‘মেজদি’র গল্পে বিজয় দিবস

0
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন। ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ।

বীথি কর

রাতের বিছানা বরাবর আমার মেজদি (ঠাকুমা) করতেন। আমি জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি তিনি আমাকে সাথে নিয়ে ঘুমোন। তার অবশ্য একটা কারণ আছে। আমি ঠাকুমার কাছে গল্প শুনতে ভালোবাসতাম। খুব ছোটো, তবুও আমার পুরোনো গল্প বারবার শুনতে ভালো লাগত। বিশেষ করে ১৯৭০-১৯৭১-এর গল্প। বাংলাদেশ তখন উত্তাল। পাক বাহিনীর কাছে প্রায় বন্দি আমার দেশ। দেশের কিছু সুবিধাবাদী মানুষ নিজেদের নাম লিখিয়েছিলেন তাঁদের কাছে। ঠাকুমা বলতেন, এই মানুষগুলো ‘রাজাকার’। তাঁদের প্রধান কাজ ছিল দেশের গুপ্ত সব খবর সেই বাহিনীর কান অবধি পৌঁছে দেওয়া। গল্পের টুকরো কথাগুলো আমার এখনও মনে আছে। মেজদির কাছ থেকে শোনা কিছু কথা আমার মনে এখনও দাগ কেটে আছে।

আমাদের বাড়িটা ছিল লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির। মানে দেবোত্তর সম্পত্তি। শুনেছি বাড়ির যিনি মালিক তিনি আমার বড়ো ঠাকুরদাকে সেই বাড়ির উকিল হিসেবে বাস করার অধিকার দিয়েছিলেন পরিবার-সহ। সেই থেকেই বংশ পরম্পরায় বাস আমাদের। ১৯৭০ – চার পাশে ভয়াবহ পরিস্থিতি। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক মন্দির। দলে দলে মানুষ লাশের ওপর দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে নিজের প্রাণটুকু নিয়ে একটু আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু কোথায়? কোথায় লুকিয়ে রাখবে নিজের শরীরটা? মন্দির-বাড়ি ছেড়ে, নারায়ণ-শিলাকে মন্দিরের একটি মাত্র মানুষের ভরসায় রেখে যে যার মতো পাড়ি দিয়েছে গ্রামে গ্রামে। মেজদির কাছে শুনেছি, পাক সেনারা জলে ভয় পেত খুব। আর বাংলাদেশ তো নদীমাতৃক দেশ।

মাঠে মাঠে ছেলেপুলেদের বিকেলের খেলা বন্ধ, স্কুল-কলেজে তালার ওপর ধুলো জমেছে, কন্যাসন্তানের মুখে কালি মাখিয়ে ঘরে ধানের গোলায় লুকিয়ে রাখা হচ্ছে,  সন্তানের চিৎকার বন্ধ করার জন্য দুধের শুকনো বোঁটায় ঠোঁট চেপে ধরে রাখতে রাখতে নিস্তেজ শীতল দেহ মায়ের কোলে চিরনিদ্রায়, বাবার-ভাইয়ের হাত-পা বেঁধে চোখের সামনে উলঙ্গ মেয়ের শরীরে দাঁতের কামড়ের দাগ – পৈশাচিক খিদে মেটানোর উল্লাসের চিৎকার ছাপিয়ে যেত বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার চিৎকারকে। বন্দুকের নলায় বারুদ ভরে চলল গণহত্যা। চোখের সামনে স্থবির হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দেহ। অত্যাচার তুঙ্গে।

