
সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ ছবিটির একটি বিখ্যাত দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। পরেশবাবু পরশপাথর হাতে পেয়ে যাওয়ায় প্রচুর সোনা তৈরি করছেন। যে কারণে বাজারে সোনার দাম একেবারে পড়ে গিয়েছে। টুকরো টুকরো শটের মাধ্যমে সত্যজিৎ দেখালেন, যাঁরা বাড়িতে সোনা জমিয়ে রেখে সঞ্চয়কে নিরাপদ ভাবতেন তাঁদের কী দুর্দশা। কেউ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। কেউ বা উদ্ভ্রান্তর মতো সোনার দোকানের বাইরে চিৎকার করছেন। ঠিক এই অবস্থা না হলেও কাছাকাছি অবস্থা হয়েছিল নোট বাতিলের সময়। সে অভিজ্ঞতার কথা নতুন করে না বললেও চলবে। ঠিক সেই রকমই একটা পরিস্থিতি হয়তো হতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে। কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটা বিল পাশ করাতে চাইছে যাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা যে কোনো মুহূর্তে ব্যাঙ্কের ইকুইটিতে বদলে যেতে পারে। আপনি তখন প্রয়োজন থাকলেও সেই আমানত ভাঙাতে পারবেন না। বহু পরে সেই আমানতের দরুন অল্প কিছু বিমার টাকা পেতে পারেন, কিন্তু তা কখনোই জমা রাখা টাকার সমতুল্য হবে না।
ফাইনান্সিয়াল রেজোলিউশন অ্যান্ড ডিপোজিট ইন্সিওরেন্স বিল ২০১৭ বা এফআরডিআই বিলের আসল উদ্দেশ্য কি ব্যাঙ্কগুলিকে লিকুইডিশনের হাত থেকে বাঁচানো না ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের রাস্তা পরিষ্কার করা, তা ঘিরেই দানা বেঁধেছে সন্দেহ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের মুখ্য উদ্দেশ্য একটাই। সেটা হল, যে কর্পোরেট দুনিয়া আজ রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, তার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা। জনগণের ভালো হবে, এমন কোনো ভাবনা থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে, এমনটা কোনো মূর্খেও ভাববে না। যাঁরা এই সর্বব্যপী বেসরকারিকরণের ব্যাপারে ওকালতি করছেন তাঁদের বক্তব্য একটাই — মুনাফা যত বাড়বে ততই আর্থিক বাজার প্রসারিত হবে, আর তা হলেই আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে বাজারের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। মোদ্দা কথাটা হল, আর্থিক বাজার বাড়লে তার যে চুঁইয়ে পড়া অর্থনৈতিক ধারা তৈরি হবে তাতে দেশের মানুষ স্বস্তি পাবে। বস্তুত, এই এনটেইলমেন্ট থিওরি বা তত্ত্ব ছাড়া কর্পোরেট দুনিয়ার অতিরিক্ত মুনাফা তত্ত্বের পিছনে অন্য কোনো যুক্তি খাড়া করা যায় না।
কী ভাবে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ
এই বিলে কী ভাবে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করা হবে সে দিকে একটু নজর ফেরানো যাক। বিলে বলা হয়েছে, কোনো রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক লোকসানে চলতে শুরু করলে তার উন্নতির দাওয়াই দেওয়ার জন্য একটি সরকারি সংস্থা তৈরি করা হবে। সেই সংস্থাটির নাম হল রেজোলিউশন কর্পোরেশন। এই কর্পোরেশনে থাকবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি, ইন্সিওরেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (আইআরডিএআই), পেনশন ফান্ড রেগুলেটরি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (পিএফআরডিএ)-র প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া থাকবেন তিন জন সরকারি আমলা ও দু’ জন সরকার মনোনীত ব্যক্তি। বোঝাই যাচ্ছে এই সরকার মনোনীত ব্যক্তিরা আসলে হবেন কোনো কর্পোরেট সংস্থার প্রতিনিধি। তাঁরাই স্থির করবেন কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ভারতের সব চেয়ে বড় ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ককেও এই কর্পোরেশনের আওতায় আনা হয়েছে। বিলের খসড়ার ৪৫ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, স্টেট ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেও রেজোলিউশন কর্পোরেশনের প্রভাব খাটবে। অর্থাৎ স্টেট ব্যঙ্ক বিপদে পড়লে কী করতে হবে সে ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ করার দায় আর ব্যাঙ্কের নিজের হাতে থাকছে না। সেই সিদ্ধান্ত নেবে রেজিলিউশন কর্পোরেশন। ইচ্ছে করলে কর্পোরেশন ব্যাঙ্কের পরিচালন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে। আইনের ২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার সম্পূর্ণ অধিকার কর্পোরেশনের হাতে রয়েছে। আইনের ৩৮ নম্বর ধারার বক্তব্য, পরিস্থিতি বুঝে কর্পোরেশন ব্যাঙ্ককে রেগুলেট বা নিয়ন্ত্রণ করবে। অর্থাৎ ব্যাঙ্ক কার হাতে থাকবে তার সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রেজোলিউশন কর্পোরেশনকে দেওয়া হয়েছে। রেজোলিউশন কর্পোরেশন যদি মনে করে স্টেট ব্যাঙ্কের শেয়ার কোনো মার্কিন আর্থিক সংস্থার হাতে তুলে দিলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে তা হলে স্বচ্ছন্দে সেটা তারা করতে পারবে। এর জন্য কোনো আইন আদালতে আবেদন গ্রাহ্য হবে না। এফআরডিআই বিলের একটি মারাত্মক প্রবণতা হল দেশের আইন আদালতকে একেবারে গ্রাহ্য করার প্রবণতা। এতে পরিষ্কার বলা হেয়েছ ধুঁকতে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বিমা সংস্থার পুনরুজ্জীবনে কর্পোরেশন যে ভূমিকা নেবে সেটাই চূড়ান্ত। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেও আবেদন করা যাবে না। বস্তুত পক্ষে কর্পোরেশনের ক্ষমতাকে ঈশ্বরের সমতুল্য করে দেওয়া হয়েছে এই বিলে।
কোন কোন সংস্থা কর্পোরেশনের আওতায় আসতে পারবে তারও বিবরণ বিলে পরিষ্কার করে দেওয়া আছে। বলা হয়েছে, কয়েকটি সংস্থাকে সিস্টেমেটিকালি ইমপর্ট্যান্ট ইনস্টিটিউটের মর্যাদা দেওয়া হবে। এই সংস্থাগুলির ক্ষেত্রেই কর্পোরেশনের ক্ষমতা প্রযোজ্য। একটি বেসরকারি ও একটি যৌথ উদ্যোগে চলা ব্যাঙ্ককে ইতিমধ্যেই এই আওতায় আনা হয়েছে সেগুলি হল যথাক্রমে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক ও এইচএফডিসি। এ ছাড়া স্টেট ব্যাঙ্ককেও এসআইএফআই সংস্থার আওতায় আনা হয়েছে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পাশাপাশি স্টেট ব্যাঙ্ককেও দেউলিয়া ঘোষণা করে সেখানে বেসরকারিকরণ করার একটা বড়ো উদ্যোগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে।
‘বেল ইন’কী
ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করার পথে সব চেয়ে চিন্তার পদক্ষেপ হল সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা লোপাট করে দেওয়া। আগেই বলেছি, বিলে বলা হয়েছে, ব্যাঙ্ক দুরবস্থায় পড়লে তাকে ‘বেল ইন’ করা হবে। অর্থাৎ নতুন পুঁজি জোগাড় করে তাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু নতুন পুঁজি আসবে কোথা থেকে? ধুঁকতে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার তো আমি আপনি কিনব না। একমাত্র ব্যাঙ্কের সম্পদ বেচার গ্যারান্টি পেলে তবেই আমরা পুঁজি বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে পারি। সে দিকে লক্ষ রেখেই সাধারণ মানুষের আমানতকে ইকুইটি শেয়ার বা ব্যাঙ্কের পুঁজিতে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ফিক্সড ডিপোজিট বা বন্ডের টাকা চাইলেই আর ফেরত পাওয়া যাবে না। সেগুলি সবই তামাদি হয়ে যাবে। ব্যাঙ্ক সেই আমানতের পুরোপুরি মালিক বনে যাবে। এত দিন পর্যন্ত ব্যাঙ্কে জমা থাকা আমানতের গ্যারান্টি দিত ডিপোজিট