ছোটন দত্তগুপ্ত
ডেঙ্গির ভয়াবহতায় নগরজীবন থেকে মফস্সল আজ আতঙ্কিত। এর প্রতিকারের জন্য পুরসভা, সরকার, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সচেতন মানুষ প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে, তবু এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। ডেঙ্গির জটিলতা বাড়ছে। বর্তমানে ডেঙ্গির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়। এখন এক থেকে তিন বছর অন্তর ডেঙ্গি জ্বর ব্যাপক আকারে দেখা দিচ্ছে। আগে যা আট থেকে দশ বছর অন্তর দেখা দিত। এই জ্বর দিনে দিনে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।
ডেঙ্গি রোগের যে হেতু নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই তাই মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটতে হবে। পুরসভাগুলোর ব্লিচিং পাউডার আর ধোঁয়া, কীটনাশক ছড়ানোর মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিগুলো সে ভাবে কাজে আসছে না। ধোঁয়াতে মশা-মাছি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়, মরে না। বরং ধোঁয়া দূষণ বাড়ায়। ব্লিচিং পাউডারে মশা-মাছির লার্ভা খাওয়া ব্যাঙ উদ্বাস্তু হয়ে অস্তিত্বের সংকটে বিলীন হচ্ছে। কোনো পদ্ধতিই মশার লার্ভা ধ্বংস করার উপযুক্ত নয়। মশার লার্ভা নষ্ট করতে না পারলে মশা-মাছি বাহিত রোগের কবল থেকে আমরা বাঁচতে পারব না।
বর্তমানে নগরসভ্যতার জন্য জলাভূমি ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব-উন্নয়ন হচ্ছে না। চকচকে দেখানোর জন্য পুরসভাগুলো নর্দমা ঢেকে দিচ্ছে। রাস্তা ও নর্দমার মাঝে আগে একটু মাটি থাকত, এখন তা-ও সিমেন্টে লেপে দেওয়া হচ্ছে। কেউ যাতে মাটিতে পা রেখে না হাঁটে। যে পুকুরগুলো বেঁচে আছে, তার পাড়গুলো সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হচ্ছে (এর ফলে বহু উভচর প্রাণী অস্তিত্বের সংকটে, যেমন ব্যাঙ-শামুক ইত্যাদি)। এই সব দূষণকেন্দ্রিক উন্নয়ন যত বাড়বে, তত ট্রপিক্যাল রোগের (ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া) প্রাদুর্ভাব প্রকট হবে। এর মোকাবিলা করতে না পারলে, ১৭৭৯-৮০-তে এশিয়া-আফ্রিকা ও উন্নত আমেরিকায় যে মহামারি দেখা দিয়েছিল, তা ফিরে আসবে।
এই মহামারির সম্ভাবনা রুখতে মাশা-মাছির উৎসে ঘা মারা একান্ত প্রয়োজন। এদের বংশবৃদ্ধি বা লার্ভা বিনষ্ট করার কাজে হাত দিতে হবে। আমরা এই লার্ভা বিনষ্ট করার বিষয়ে বা রোগ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হলে কী ভাবে চেষ্টা করা উচিত সে ব্যাপারে কয়েকটি জিনিসের ওপর আলোকপাত করছি।
ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য হাঁস, ব্যাঙ ও গাপ্পি মাছের আস্তানা (যেখানে ঢাকনাহীন নর্দমা সেখানে গাপ্পি মাছ ছাড়তে হবে) বানাতে হবে। ভাবছেন আপনার ফ্ল্যাটের ১০/১০ ফুট ঘরে নড়ার জায়গাই নেই, সেখানে হাঁস-ব্যাঙ, কী বলছে! মাথা খারাপ নাকি! না, মাথা ঠিকই আছে। শুনুন তবে, আপনাদের পাঁচ কাঠার ওপর ওঠা ফ্ল্যাটের নীচে ১০ স্কোয়ার ফুটের (২ ফুট গভীর, বড়ো কমপ্লেক্স হলে বড়ো জলাশয়) একটি সুন্দর জলাশয় করুন। সেখানে একটা-দুটো হাঁস রেখে দিন। একটা হাঁসের ঘর ও ব্যাঙের ঘর করে দিন। যদি নীচের জায়গা ঘেরা থাকে, তা হলে একটি হাঁস নিজেই ঘুরে ঘুরে প্রতি দিন প্রায় ৮০ হাজার মশার লার্ভা খেয়ে নেবে খেতে পারে। ভাবছেন, ওইটুকু জলে হাঁস! আপনার সুন্দর ফ্ল্যাটের পরিবেশ নষ্ট করবে।
