোনটা, খুব সহজেই জেনে নিতে পারেন ‘মেরা রেশন’ মোবাইল অ্যাপ থেকে
-
রাজ্য1 day ago
Bengal Polls 2021: এ বার অনুব্রত মণ্ডলকে শোকজ নোটিশ নির্বাচন কমিশনের