ইন্সিওরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশন বা ডিআইসিজিসি। এই সংস্থাটিকে পুরোপুরি তুলে দেওয়ার নিদান হাঁকা হয়েছে। ফলে আপনার আমার আমানতের ওপর আর কোনো বিমা গ্যারান্টি রইল না। কোনো কারণে ব্যাঙ্ক ফেল করে গেলে টাকা ফেরত তো হবেই না, এমনকি ভবিষ্যতে আমানতের দরুন করা বিমার টাকাও হাতে না পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য বলছে, আমানতের ওপর সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিমার টাকা পাওয়া যাতে পারে। কিন্তু ডিআইসিজিসি-ই যদি না থাকে তা হলে আমানতের গ্যারান্টি দেবে কে? বোঝাই যাচ্ছে নিছক ছেলেভোলানো কথা বলছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই সেই ‘পরশপাথর’ ছবিতে দেখানো দৃশ্যের মতো ব্যাঙ্ক ফেল করলে মাথায় ঘোল ঢেলে রাস্তায় বসে থাকা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না।
ব্যাঙ্কের অকার্যকরী সম্পদ
ইতিমধ্যে প্রকাশিত তথ্যেই স্পষ্ট, অনাদায়ী ঋণের বাড়বাড়ন্তর জন্য ব্যাঙ্কগুলির এই হাল হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ফিনান্সিয়াল স্টেবিলিটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ব্যাঙ্কের অকার্যকরী সম্পদ বা এনপিএ-র ৮৮.৪ শতাংশই বড়ো বড়ো ঋণগ্রহিতাদের জন্য। তাদের ঋণের পরিমাণ ৫ লক্ষ কোটি টাকার ওপর। আবার শীর্ষ ১২ জন ঋণগ্রহিতা ঋণ করেছেন সব চেয়ে বেশি — তা মোট অনাদায়ী সম্পদের ২৫ শতাংশ। এই মুহূর্তে বাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ১১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে এই টাকা ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই ধরনের অনাদায়ী ঋণের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ভূমিকা কিন্তু খুবই সামান্য। ৬০০টি জেলায় ৫৬টির বেশি এ ধরনের ব্যাঙ্ক ২৩ হাজার শাখার মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া আছে ৩৭০টি কেন্দ্রীয় কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক যার মোট শাখার পরিমাণ ১৪ হাজারের মতো। তা ছাড়াও আছে দেশ জুড়ে ৯৩ হাজার প্রাথমিক কৃষি সমবায় প্রতিষ্ঠান যেগুলি কৃষকদের ঋণ দিয়ে থাকে। এগুলির কাজকর্মে কিন্তু তেমন কোনো গাফিলতি চোখে পড়ে না। পাশাপাশি জীবন বিমা কর্পোরেশন বিরাট আর্থিক বাজার দখল করে রয়েছে। দ্বাদশ অর্থ কমিশনকে এলআইসি দিয়েছিল ১৪ লক্ষ ২৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। একাদশ পরিকল্পনার সময়ের যা প্রায় দ্বিগুণ। এরা কিন্তু কেউই লোকসানে চলছে না। বছরের পর বছর কৃষকরা উৎপাদনে মার খাওয়া সত্ত্বেও কৃষি সমবায়গুলি দেশ জুড়ে লাভ করছে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে মূল গলদটা কোথায়। আসলে বড়ো বড়ো শিল্পপতি সরকার ও ব্যাঙ্কের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে সাধারণ মানুষের বহু টাকা লোপাট করে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার কোনো দিশা চোখে পড়ছে না। বরং সরকার এখন চাইছে সাধারণ মানুষের লোকসানের বোঝা সাধারণ মানুষের ঘাড় দিয়েই আদায় করে নিতে। বড়ো বড়ো শিল্পপতির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার জন্য নতুন দেউলিয়া আইন হয়েছে বটে, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই আইনে কী ভাবে শিল্পপতিদের বাঁচানো যায় সেই ফিকিরই বেশি রয়েছে। এ ছাড়া দেশে রয়েছে ভারতীয় দণ্ডবিধি, ফৌজদারি আইন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যাঁরা দেশের কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন তাঁদের জেলে পোরার জন্য একবারও সেই আইন প্রয়োগ করা হয়নি।