পার্থ গুহ
মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস থেকে হারবার লাইনের ট্রেন ধরেছি। গন্তব্য শিরধন গ্রাম। এই লাইনে প্রান্তিক স্টেশন পানভেল, দূরত্ব ৪৯ কিমি, সোয়া ঘণ্টার পথ। পানভেল থেকে আরও ১০ কিমি গেলে পৌঁছে যাওয়া যায় শিরধনে। বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের জন্মস্থান শিরধন।
পাঠক আসুন, ট্রেনে যেতে যেতে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই স্বাধীনতা সংগ্রামী বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের সঙ্গে। এই মানুষটির সঙ্গে আমি প্রচুর মিল খুঁজে পাই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন দাসের। যে দিন জানতে পেরেছিলাম যতীন দাসের মতোই বাসুদেব ব্রিটিশরাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বন্দি অবস্থায় আমরণ অনশন করে মৃত্যুবরণ করেন, সে দিনই ঠিক করেছিলাম, এক বার রায়গড় জেলার শিরধনে গিয়ে ভারত মায়ের এই অমূল্য ধনটিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসব। সেই সুযোগ এসে গেল।
আরও পড়ুন সে দিনের স্মৃতি: ফিল গুডে হাজারিকার হাহাকারের গান, হাসিমুখে সহনশীল সুষমার প্রস্থান
ট্রেনে চলেছি আর ভাবছি বাসুদেবের কথা। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন বাসুদেব, আর পারিবারিক পদবি ফাড়কে। মরাঠি রীতি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম ও পদবির মাঝে বাবার নামটাও রাখতে হয়। বাবা বলবন্ত। তাই বাসুদেবের পুরো নাম বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে। চিতপবন ব্রাহ্মণ পরিবারে বাসুদেবের জন্ম। অথচ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে নিজের কাছে টেনে নিয়েছিলেন সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের। মৎস্যজীবীরা ছাড়াও তাঁর লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন কোল, ভিল সম্প্রদায়ের মানুষজন, এমনকি অচ্ছুত ধাঙড় শ্রেণির লোকেরাও।
বাসুদেব জন্মেছিলেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ১৮৪৫ সালের ৪ নভেম্বর। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে জনরোষ তখনও তত দানা বাঁধেনি। কিন্তু দেশগ্রামের পরিস্থিতি ফাড়কে-কে বিরূপ করে তুলছিল। কৃষকদের দুর্দশায় তিনি ব্যথিত হতেন। ছোটোবেলাতেই শিখেছিলেন কুস্তি, শিখেছিলেন ঘোড়ায় চড়া। এই করতে গিয়ে শৈশবেই স্কুলছুট হয়ে যান তিনি। যা-ই হোক, কুস্তির তালিম নিতে থাকেন অস্পৃশ্য মাং শ্রেণির ক্রান্তিবীর লাহুজি বাস্তব সালভের কাছে। এই লাহুজিই বাসুদেবকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। বাসুদেবকে বুঝিয়েছিলেন, সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের মূল ধারার স্বাধীনতা আন্দোলনে শামিল করতে না পারলে আন্দোলন সফল হবে না।

পুনেতে চলে এসেছিলেন বাসুদেব। সরকারের মিলিটারি অ্যাকাউন্টস দফতরে কেরানির পদে চাকরি নেন। এর পর মহাদেও গোবিন্দ রানাডের লেকচার ক্লাসগুলো নিয়মিত শুনতে যেতেন বাসুদেব। ব্রিটিশরাজের নীতি কী ভাবে ভারতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে, সে কথাই বলতেন রানাডে। রানাডের বক্তব্যের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে নিতেন বাসুদেব। নিজের চোখেই দেখেছেন, নিজের গ্রামের কৃষকদের দুর্দশা। তিনি বুঝতেন, ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে স্বরাজ না পেলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
ট্রেন কখন পানভেল পৌঁছে গিয়েছে, খেয়াল করিনি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাস ধরে নিলাম। শিরধন গ্রামটা মুম্বই-গোয়া সড়কের ধারে। বাসে চলেছি, জানলা দিয়ে দেখছি পশ্চিমঘাট পর্বতমালার দৃশ্য – এ পথের সৌন্দর্য এখনও অনেকটাই অটুট। দেখছি আর ভাবছি সে সময়ের কথা – ১৮৪৫ – তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ন-দশ বছরের বালক, সারদা মায়ের তখন জন্মই হয়নি। সে সময় এই জায়গা কী ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। তখন এই সব রাস্তাঘাট প্রায় কিছুই ছিল না। চার দিকে দুর্গম পাহাড় আর জঙ্গল, যার ভিতরে থাকে হিংস্র শ্বাপদ। যানবাহন বলতে শুধুই গোরুর গাড়ি আর কদাচিৎ পালকি। সেই অজ পাড়াগাঁয় জন্ম বাসুদেবের।
বাসুদেব তখন মিলিটারি অ্যাকাউন্টসে চাকরি করেন। প্রতি পদে পদে লালমুখো সাহেবদের কাছে লাঞ্ছিত আর অপমানিত হন। তাই স্বাধীনতার স্পৃহা তাঁর বেড়েই চলে। ইতিমধ্যে জনগণের নানা চাহিদা মেটানোর দাবিতে পুনেতে আন্দোলনে শামিল হন ফাড়কে। ১৮৭০ সালে পুনেতে গড়ে তোলেন ‘ঐক্য বর্ধনী সভা’। এই সভার উদ্দেশ্য ছিল, যুবকদের শিক্ষিত করা।
বাসুদেবের মা তখন মৃত্যুশয্যায়। ছুটির দরখাস্ত করলেন। ছুটি মঞ্জুরে সাহেবদের গড়িমসি বাসুদেবকে ক্রমশই ক্ষিপ্ত করে তুলল। ছুটি পেয়ে যখন বাড়ি এলেন, মা আর জীবিত নেই। ক্ষুব্ধ বাসুদেব চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন। সশস্ত্র বিপ্লবই মুক্তির একমাত্র পথ, এ কথা ঘোষণা করে গড়ে তুললেন তাঁর বিপ্লবী সংগঠন ‘রামোশি’।

