নীলাঞ্জন দত্ত
মোদীজিই মনে করিয়ে দিলেন। অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পর সন্ধেবেলা প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণে বললেন, ৯ নভেম্বর তারিখটার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। এই দিনেই ১৯৮৯ সালে বার্লিনের দেওয়াল ভাঙা শুরু হয়েছিল। আবার, ৩০ বছর পর এই দিনেই কর্তারপুর সাহিব করিডোর খুলে গেল, ভারত ও পাকিস্তানের দু’টি অন্যতম প্রধান শিখ ধর্মস্থানের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের রাস্তা তৈরি হল।
তিরিশ বছর আগেকার সেই দিনে আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল, যে কথা তিনি বললেন না, আমার কিন্তু সে কথাই মনে পড়ে গেল। অবশ্য আমি ভুলি কী করে, চোখের সামনে যে সে-ই ঘটনাটা ঘটতে দেখেছি। একটা প্রশ্নও মনে জাগল — বার্লিন দেওয়াল ভাঙার থেকে বরং সেই ঘটনাটাই তো সরাসরি আজকের রায়ের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক, তবু কেন প্রধানমন্ত্রী সে কথা তুললেন না?
অযোধ্যা বিতর্কের ইতিহাসে ১৯৮৯ সালটা সত্যিই খুব ঘটনাবহুল ছিল। মোদীজি বলুন বা না-বলুন, পুরোনো স্মৃতিগুলোকে একবার ঝালিয়ে নিলে আজকের পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে কাজেও লাগতে পারে।
সে বছরের ১৪ আগস্ট এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চ মন্দির-মসজিদ সম্পর্কিত সমস্ত জমে থাকা মামলাগুলো এক সঙ্গে জড়ো করে বিচারের প্রক্রিয়া আরম্ভ করল, যে প্রক্রিয়া ঠিক তিন দশক পর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ হল বলা চলে। এই একত্রে আনার সঙ্গে সঙ্গে হাইকোর্ট এক অন্তর্বর্তী নির্দেশও জারি করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, বিতর্কিত জায়গায় আপাতত আর কিছু করা যাবে না, সেখানে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা তখনকার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিংকে আশ্বাস দিলেন, তাঁরা এই নির্দেশ মেনে চলবেন।
কিন্তু তা হল কই? উলটে সারা দেশে একটা হাওয়া উঠতে শুরু করল, ‘মন্দির ওহিঁ বনায়েঙ্গে’ — মন্দির বানাতে হবে ওই জায়গাতেই। যে ইট দিয়ে বানানো হবে, দিকে দিকে তার পুজোও শুরু হয়ে গেল। এই ইটগুলোকে বলা হতে লাগল, ‘রামশিলা’। তখনকার বাম আমলের ‘লালদুর্গ’ কলকাতাতেও রামশিলা-পুজো কম জায়গায় হয়নি। নির্দেশ এল, এই সব ‘পবিত্র’ ইট নিয়ে এক শুভদিনে যেতে হবে অযোধ্যায়, সেখানে রামমন্দিরের শিলান্যাস হবে। পুথিপাঁজি দেখে ঠিক করা সেই দিনটি হল ৯ নভেম্বর। হ্যাঁ, যে শুভ তারিখে ৩০ বছর পর সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় থেকে চূড়ান্ত রায় বেরোল, মন্দির ওহিঁ বনেঙ্গে।
আরও পড়ুন: অযোধ্যা মামলা: ভারতীয় অর্থনীতিতে বড়োসড়ো প্রভাব ফেলতে পারে সুপ্রিম কোর্টের রায়
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পূজিত শিলাগুলো বয়ে নিয়ে যারা যাবে, তাদের বলা হল ‘করসেবক’। আর মন্দির গড়ার এই পবিত্র কাজে হাত লাগানোকে বলা হল, ‘করসেবা’। এর আগে, শিখদের ধর্মীয় কর্তব্যপালনের ক্ষেত্র ছাড়া এই শব্দদু’টি বিশেষ শোনা যায়নি। এখন, ‘বৃহত্তর হিন্দু সমাজের’ এক মহান ব্রত সম্পাদনে সেই শব্দদু’টিকেই বেছে নেওয়া হল। শুধু কি এক গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দই নেওয়া হল, নাকি তার সঙ্গে নিঃশব্দ সম্মতিও? কর্তারপুর সাহিব করিডোর উদ্বোধন করতে গিয়েও মোদীজি কিন্তু করসেবার কথাটা ভোলেননি। “করসেবা করার সময় আপনারা যে রকম আনন্দ পান, আমার এখন সে রকমই আনন্দ হচ্ছে,” বলেছেন তিনি।
