বিশেষ সংবাদদাতা: কথায় বলে, রাজনীতিতে সবই সম্ভব। বিপরীতে, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। ত্রিপুরা পুরভোটের আবহে এ বার সে কথাই নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
আগামী ২৮ নভেম্বর ভাগ্য নির্ধারণ হতে চলেছে আগরতলা পুরসভা-সহ ত্রিপুরার ১৪টি পুরসভা এবং ছ’টি নগর পঞ্চায়েত মিলিয়ে মোট ২০টি স্থানীয় নাগরিক সংস্থার নির্বাচনে কমপক্ষে ৮২১ জন প্রার্থীর। সেদিনই জানা যাবে, রাজ্যের শাসক দল বিজেপি আধিপত্য বজায় রাখতে পারছে, না কি সেখানে ভাগ বসাতে সফল হচ্ছে দুই অন্যতম বিরোধী সিপিএম, তৃণমূল। সে ক্ষেত্রে যদি ভোটের ফল কোথাও কোথাও ত্রিশঙ্কু হয় তা হলে বিরোধীরা জোট বাঁধবে কি? বিজেপি-কে রুখতে এক ছাতার তলায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে কি সিপিএম-তৃণমূলের? সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ সেই প্রশ্নই উসকে দিয়েছে ত্রিপুরার রাজ্য-রাজনীতিতে।
পুরভোটের প্রচারে বিজেপির বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগে এক সুর শোনা গিয়েছে সিপিএম-তৃণমূলের গলায়। এমনকী সিপিএম পার্টি অফিসে হামলার ঘটনায় যেমন তৃণমূল নেতৃত্বকে সরব হতে শোনা গিয়েছে, তেমনই তৃণমূল নেতৃত্বের উপর শাসকদলের ‘প্রতিহিংসা’র ঘটনায় প্রেস বিবৃতি পর্যন্ত দিতে দেখা গিয়েছে সিপিএমকে। সম্প্রতি, ত্রিপুরায় বাংলার তৃণমূল যুব নেত্রী সায়নী ঘোষকে গ্রেফতারের ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছিল দেশ জুড়ে। সেই ঘটনায় তৃণমূলের অভিযোগকে সমর্থন করে ত্রিপুরা সিপিএমের তরফে রাখাল মজুমদার একটি প্রেস বিবৃতি জারি করেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে ওই প্রেস বিবৃতিতে তিনি লিখেছিলেন, “এই রাজ্যের ঐতিহ্য, সুনাম এবং গর্বের যা কিছু অবশেষ রয়েছে, তাও শেষ করে দিতে চাইছে বিজেপি। এই ধ্বংসলীলা রুখতেই হবে। আসুন, সবাই মিলে একসাথে পথে নামুন”।
এই “সবাই মিলে একসাথে পথে নামা”র আহ্বানই সিপিএম-তৃণমূলের কাছাকাছি আসার ইঙ্গিত দিয়ে রাখছে। বিশেষ করে যখন ২০২৩-এ রয়েছে রাজ্যের বিধানসভা ভোট। গত বিধানসভা ভোটে ক্ষমতা খোয়ানোর ধাক্কা এখনও সে ভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি সিপিএম। রাজনৈতিক মহলের মতে, রাজ্য-রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখাই এখন সব চেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ বামেদের। সে ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিকটি হল, ২৫ বছরের ক্ষমতা হাতছাড়া হলেও নিজেদের সাংগঠনিক পরিকাঠামো এখনও বজায় রয়েছে। ফলে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে দরকার এখন শক্তির।
প্রশ্ন উঠছে, সিপিএম-কে সেই শক্তির জোগান দিতে পারে কি তৃণমূল। পুরভোটের প্রচারে সেটাই বার বার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রচারে বিজেপি-কে সমানে এবং সামনে থেকে টক্কর দিয়েছে তৃণমূল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পুরভোটকে যেন একটা মরণপণ লড়াই হিসেবে ধরে নিয়েছিল বিজেপি-তৃণমূল।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সিপিএমের অন্দরে অন্যতম চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল না বিজেপি? কে বড়ো শত্রু? সেই প্রশ্নের জবাব স্পষ্ট হওয়ার আগেই ত্রিপুরার একাধিক বাম নেতা যে বিজেপির শাসনের অবসান ঘটাতে তৃণমূল কংগ্রেসকে সাহায্যের জন্য প্রস্তুত, তার ইঙ্গিতও মিলেছে। অন্য দিকে, ক’দিন আগেও পুরভোটের প্রচারে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষকে বলতে শোনা যায়, লাল ঝান্ডা নিয়ে মিছিল করুন কিন্তু ভোট দিন জোড়া ফুলে।
এ বারের নির্বাচনে এক মাত্র বিজেপি ছাড়া আর কোনো দল সবক’টি আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। আগরতলা পুরসভার ৫১টি আসন-সহ সব মিলিয়ে ৩৩৪টি আসনের নির্বাচনে প্রত্যেকটিতেই প্রার্থী দিয়েছিল রাজ্যের শাসক দল বিজেপি। অন্য দিকে, বিরোধী দলগুলির মধ্যে ২২৫টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল সিপিএম-সহ বামদলগুলো ও দিকে, ১২৪টি আসনে মনোনয়ন জমা করেছিল পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল। এ ক্ষেত্রেও শাসকদল বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন দাখিলে একযোগে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল সিপিএম-তৃণমূল।
এ দিকে, পশ্চিমবঙ্গের শেষ বিধানসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, জেপি নড্ডার বিজেপি-কে রুখে দিতে সফল হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরই তাঁর প্রথম নজর পড়ে ত্রিপুরায়। এখন যা অসম, মেঘালয় হয়ে গোয়ায় গিয়ে ঠেকেছে। তবে ত্রিপুরা নিয়ে তৃণমূলের অন্য রণকৌশল থাকাটাই স্বাভাবিক। বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার আগে ত্রিপুরার বেশ কয়েকদন বিধায়কের সঙ্গে মুকুল রায়ের সুম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কংগ্রেস থেকে বেশ কয়েকজনকে ভাঙিয়ে আনতেও সফল হয়েছিলেন তিনি। যদিও সেটা ছিল সাময়িক। কিন্তু ত্রিপুরা নিয়ে তৃণমূলের একটাই সমস্যা, সেটা হল রাজ্যের সঙ্গে জুতসই একটা মুখের অভাব। পশ্চিমবঙ্গের নেতানেত্রী দিয়ে সেটা পূরণ করা সম্ভব হবে না বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। ফলে এ মুহূর্তে এমন কোনো মুখকে তুলে ধরা দরকার, যাকে দেখে ত্রিপুরার মানুষ “নির্দ্বিধায়” নিজের ভোটটা তৃণমূলকে দিতে পারেন।
কার্যত, পুরভোটের ফলাফল ত্রিপুরার রাজ্য-রাজনীতিতেও একটা আমূল পরিবর্তন এনে দিতে পারে। সংখ্যাতত্ত্ব তো রয়েইছে, ভবিষ্যতের চাহিদা মেনে ত্রিপুরায় আরও কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা রয়েছে সিপিএম-তৃণমূলের। রাজনৈতিক মহলের মতে, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল-সিপিএম সম্পর্কের চেনা ছবি!
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।