সময়টা ছিল ১৮৭৫। বডোদরার (বরোদা) গায়কোয়াড়কে অপসারণ করল ব্রিটিশ। ফাড়কে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসভার আয়োজন করতে লাগলেন বিভিন্ন জায়গায়। দেশের রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক অবস্থা। দুর্ভিক্ষে সাধারণ মানুষের জেরবার অবস্থা। ব্রিটিশ প্রশাসনের হেলদোল নেই। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠার জন্য আবেদন করলেন ফাড়কে। শিক্ষিত মানুষজনের কাছ থেকে তেমন সাড়া পেলেন না। কিন্তু এগিয়ে এলেন ‘রামোশি’ সম্প্রদায়ের লোকেরা। তাদের সঙ্গে যোগ দিল কোল, ভিল, এমনকি ধাঙড় শ্রেণির মানুষজন। ৩০০ সদস্যের ‘রামোশি’ সংগঠন করলেন ফাড়কে। ইচ্ছে ছিল দেশকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য একটা সেনাবাহিনী গড়বেন। কিন্তু টাকা কোথায়? সিদ্ধান্ত হল ব্রিটিশ অনুগত ব্যবসায়ীদের এবং সরকারি কোষাগার লুঠ করার। এই ভাবে চলছিল। বাসুদেবের নেতৃত্বে তাঁর বিপ্লবী দল ইংরেজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা লুঠ করে দুর্ভিক্ষ-আক্রান্ত কৃষকদের সাহায্য করত। এ রকমই এক অভিযানে ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে খুন হলেন বাসুদেবের বিশ্বস্ত অনুচর দৌলতরব নায়েক। বাসুদেব পালিয়ে গেলেন দক্ষিণ ভারতের শ্রীশৈলমে। তার পর হায়দরাবাদে।
হায়দরাবাদের ৫০০ রোহিলা ও আরবদের নিয়ে সংগঠন গড়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলেন বাসুদেব। এর পর থেকেই উনি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নেন এবং তাদের নাস্তানাবুদ করতে থাকেন অহরহ। এক বার তো ব্রিটিশ সেনাদের উপর অতর্কিতে হামলা করে এবং তাদের পরাজিত করে কিছু দিনের জন্য পুনে শহরের দখল নিয়েছিল বাসুদেবের বাহিনী।
বাস থেকে নেমে চলেছি বাসুদেবের বাড়ির পথে। মাথায় ঘুরছে তাঁরই কথা। বাসুদেবকে ধরতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের। নিজের বাহিনীরই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা না করলে সহজে ধরা যায় না নেতাকে। এ রকম অজস্র উদাহরণ আছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে। বাসুদেবের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এক ‘মীরজাফর’-এর বিশ্বাসঘাতকতায় পান্ধারপুর যাওয়ার পথে কলডগির কাছে ১৮৭৯ সালের ২০ জুলাই ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়ে যান বাসুদেব। বিচারের জন্য তাঁকে পুনে নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাবাস হয়। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে সুদূর লোহিত সাগরের ধারে বন্দর-শহর অ্যাডেনে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু বন্দি থাকার পাত্র নন বাসুদেব। ১৮৮৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে পালান তিনি। কিন্তু বেশি ক্ষণ পালিয়ে থাকতে পারেননি তিনি। ফের ধরা পড়ে যান। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসাবে শুরু করেন আমরণ অনশন। চার দিন পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে ইহলোক ত্যাগ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৭ বছর।

শিরধনে বাসুদেবের বাড়িটা এখন পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণর অধীনে। দেখলাম বাড়িটার সংস্কার করা হয়েছে। এখানকার মানুষজন তাঁর নামে একটা স্মৃতিমন্দিরও গড়েছেন। বিলাসরাও দেশমুখ যখন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী তখন ওঁর বাড়ির কাছে ওঁর নামে একটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুল গড়া হয়। বিলাসরাওজিই তার উদ্বোধন করেন। ১৯৮৪ সালে বাসুদেবের স্মৃতিতে ভারতীয় ডাক বিভাগ ৫০ পয়সার ডাকটিকিটও চালু করেছিল।
নিজের প্রথাগত শিক্ষা তেমন ছিল না। কিন্তু এটুকু বুঝতেন শিক্ষাই সব কিছুর চাবিকাঠি। তাই ১৮৬০ সালে আরও কিছু মানুষকে নিয়ে শুরু করেন পুনা নেটিভ ইনস্টিটিউশন (পিএনআই) যা পরবর্তীকালে মহারাষ্ট্র এডুকেশন সোসাইটি (এমইএস) নামে পরিচিত হয়। এবং বর্তমানে এই সংগঠনের ৭৭টি শাখা আছে সারা মহারাষ্ট্র জুড়ে।
৭৩তম স্বাধীনতা দিবসে ভারতের এই বীর মরাঠি সন্তানকে সহস্র প্রণাম।