তিনি কী এবং কেন বোঝার চেষ্টায় নেশাগ্রস্ত হলে সামনের অনেক দরজার পাল্লা খুলে যাবে। কালীসাধক কৃষ্ণানন্দ, রামপ্রসাদ, স্বামী বিবেকানন্দ, নিবেদিতারা ঠিক যে ভাবে বুঝেছেন। লিখলেন অরুণাভ গুপ্ত
ও বাঁশি কেন…
ধারাপাত। কানের ফুটোয় স্বরলিপি, অনেক ‘ডু’ অনেক ‘ডোন্ট’, মহাসংগীতের ছাত্র-ছাত্রী আমরা। মুখস্থ হলেও প্রম্পটারের দরকারে প্রম্পটিং চলছে। কেমন আছেন? বিন্দাস। ওজন বেড়ে গেছে, হবে না কেন ডিসিপ্লিনড লাইফ, ডোন্টস-এর বাঁশিতে হাইপ্রোটিন ডায়েট, যেমন আয় তেমন ব্যয়ের মানানসই ইমিউনিটি। ‘বিলিভ মি’ আনন্দ – উপভোক্তা কিন্তু হারিয়ে যায়নি, বরং বেহিসেবির বদলে মসৃণ হিসেবি জীবন। মূলে হল শক্তির আরাধনা এবং মাতৃতান্ত্রিক অবশ্যই। যিনি সুষম বণ্টনে সুসম রেখেছেন সকলকে। বছরান্তে শক্তিদেবী মা কালী বাস্তবের মাটিতে পা রাখেন। তাঁর আশীর্বাদ স্পর্শে মানুষ লুপ্ত শক্তি ফিরে পায়। জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার রসদ মেলে। ‘অল ওয়েজ লিড টু দ্য সেম গোল’ হলেও মা কালী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক ধরাছোঁয়ার বাইরে মাপহীন শক্তি। কোনো দেব-দেবীর সাধ্য নেই তাঁকে অস্বীকার করার, রিমোট তাঁর হাতে, তিনি কী এবং কেন বোঝার চেষ্টায় নেশাগ্রস্ত হলে সামনের অনেক দরজার পাল্লা খুলে যাবে। মা কালী সর্বত্রগামী – মহিমাময়ী রূপে প্রতিভাত। যে মা আদ্যাশক্তি লীলাময়ী, সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় করছেন।
মায়ের কথা
ভারতবর্ষে মা কালীর যে রূপ আমরা দেখি তা জগদম্বার। বিশ্বপ্রসবিনী, জগৎপালিনী আবার একাধারে সৃষ্টি সংহারিণী মহাশক্তি। কথিত, কালীসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মায়ের বিশ্ববন্দিত এবং পূজিত মূর্তি স্বহস্তে তৈরি করার পর পুজো করেন। অনেকে তা-ই মনে করেন। সাধক কৃষ্ণানন্দ যখন কোন মায়ের মূর্তিতে পুজো হবে চিন্তায় চিন্তিত, তখন মা স্বয়ং আদেশ দিলেন – নিশাবসানে যে নারীমূর্তি যে রূপে ও ভঙ্গিতে দৃষ্টিপথে আসবে, তাই হবে সাধকজনের হৃদয় আকাঙ্ক্ষিত মূর্তি। পরের দিন কাকভোরে গঙ্গাস্নানের পথে কৃষ্ণানন্দ শ্যামবর্ণা মায়ের সাক্ষাৎ পেলেন।
মায়ের মূর্তির দিব্য আভাস পেলেন সাধক। শক্তি-আরাধনায় প্রতিমা পুজোর সূচনা হল এবং গ্রামেগঞ্জে-শহরে মায়ের পুজো ছড়িয়ে পড়ল। নবদ্বীপের আগমেশ্বরীতলা সেই পুণ্যস্মৃতিতে ধন্য হয়ে আছে। এই সাধনার ধারাতেই পরর্তীকালে হালিশহরের সাধক রামপ্রসাদ সেন মায়ের পূজার্চনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
