প্রবন্ধ
চুরাশির ছায়া, জিম করবেটে নৌকাবিহার ও দেশপ্রেমের ভোট ২০১৯
দেহরক্ষীর ভেকধারী বিয়ন্ত সিংয়ের একে রাইফেল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার পর সারা দেশ শিখদের দিকে মেলে ধরেছিল সন্দেহপ্রবণ জোড়া জোড়া চোখ। আগাগোড়া নিরীহ, ধর্মপ্রাণ, আইন ও শাসনে আস্থাশীল এবং নিতান্তই রাজভক্ত নাগরিক হলেও পরিত্রাণ নেই সন্দেহের বেড়াজাল থেকে। দিল্লিতে মনেপ্রাণে কংগ্রেসি এক সর্দারজি দুঃখের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। তাঁর একটা মান্ধাতার আমলের […]


দেবারুণ রায়
দেহরক্ষীর ভেকধারী বিয়ন্ত সিংয়ের একে রাইফেল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার পর সারা দেশ শিখদের দিকে মেলে ধরেছিল সন্দেহপ্রবণ জোড়া জোড়া চোখ। আগাগোড়া নিরীহ, ধর্মপ্রাণ, আইন ও শাসনে আস্থাশীল এবং নিতান্তই রাজভক্ত নাগরিক হলেও পরিত্রাণ নেই সন্দেহের বেড়াজাল থেকে।
দিল্লিতে মনেপ্রাণে কংগ্রেসি এক সর্দারজি দুঃখের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। তাঁর একটা মান্ধাতার আমলের নীল অ্যামবাস্যাডর ছিল। সেটাই খাটিয়ে সংসার চালাতেন। গাড়ি চালাতেন নিজেই। সর্দারজি বক্সি সিং বলেছিলেন, “সর্দারের ঘরে জন্ম নিয়ে কি পাপ করেছি? আমাদের পূর্বজ দেশ স্বাধীন করতে বুকের রক্ত দিয়েছে। দেশের পুনর্গঠনে আমরা যোগদান করেছি। দেশের সার্বভৌমত্ব বাঁচাতে বলিদান দিয়েছি সব যুদ্ধে ও শান্তির সময়েও। তবু নিজভূমে আজ আমরা পরবাসী। সর্দার বক্সি সিংয়ের এই মনোবেদনার কোনো প্রতিকার করেনি সে দিনের সরকার। উলটে যে কোনো উগ্রপন্থী হানাদারির ঘটনায় শিখ আমজনতাকে লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে হয়েছে পদে পদে। যার সূচনা দিল্লিতে ১৯৮৪-র শিখনিধন থেকে। ওই দাঙ্গায় অভিযুক্ত সজ্জন কুমার, জগদীশ টাইটলাররা পরের পর ভোটে জিতেছেন। ওই কলঙ্কের কালো দাগেই হিরো হয়েছেন।
আরও পড়ুন পুলওয়ামা হামলা কী দিল মোদীকে?
প্রায় সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীরে লাগাতার উগ্রপন্থী হানা ও আক্রমণের ঘটনায়। যার মধ্যে অন্যতম সাম্প্রতিক পুলোয়ামা হামলা। সেখানে জঙ্গি বিস্ফোরণের শিকার হয়েছেন ৪৯ জন নিরীহ জওয়ান। কাশ্মীরের রাজ্যবাসীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে গিয়ে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর মতপার্থক্য সরিয়ে রেখে সব দল একজোট হয়ে জঙ্গি আক্রমণ ও পাক-ভূমিকার বিরুদ্ধে সরব হয়। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ঘোষণা করেন, “এই সংকট মুহূর্তে আমরা সরকারের পাশে আছি।”
দৈনন্দিন রাজনীতি যেখানে প্রাণের আরাম, ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণার জল ও নিঃশ্বাসের বায়ু সেখানেও রাহুল গান্ধীর এই কথাটিতে সব বিরোধী দলের সমর্থন মিলল। এমনকি আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের মতো নেতাও বললেন, “দেশ এখন একজোট। পুলওয়ামা নিয়ে সরকারের পাশে সবাই।” কিন্তু এতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে প্রথম কাদা ছোড়াছুড়ি ক্লাবের খেরোর খাতায় নাম লেখালেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন। বাদ দিলেন না জওহরলাল নেহরুকেও। অমনি তেতে উঠল রাজনীতি। কংগ্রেস বাজারে ছাড়ল এমন ব্রহ্মাস্ত্র, যাতে আছে পুলওয়ামার রক্তক্ষরণের সময় নরেন্দ্র মোদীর ফটো শ্যুটিং ও জিম করবেটে নৌকাবিহারের দৃশ্য। পুরো ভিডিও চাউর করে দিল, ওই ঘটনার পর কত ঘণ্টা প্রধানমন্ত্রী কিছুই জানতে পারেননি। প্রশ্ন উঠল, তা হলে মনমোহনকে দুর্বল প্রধানমন্ত্রী বিশেষণ দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যে যে অভিযোগ এনেছিলেন মোদী, নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়ে তার চেয়ে ভালো কী কী করলেন?