মাতৃভাষা বাংলা – এই যুদ্ধে শামিল হল তরতাজা যুবকের দল। নাম হল ‘মুক্তিবাহিনী’! জীবনের বদলে দেশ! টগবগ করে ফুটতে লাগল রক্ত। ঘরে ঘরে মেয়েরা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল নিজের সন্তানকে। চার পাশে যেন প্রতিধ্বনিত হল – যা, যদি ফিরে আসিস তা হলে দেশকে স্বাধীন করে ফিরবে নতুবা শহিদ হয়ে। গর্জে উঠল আপামর বাঙালি। ঘরে ঘরে তৈরি হল দুর্গ। জেদ আর প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে দলে দলে যোগ দিল বাড়ির পুরুষরা। মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। নিজেদের শরীরের বিনিময়ে পাক বাহিনীর কাছ থেকে জোগাড় করেছে গোপন ষড়যন্ত্রের তথ্য। পাচার হয়ে গেল রাতের মধ্যে কথা। ভেস্তে দিল সকল কূটনৈতিক চাল। একের পর এক হার। উৎসর্গ হয়ে গেল লাখে লাখে জীবিত আর মৃতদেহ।

bangladesh bijoy dibosh 1 16.12

কী অসম্ভব সাহস আর মনোবল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁদের ওপর – সে কথা বারবার শুনতে শুনতে আমার বুক কেঁপে উঠত রাতের অন্ধকারে। মেজদি বলত, ভয় পাচ্ছিস নাকি? আমি বলতাম, না! শুনেছি, বাবা লুকিয়ে চলে গেছিল মুক্তিবাহিনীতে। আমার দাদু বেঁচে ছিলেন না। বাবাকে না-পাওয়ার কষ্ট আমার ঠাকুমার হয়নি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ছেলে একদিন ফিরে আসবেই। আমার বাবা ফিরে এসেছিলেন স্বাধীনতার পর।

শুনেছি খাবারের জোগান প্রায় বন্ধ। যুদ্ধ চলছে। রাতের পর রাত গুলির আওয়াজে ঘুম আসত না কারও। ঘর অন্ধকার করে মরার মতো পড়ে থাকত মানুষ। নদী-নালা-খাল থেকে কলমি শাক তুলে সেদ্ধ করে দিনের পর দিন কেটেছে। চড়া দামে বিক্রি হতে শুরু করল চাল, ডাল ও অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। কালোবাজারি তখনও দাসত্ব করতে রাজি। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মানুষগুলো শুধুমাত্র নিজের দেশের কথা ভেবে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে, স্বাধীনতার দাবিতে রক্তের ফোয়ারা তুলেছিল ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে! ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সব মানুষ দলে দলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে যায় দীর্ঘ সময় ধরে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সেনাদের গুলিতে শুরু হয়ে গেল গণহত্যা।

ইতিহাস কথা বলে। মেজদি বলেন, ইন্দিরা গান্ধীর জন্য বাংলাদেশের মানুষ আলোর মুখ দেখেন। দু’ হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তিনি। পাঠিয়ে দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। যৌথ চেষ্টায় দিনের পর দিন যুদ্ধ চলতে থাকে। অবশেষে আসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এই দিনে পাক সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

“বুঝলি, সে এক দিন গেছে। কী ভয়ংকর! বুকের মধ্যে সারাক্ষণ শুধু বুটের আওয়াজ আর নাকে বারুদের গন্ধ। নিজেদের কাঁসা-পেতলের বাসন আমরা সবাই দু’ তলার কুয়োর মধ্যে ফেলে চলে গেছিলাম যে যে দিকে পারি। জানিস, ফিরে এসে আমরা কেউ পাইনি। আমার বিয়ের বাসন ছিল ওখানে!”

মেজদি যত বার এই গল্পগুলো করতেন তত বার দেখতাম তাঁর সাদা থান ভিজে যেত ধীরে ধীরে। সবার শেষে বলতেন, “সাহসী থাকবি সারা জীবন। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবি না। নিজের যা, সেটা কখনও কাউকে নিতে দিবি না। যদি কেউ কেড়ে নিতে আসে তবে যুদ্ধ করবি মুক্তিবাহিনীর মতো”!

আমি আজও বিশ্বাস করি, তিনি যা বলে গিয়েছিলেন তা শুধু মাত্র নীতিবাক্য নয়, জীবনের মূল বাক্য হয়ে পথ চলতে শিখিয়েছে।

আরও পড়ুন

সুধীর চক্রবর্তী কথায়, ইন্দিরা দেবীর স্মৃতিতে ‘ইন্দিরা’র নিবেদন ‘দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে দেওয়া’

বিজ্ঞাপন