মায়ের ধ্যানমূর্তি এক দিকে সংহারময় কালচিত্র, অন্য দিকে তাঁর উন্মুক্ত বক্ষ সৃষ্টিপালনের প্রতীক। করালবদনা – মহাকাল এই বিপুল বিশ্বকে ধ্বংস করেন। সেই মহাকালকেও যিনি গ্রাস করেন, তিনি কালী। কালী সমস্ত দেবময়ী। প্রতিটি দেবতাই সূক্ষ্ম রূপে কালীর মধ্যে নিহিত আছেন। ভালো-মন্দ মেশানো জগৎ তাঁরই সৃষ্টি, তাঁরই বিভূতি। যখন তিনি এই সব কার্য করছেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি আমরা। শিবের বুকে চরণ রাখার অর্থ হল মা শিবের সঙ্গে অভিন্ন। কালী মুক্তকেশী। কেশ বলতে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরকে বোঝায়, কালী তাঁদেরও মুক্তি প্রদান করেন, তাই মুক্তকেশী। মায়ের কালো কেশ যেন মৃত্যুর যবনিকা – জীবনকে পরকাল সম্পর্কে অচেতন রাখে।
ত্রিনয়না… রামপ্রসাদের উপলব্ধিতে ‘মায়ের আছে তিনটি নয়ন/চন্দ্র, সূর্য আর হুতাশন’। এই ত্রিনয়নে তিনি অখিল বিশ্বের ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান – ত্রিকালকেই প্রত্যক্ষ করেন।
নিবেদিতা রচিত ‘Kali The Mother’-এ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, জীবন-মৃত্যুরূপ রূঢ় সত্যের প্রতীক তিনি। তাই মা নগ্না, দিগ্বসনা। ‘হিন্দু রিভিউ’-এর সম্পাদকের লেখায় জানা যায় – বোসপাড়া লেনে নিবেদিতার বাড়িতে বসে তিনি চা খাচ্ছেন। আকাশ কালো করে কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হল। সোঁ-সোঁ আওয়াজে সে কী তর্জন-গর্জন। নিবেদিতা সমাহিত, শুনছেন ঝড়ের গর্জন, প্রকৃতির রুদ্র মূর্তি অপলকে দেখছেন, অস্ফুটে বলেছেন- ‘কালী’।…
নরেন্দ্রনাথ, সংক্ষেপে নরেন, পরবর্তী কালে স্বামী বিবেকানন্দ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশে নরেন ‘মা’-এর কাছ নিজের জন্য চাইতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলে চেয়েছেন অন্য কিছু। ঠাকুর মিটিমিটি হেসেছেন। শেষমেশ হাল ছেড়ে ওই রাস্তায় ধ্যান রাখেননি। হলেন বিশ্ববন্দিত স্বামীজি। সেই স্বামী বিবেকানন্দ মহা বৈদান্তিক হয়েও ঈশ্বরের এই শক্তিরূপিণী অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেননি। তিনি বলতেন, “দেখো, আমি বিশ্বাস না করে পারি না, কোথাও একটা মহাশক্তি আছে, যা নিজেকে নারী প্রকৃতি বলে অনুভব করে- ‘কালী’ বা ‘মা’ নামে নিজেকে আখ্যাত করে”। এমনকি তিনি ‘কালী’ গানে মাতোয়ারাও হয়েছেন।
আমরা অসংখ্য ভারতীয় মায়ের কাছে কিচ্ছুটি চাইব না। তিনি লীলাময়ী। সন্তানদের খেলান, আমরা খেলি। চলে গেলে যেন বিশ্বাস রাখি শক্তিমন্ত্র বেঁটে দিয়েছেন। দেশের নাম ভারতবর্ষ – মুনি-ঋষির সাধনার পীঠস্থান, আলো-পথ দুই মিলবে।
আরও পড়ুন: যেখানে মায়ের দু’টি পায়ের ছাপ পূজিত হয় জঙ্গলি কালী হিসাবে
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।