এই প্রসঙ্গে বলি, আমরা যে ধরনের হাঁস রাখতে বলছি, তা হল খাঁকি ক্যাম্পবেল। এই হাঁস ভারতীয় রানার ও দেশীয় হাঁসের সংমিশ্রণে তৈরি (অতীতের বাংলার গভর্নরের স্ত্রী মিসেস ক্যাম্পবেল এই হাঁস তৈরি করেন, তাঁর নামেই এই হাঁসের নামকরণ)। এই খাঁকি ক্যাম্পবেল হাঁস জল ছাড়াও পালন করা যায় এবং এর ডিমের পরিমাণও বেশি। এরা বিষ্ঠা দিয়ে নোংরা করবে ভাবছেন! এটা আপনাদের সাদা চোখে নোংরা লাগলেও আসলে তা খুব ভালো জৈব সার। কেয়ারটেকারকে বলে রাখুন, হাঁসের এই বিষ্ঠা ঝাঁট দিয়ে সংগ্রহ করে গাছের গোড়ায় দিতে। হাঁস বিভিন্ন মশা-মাছির রোগ থেকে যেমন বাঁচাবে তেমনই হাঁস থেকে জৈব ডিমও পাওয়া যাবে। হাঁস সর্বভূক। বর্তমান বিশ্বে বাড়ির বর্জ্য (গৃহস্থের সবজির খোসা, মাছ-মাংসের ফেলে দেওয়া অংশ) ফেলা বড়ো সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে হাঁসের ভূমিকা অনস্বীকার্য। হাঁস সবই খায়। কথিত আছে, হাঁস কোনো খাবার গালে তুলে এক বার সূর্যের দিকে তাকালেই সব হজম হয়ে যায়।
আজকের শৈশব যখন ‘নীল তিমি’ জাতীয় অসুস্থ সংস্কৃতিতে আক্রান্ত, সন্তানকে গড়ে তোলার চিন্তায় মা-বাবারা যখন উদ্বিগ্ন, তখন চোখের সামনে এই ধরনের হাঁসপাখি-ব্যাঙ ও তাঁদের প্রাকৃতিক শব্দ বাচ্চারা ছোটো থেকে দেখতে ও শুনতে থাকলে তাঁদের মস্তিষ্কের গড়নে সুস্থতা তৈরি হবে এবং প্রাণীবিজ্ঞান, কৃষি ও পরিবেশ নিয়ে পড়া ও কেরিয়ার গড়ার মনন তৈরি হবে। কর্পোরেট কেরিয়ারও টেনশনমুক্ত হবে। তাঁরা ‘নীল তিমি’ ও অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের অভ্যাস থেকেও বিরত থাকবে। আজকের নিরাপত্তাহীন সময়ে হাঁস কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাতে-দিনে আপনার ঘরে কোনো শব্দ হলে বা অপরিচিত ব্যক্তি আবাসনে ঢুকলে, কেয়ারটেকার ঘুমিয়ে পড়লেও, সে কিন্তু আওয়াজ দিয়ে আপনাকে সতর্ক করে দেবে।
এর সঙ্গে ব্যাঙ। হাঁস যেখানে মাছি-মশার লার্ভা খেতে পারে না, সেখানে ব্যাঙ সহজেই যেতে পারে। শুধু ব্যাঙের বাসস্থানের জায়গার জন্য একটু জল-মাটির পরিবেশ তৈরি করুন। তা হলে শারীরিক-মানসিক-আর্থিক দিক দিয়ে আমরা অনেক নিশ্চিন্ত থাকতে পারব। মহামারি রুখতে পারব।
হাঁস-ব্যাঙ শুনে নাক সিঁটকোবেন না। এই সব মারণরোগ থেকে এরাই বাঁচাবে। খরচ খুবই কম। ঝামেলা নেই বললেই চলে। এই ছোটো উদ্যোগ আমরা নিতে পারলে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার মতো রোগ থেকে বাঁচতে পারব। বিল্ডিং প্ল্যানের সঙ্গে এই ছোটো পরিকল্পনাকে যুক্ত করতে ডেভেলপারকে বাধ্য করানোর জন্য পৌরসভা বা কর্পোরেশনকে সক্রিয় হতে হবে। যে বিল্ডিং-এর জমিতে যে রকম ছাড় থাকে, তার মধ্যেই এই বড়ো বা ছোটো জলাশয় তৈরি করতে হবে। এই ছোটো জলাশয়গুলো কিন্তু (কম হলেও) ভূগর্ভস্থ জলস্তরও বৃদ্ধি করবে। তিন ইঞ্চি স্ক্রিনে চোখ আটকে রাখার অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে সমাজে এই নতুন সংস্কৃতি অভ্যাস করা একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ক্লাব ও আবাসন কমিটি সবাই মিলে এই চর্চা ও প্রয়োগ করা উচিত।
ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া-চিকুনগুনিয়া রুখতে এই ধরনের পরিকল্পনা পৌরসভা ও কর্পোরেশন গ্রহণ করে বাস্তবায়িত না করতে পারলে দুনিয়ার সমস্ত টাকা ও ধোঁয়া ঢাললেও ডেঙ্গির হাত থেকে মানুষকে বাঁচানো যাবে না।