প্রসিত দাস এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন কাজুও ইশিগুরো। এ বারের পুরস্কারের দৌড়ে পাল্লা ভারী ছিল বয়সে প্রবীণ কানাডার খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক মার্গারেট আটউড ও গোটা দুনিয়া জুড়ে বেস্টসেলার জাপানি ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামির। কিন্তু সাহিত্যমহলকে কতকটা তাক লাগিয়েই এ বারের পুরস্কার প্রাপক জন্মসূত্রে জাপানি কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিক ইশিগুরো। এমনকি তিনি স্বয়ং খবরটা শুনে প্রথমটা বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি। পরে অবশ্য বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না, কারণ খবর আসে খোদ সুইডিশ অ্যাকাডেমির তরফ থেকে। ইশিগুরোর আগে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন জাপানের মাত্র দু’জন সাহিত্যিক – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) ও কেনজাবুরো ওয়ে (১৯৯৪)। ইশিগুরো (জন্ম ১৯৫৪) অবশ্য নেহাত জন্মসূত্রেই জাপানি, বাবা-মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে চলে আসেন পাঁচ বছর বয়সেই, যদিও তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়েছেন এর ঢের পরে, ১৯৮৩ সালে। তা ছাড়া কাওয়াবাতা বা ওয়ের লেখায় যে অর্থে জাপানি সত্তার একটা জটিল পরিচয় উঠে আসে তা ইশিগুরোর লেখায় আসে না। লেখেন ইংরেজিতে বলেই শুধু নয়, এই লেখক নানা অর্থেই ঢের বেশি আন্তর্জাতিক। এ দিক থেকে হালফিলের তথাকথিত ভারতীয় ইংরেজি লেখকদের তুলনায় তিনি সম্পূর্ণ ভিন গ্রহের বাসিন্দা। সোজা কথায়, নিজের জাতিগত পরিচয় তাঁর লেখার পুঁজি নয়। কিন্তু আর শিবের গীত নয়, এ বার সোজাসুজি ইশিগুরোর লেখার ভুবনে প্রবেশ করা যাক। সুইডিশ অ্যাকাডেমির মতে, তাঁর উপন্যাসে “জগতের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের যে বিভ্রম তার অন্তঃস্থলে থাকা অতল গহ্বরের উন্মোচন” ঘটে যায়। স্মৃতির জগৎ তাঁর লেখার অন্যতম উপজীব্য। কিন্তু এ দিক থেকে তাঁকে ঠিক মার্শেল প্রুস্তের আত্মীয় বলা যায় না। প্রুস্তের ‘হারানো সময়ের খোঁজে’-র মতো তাঁর লেখায় আকস্মিক ভাবে পরতে পরতে খুলে যায় না স্মৃতির ঝাঁপি, স্মৃতির অপ্রত্যাশিত পুনরুদ্ধার তাঁর উদ্দেশ্য নয়। বরং তাঁর কথকরা স্মৃতির সফরে বেরোয় কতকটা সচেতন ভাবেই, আর এই সফরে তাদের বর্তমানের ভিত হয়ে ওঠে নড়বড়ে। আবার হয়তো জীবনকে তাড়িয়ে বেড়ানো কিছু প্রশ্নের উত্তরেরও দেখা মেলে। খুব বেশি যে লিখেছেন বাষট্টি বছর বয়সি এই লেখক, তা নয়। এখনও পর্যন্ত একটা গল্প সংকলন (‘নকটার্নস’) বাদ দিলে তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা মোটে সাত। এ ছাড়া অবশ্য লিখেছেন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের জন্য চিত্রনাট্য, আর হ্যাঁ, গান। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘এ পেল ভিউ অফ হিলস’ (১৯৮২)-কে আয়তনে উপন্যাসিকাই বলা চলে। এখানে কথক এক জাপানি ভদ্রমহিলা। তাঁর সাকিন ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চল। সদ্য আত্মহত্যা করেছে তাঁর এক মেয়ে। আরেক মেয়ে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে তখন সেই সূত্রে তাঁর মনে পড়ে প্রথম যৌবনে নাগাসাকিতে কাটানো দিনগুলোর কথা। সদ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে আসা নাগাসাকির শহরতলিতে প্রতিবেশী এক মহিলা আর তাঁর মেয়ের সঙ্গে এক বিচিত্র বন্ধুত্বের স্মৃতি। শেষমেশ স্মৃতি আর বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: ১০০ কোটির মানহানি মামলা ও স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকা
সাহিত্যের প্রকরণ নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন ইশিগুরো। তবে নিছক খেলা নয়, এর মধ্যে দিয়ে সময়ের নাড়িতে হাত রাখেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে উনিশ শতকি উপন্যাস পড়া প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছেন: “…তখন যেন কতকটা বোধিলাভের মতোই মনে হল যে আধুনিক জীবনের গল্প বলার জন্যও তো এই একই সব তরিকা কাজে লাগানো যেতে পারে। রাসকলনিকভের বৃদ্ধাকে খুন করার গল্প কিংবা নেপোলিয়নের যুদ্ধগুলোর গল্পই যে লিখতে হবে তার তো কোনো মানে নেই। স্রেফ এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো নিয়েও তো একটা উপন্যাস লেখা যেতে পারে।” এর সঙ্গেই তাঁর মধ্যে আছে বৈচিত্র্যের খোঁজ। তাই তাঁর এক একটা উপন্যাসে উঠে আসে এক একটা ভুবন, সাহিত্যের এক একটা গোত্রও বটে। এই সূত্রে আমরা তাঁর তিনটে উপন্যাসের কথা আলাদা করে খেয়াল করব।