করসেবা করে সে দিন মন্দিরের শিলান্যাস হয়েছিল যে জমিতে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বলেছিল তা অবিতর্কিত। সেটা ছিল প্লট নং ৫৮৬। সেখানে মুসলমানদের একটি গোরস্থান ছিল বলে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড অবশ্য আপত্তি জানিয়েছিল। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে, ওয়াকফ বোর্ড কোনো জায়গারই অবিসংবাদী স্বত্ব প্রমাণ করতে পারেনি।
আমরা সাংবাদিকরাও তখন ক’দিন ধরে অযোধ্যায় ঘাঁটি গেড়ে পড়ে থেকেছি আমাদের নিজস্ব করসেবার তাগিদে। কলকাতা থেকে যাওয়া দুই সাংবাদিক-বন্ধুর সঙ্গে জুটে ত্রিমূর্তি চরকির মত ঘুরে বেরিয়েছি আখড়ায় আখড়ায়, করসেবকদের তাঁবুতে তাঁবুতে। অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে বিচিত্র। কোথাও প্রত্যন্ত গ্রামীণ ভারতের অত্যন্ত রক্ষণশীল সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা দুর্গা বাহিনীর সদস্যাদের সপ্রতিভতা দেখে নারীমুক্তির বিষয়টা নতুন করে ভাবতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোথাও ঝকঝকে স্মার্ট অল্পবয়সি ছেলেদের ভক্তির বহর দেখে বিস্মিত হয়েছি, যে তাঁবুতে নাকি সোনা-রূপা-প্লাটিনামের ‘শিলা’ রাখা আছে সেখানে প্রকাশ্যেই সশস্ত্র কড়া পাহারা দেখে স্তম্ভিত হয়েছি।
সে দিন আমরা যারা ওই মহাযজ্ঞে যোগ দিতে আসা ‘ন্যাশনালিস্ট মুসলিম’ আর রামভক্ত শিখ, জৈন, বৌদ্ধদের দেখেছি, তাদের কাছে বোঝা কঠিন নয়, কোন অনুশীলনের সাফল্যে গর্বিত হয়ে ৩০ বছর পর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মোদীজি ভাঙাভাঙি ভুলে শুধু জোড়ার কথাই বলেন: “৯ নভেম্বর ছিল সেই দিন, যে দিন জার্মানিতে বার্লিন দেওয়ালের পতন হয়েছিল। সে দিন দু’টি বিপরীত মতাদর্শ এক সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। আজ ৯ নভেম্বর কর্তারপুর সাহিব করিডোর খুলে দেওয়া হল, যার মাধ্যমে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে এক বোঝাপড়ার সূচনা হল। ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রায় আমাদের এক সঙ্গে মিলে প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা দিচ্ছে।”
বলতে ভুলে গিয়েছি, ৩০ বছর আগের ৯ নভেম্বর আমরা কলকাতার সাংবাদিকত্রয়ী আমাদের শহরেরই কোনো কোনো অতি পরিচিত আশ্রম থেকে আসা বাঙালি করসেবকদের সঙ্গে মিছিল করে অনায়াসে সব নিরাপত্তাবলয় ভেদ করে খোদ শিলান্যাসের জায়গায় ঢুকে পড়েছিলাম, আমাদের পেশার বেশির ভাগ বন্ধুরাই যা পারেননি। কিন্তু সেই পুণ্যলগ্নে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত অনুভব করেছিলাম। মাঝখানে ‘করসেবা’ চলছে, আর চারিদিক ঘিরে ঘিরে একদল উর্দিপরা মানুষ হাতে আধুনিক বন্দুক নিয়ে, গলায় বুলেটের মালার ওপর গাঁদা ফুলের মালা পরে, কপালে রক্তচন্দনের তিলক কেটে, রামসীতার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে নাচছে। উত্তরপ্রদেশে এরা প্রভিনশিয়াল আর্মড কনস্ট্যাবিউলারি বা পিএসি নামে সুপরিচিত।
তিন দশক পার হয়ে গিয়েছে। বদলেছে অনেক কিছুই। সিয়ারামের নামে আর জয়ধ্বনি হয় না। হয় শুধু শ্রীরামের নামে। কিন্তু করসেবকদের ঘিরে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর নাচের ছবিটা কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারি না। আর শিরদাঁড়ায় সেই হিমস্রোত বইতেই থাকে।