সায়ন্তনী অধিকারী
গত কিছু দিন বা বলা ভালো কয়েক মাস যাবৎ জাতীয় রাজনীতিতে যে বিষয়গুলি আলোড়ন ফেলেছে তার মধ্যে একটি হল গরু। গত বছর দাদরির একটি গ্রামে গরুর মাংস রাখার দায়ে একলাখ আহমেদ নামক এক ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হন। তার পর থেকে মাঝেমাঝেই কয়েকটি ঘটনার কথা শোনা গেছে যেখানে গরুর মাংস সঙ্গে থাকার অপরাধে কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন ভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন। এবং সব ক’টি ঘটনার ক্ষেত্রেই ‘গো-রক্ষা সমিতি’র সদস্যদের যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। অতি সম্প্রতি গুজরাতের উনায় মৃত গরুর চামড়া ছাড়ানোর সময় গো- রক্ষকদের হাতে দলিত নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে, যার পরবর্তী আন্দোলনের স্রোতে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেনকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। এ গেল এ কালের গো-রক্ষার খবর। তবে এই গো-রক্ষা আন্দোলনের একটি ইতিহাস আছে, যা না জানলে এর পিছনের রাজনীতিটি বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। তাই এক বার সে কালের গো-রক্ষা আন্দোলনের দিকে চোখ রাখা যাক।
গো-রক্ষা সমিতি বা আন্দোলন কোনওটাই ঠিক আজকের জিনিস না। এর সূত্রপাত ঘটেছিল সেই ব্রিটিশ আমলে। ১৮৭০-৮০-এর দশকে প্রথম গো-রক্ষার বিষয়টি বিবেচনা শুরু করা হয় এবং তা করেছিলেন মূলত আর্যসমাজীরা। প্রথম গো-রক্ষিণী সভা প্রতিষ্ঠিত হয় পঞ্জাবে, ১৮৮২ সালে। কিন্তু সেই সময়ে সম্পূর্ণ ভাবে গো-রক্ষার সচেতন রাজনীতির সূচনা হয়নি বলা চলে। ১৮৯২-৯৩ সাল নাগাদ প্রথম আক্রমণাত্মক হিন্দুত্বের নির্মাণের রাজনীতি শুরু হয় উত্তরপ্রদেশের পূর্ব দিকে, গো-রক্ষিণী সভার আন্দোলনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে এই সময়ে বিষ প্রয়োগে গো-হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। এই আন্দোলনের গুরুত্ব এখানেই যে এটি প্রথম সম্পূর্ণ ভাবে মুসলমান সত্তার বিপরীতে একটি হিন্দু সত্তা নির্মাণের প্রচেষ্টা করে। ফলত এই আন্দোলনের ঘোষিত সূচিমুখ ছিল মুসলমানদের দিকেই। আন্দোলনটি খুবই নির্দিষ্ট ভাবে ঈদের সময় হওয়া কোরবানির বিরোধিতা করে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে গরু কোরবানি সেই সময়ে মূলত বিত্তশালী মুসলমান পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী কালে যদিও দেখা যায়, হিন্দুত্বের বিপরীতে মুসলমানিয়ত নির্মাণের জন্য এই কোরবানিকে প্রায় প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য কর্তব্যের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
গো-রক্ষার রাজনীতি প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে গো-রক্ষিণী সভার এই আন্দোলন শুধুমাত্র মুসলিম- বিরোধী ছিল না, এর একটি দলিত-বিরোধী অভিমুখও ছিল। যে হেতু চর্মকার শ্রেণির কাজ গরুর চামড়া নিয়ে, গোহত্যায় তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে বলেই মনে করা হয়। গো-রক্ষিণী সভার সদস্য এবং হিন্দু সমাজের একটি বৃহত্তর অংশ মনে করতে শুরু করে যে গোহত্যা মুসলমান সমাজের মতো দলিত সমাজের সংস্কৃতির একটি অবিছেদ্য অংশ। অর্থাৎ যে হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর ধারণা সেই সময় নির্মাণ করা হচ্ছিল তা একই সাথে মুসলমান ও দলিত-বিরোধী এবং ফলত ব্রাহ্মণ্যবাদী। পরবর্তী কালে অবশ্য এই হিন্দুত্বের ধারণার কিছু পরিবর্তন হয় এবং গো-রক্ষার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভাবেই মুসলমান-বিরোধী একটি প্যানহিন্দু সত্তার নির্মাণের কাজে লাগানো হয়। (চলবে)
(লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক)
ঋণ স্বীকার : রামনারায়ণ এস রাওয়াত – রিকনসিডারিং আনটাচেবিলিটি: চামারস অ্যান্ড দলিত হিস্টরি ইন নর্থ ইন্ডিয়া
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।