পুরুষ-নির্ণীত, রাষ্ট্র-নির্দিষ্ট ব্যবস্থার ফাঁদে ইরম শর্মিলা যেন না পড়েন

0

ipsitaঈপ্সিতা সামন্ত

দীর্ঘ ষোলো বছরের অনশন ভাঙলেন ইরম শর্মিলা চানু। ২০০১ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০১৬ আগস্ট। এই বছরগুলো কোর্ট আর হাসপাতালের একলা ঘরে কেটেছে তাঁর। দাবি ছিল কালা কানুন ‘আফস্পা’ প্রত্যাহার। মণিপুরের মালম গণহত্যার পরে পরেই তাঁর অনশন শুরু হয়। এর পরে কেটে গেছে অনেকটা সময়। বদলেছে দিল্লির মসনদে থাকা রাজনীতির ধরনধারণ। কিন্তু মণিপুর এখনও উপদ্রুত এলাকা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। সেখানে এখনও রয়েছে সেনাবাহিনীর প্রবল ‘উপস্থিতি’। ২০১৬ সালেই নরেন্দ্র মোদী মণিপুরে যান। ইরমকে, তাঁর লড়াইকে স্বীকৃতি দিতে মোদী হয়ত তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন, এ রকম একটা  দুরাশা তাঁর ছিল। ইরম নিজেই এ কথা জানিয়েছিলেন। না, সে রকম কোনও ঘটনা ঘটেনি। তার কয়েক মাসের মধ্যেই শর্মিলা অনশন ভাঙলেন। শর্মিলা বলছেন, তিনি আর কোনও প্রতীকরূপী দেবী হয়ে থাকতে চান না। রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে তাঁর কিছু বঞ্চনাবোধ রয়ে গেছে। মুল স্রোতের রাজনীতিতে ফিরবেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীপদে আসীন হয়ে মণিপুরে গণতন্ত্র কায়েম করবেন। মূল স্রোতের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে তাঁর কোনও ভ্রম নেই। বরং তিনি বলছেন রাজনীতি যেমন নোংরা, তেমনি সমাজও। তাঁর কথা থেকেই স্পষ্ট, ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে এই নোংরা পাঁক পরিষ্কার করার কথাই তিনি বলছেন।

শর্মিলার সদিচ্ছা পূরণ হবে কি না, কিংবা দেশের দিল্লিকেন্দ্রিক রাজনীতির সমীকরণে আফস্পা প্রত্যাহার একটা সমাধান কি না আমরা জানি না। তবে সাধারণত সমাজবিজ্ঞানে সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য পথ অতীত এবং বর্তমানের হালচাল এবং টানাপোড়েন থেকেই উঠে আসে। কখনওই আকাশ থেকে পড়ে পাওয়া অলীক সুখী রাস্তা উন্মোচিত হবে না বা কোনও এক সকালে শুভবুদ্ধির বার্তা নিয়ে সুদূর দিল্লি থেকে খবর আসবে না, জানি। ইতিহাস রক্তাক্ত শ্রেণিসংগ্রামের খতিয়ান। ভারতের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের এখন যা ধরনধারণ, সেই প্রেক্ষিতে দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে শর্মিলা কতটুকু তাঁর লৌহচরিত্র বজায় রাখবেন এই নিয়ে প্রশ্ন জাগাটা মোটেও সাদাকালোয় বিভাজিত ভাবনার বহিঃপ্রকাশ নয়।

ভারতের উত্তরপূর্ব অংশ স্বকীয়তায় চরিত্রবান। এখানে কখনওই মূল ধারার হিন্দি সংস্কৃতি তার পেশি ফোলাতে পারেনি। বরং প্রায় জন্মলগ্ন থেকে উপদ্রুত এলাকা হিসেবে ঘোষিত এই অঞ্চল বারবার দিল্লির রাজনীতিকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলেছে। আমরা যারা দোআঁশলা হয়ে থাকি নিরাপত্তার প্রয়োজনে, ক্ষমতার অলিন্দে যাতায়াত করি দালালের মুখ নিয়ে, বারবার নাকচ করেছি অপর সংস্কৃতি-ভাবনা, তাদের কাছে উত্তরপূর্বের ‘উপদ্রুত’ এলাকা ধাঁধা-সম। আমরা আমাদের অবয়বে নিয়েছি হিন্দি সংস্কৃতির প্রলেপ। ব্রাহ্মণ্যবাদের আপাত আধিপত্যে আমরা খামচাখামচি করছি অবিরত। তখনই গুজরাত-সহ অন্য এলাকায় দলিতরা, উত্তরে কাশ্মীরিরা, উত্তরপূর্বের  ‘উপদ্রুত’রা এই সরকারের বিরুদ্ধে ফেটে পড়েছেন রাগে। সমষ্টিগত ভাবে সারি বেঁধেছেন তাঁরা। হাতে রেখেছেন হাত। গড়ে তুলছেন ব্যরিকেড। এখন চেষ্টা চলছে বিভিন্নতার গণতন্ত্র মুছে দেওয়ার। স্বাধীনতা মানে মাথায় গেঁথে দেওয়া হচ্ছে অল্প কয়েক জনের যা কিছু করার অবাধ পাসপোর্ট। রাষ্ট্র তার মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কোথাও নিয়েছে সমঝোতার পথ। কোথাও বা অবাধ্যদের হাত মুচড়ে ভেঙে দেওয়ার রাজনীতি। সংসদীয় গণতন্ত্রে থাকা রাজনৈতিক বর্ণালীর অন্য দলগুলির সুবিধাবাদ, সারহীন বিকিয়ে যাওয়া পথ প্রশস্ত করেছে এই রাস্তা।  

এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শর্মিলার নতুন পথ আমাদের হতাশ করে। অবশ্যই তার অনশন দেওয়ালে চিড় কাটতে পারছিল না। বা তার শান্তিপূর্ণ বিপ্লব। উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া, গ্রাম উজাড় করে পালিয়ে আসা সর্বস্বান্ত, ভীত ‘ভারতীয়’, তিনি মুসলমান হতে পারেন, হতে পারেন আদিবাসী, দলিত, খ্রিস্টান কিংবা নেহাতই জমিহীন কৃষক বা খেটে খাওয়া মানুষ, ধর্ষিতা নারী — এঁদের কী ভাবে পাঁক থেকে টেনে তুলবেন শর্মিলা? ভোটে দাঁড়ানো এবং মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার বাসনা কী ভাবে তিনি সফল করবেন বা কোন পথেই তা বাস্তবায়িত হবে, জানা নেই। তিনি পরিষ্কার করে কিছু বলেননি। তিনি তাঁর জৈবিক সত্তার কথা বার বার বলেছেন, সাধারণ মানুষের কাছে তিনি যে দেবী-সমা হয়ে যাচ্ছেন সেই ভাবনায় বার বার বিভিন্ন ইন্টারভিউতে তাঁকে ভীত হতে দেখা গেছে। মেনস্ট্রিম বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর এই ১৬ বছরের দীর্ঘ অনশন হারিয়ে যাওয়া সময় হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর এই দীর্ঘ কষ্ট যাপন ভারতীয় সিভিল সোসাইটির কাছে অবাক ঘটনা। মণিপুর এমন একটি রাজ্য যেখানে কম করে ৪২টি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। স্বায়ত্তশাসন নয়, পৃথক রাষ্ট্রই তাদের দাবি। শর্মিলা অনশন করেছিলেন রাষ্ট্রীয় হিংসা বন্ধ করার দাবিতে। এই বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ যে শর্মিলা অসফল হয়েছেন। তাঁর রাস্তার শেষে তিনি যে নিঃসীম শূন্যতা পেলেন তাতে আমরা যারপরনাই ব্যথিত। কিন্তু সব শেষে যেটা আমরা পেলাম শর্মিলা নামক লৌহমানবীর কাছে, সেটাও শূন্যই। শর্মিলা দেবী নন। কাউকে দেবী আসনে বসিয়ে তাঁর নিজস্বতা কেড়ে নেওয়ার পক্ষপাতী আমরা কেউই নই। কিন্তু তিনি অবশ্যই প্রতিবাদের এক অনন্য প্রতীক। তিনি নিজেই তা হিংসার বাতাবরণের বিরুদ্ধে কথা বলে, সক্রিয় হয়ে তা সৃষ্টি করেছেন। আজ এই  সময়ে দাঁড়িয়ে যদি কেউ পথনির্দেশ চান চানুর কাছে, তিনি কি তাঁর ‘হারিয়ে যাওয়া’ সময়ের দোহাই পেড়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার বার্তা দেবেন? আমরা মেয়েরা হারিয়ে যাই। একান্ত নীড়ের সোনার পাথরবাটি আমাদের হারিয়ে দেয়। লিব্যারালরা যতই বলুন চয়েসের কথা, জীবন জানে পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বেয়োনটের পুংলিঙ্গীয় আক্রমণ। জীবন জানে আমাদের মাথার ওপরে ‘গৃহ’ নামক ফ্যালাসির কথা। আমরা জানি শর্মিলা একই সাথে রাষ্ট্র এবং তার পুরুষতান্ত্রিক বহিরঙ্গকে রুখে ছিলেন এই ১৬ বছর ধরে। আজ আমরা তাঁর কাছে চাইব পুরুষ-নির্ণীত, রাষ্ট্র-নির্দিষ্ট কোনও ব্যবস্থার ফাঁদে তিনি না পড়ুন। হসপিটালের একা ঘর, রাইলস টিউবের বাঁধন শর্মিলাকে রুখতে পারেনি। রাষ্ট্র আজ চয়েসের নাম করে তাঁকে অন্য কোনও অবাস্তব সময়ে বেঁধে ফেলার আগেই সমষ্টির হাত ধরার দরকার তাঁর। এখনই তো শেকল ভাঙার সময়।

(লেখক শহিদ মাতঙ্গিনী হাজরা গভর্নমেন্ট কলেজ ফর উইমেন-এর স্ট্যাটিসটিক্স-এর শিক্ষক)

dailyhunt

খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল

বিজ্ঞাপন