করবেটে প্রধানমন্ত্রীর নৌকাবিহার। ছবি সৌজন্যে দ্য হিন্দু।
বিজেপির সভাপতি থেকে এ টু জেড নানা মাপের নেতা, প্রত্যেকেই রাহুলকে দুয়ো দিতে দিতে ঘোলা জলে কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছেন স্বদেশের রাজনীতির পুষ্কর। চিরাচরিত চেনা আওয়াজে বলতে শুরু করেছেন, পুলওয়ামার ঘটনা ঘটার পর ঠিক সময়েই প্রধানমন্ত্রী জেনেছেন। ঘটনা ঘটার আগে যাঁরা জানার তাঁরা তো জানতেনই। অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন খোঁচা বিরোধী নেতাদের। কেউ কেউ রাখ ঢাক না রেখেই বলছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে বিরোধীদের তো ভাব-ভালোবাসা আছেই। না হলে উপত্যকায় পাত্থরবাজদের দমনে সেনা-সিআরপির গুলি চললে তারা অশ্রুবর্ষণ করেন কেন?
মনের মতো বিতর্কের ইস্যু পেয়ে গিয়েছে উগ্র জাতীয়তার প্রবক্তারা। প্রায় পাঁচ বছরের রাজ্যপাটে কাশ্মীর নিয়ে তথাকথিত ‘স্থায়ী সমাধান’-এর পথে হেঁটে এবং চোখের বদলে চোখ নেওয়ার নীতি প্রয়োগ করেও কি দেশমাতৃকার সুসন্তান জওয়ানদের জীবন রক্ষা করা যাচ্ছে? ইতিহাস কী বলে? দুর্বল প্রধানমন্ত্রীর দশ বছরে কাশ্মীর সমস্যার প্রার্থিত সমাধান না হলেও উত্তর সীমান্তে কুচক্রী প্রতিবেশী দেশ কতটা সফল ছিল? আর এখন কতটা? জঙ্গি হামলায় নিহত জওয়ানের সংখ্যাই বা কত ছিল ইউপিএ আমলে এমনকি প্রথম এনডিএ জমানায় – এই সব সংখ্যা নিয়ে তুলনামূলক বিচারে যাওয়ার দরকার ছিল না। জাতীয় সংকটের মুহূর্তে এই স্কোরবোর্ড ভুলে থাকাটাই গণতান্ত্রিক শোভনতা। এ দিকে তাকিয়ে পরিণত বোধের পরিচয় রেখেছিলেন রাহুল। কারণ, নিজে বহু সংকটের সাক্ষী না হলেও তিনি আছেন একটি প্রাচীন বটবৃক্ষের ছায়ায়। যেখানে মনমোহন বা সনিয়া ছাড়াও আছেন গুলাম নবি, অ্যান্টনি বা আহমদ পটেলের মতো নেতা। সর্বোপরি বিশেষ পরিস্থিতিতে মাথার ওপরে আছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সুতরাং কংগ্রেস সভাপতির অবস্থান সুচিন্তিত ছিল। দেশ ও দলীয় রাজনীতি দুয়ের পক্ষেই ছিল সুখকর।
আরও পড়ুন পুলওয়ামা হামলা: ভোট নিয়ে গুজরাতি মন্ত্রী যা চান, তা কি মোদীজিরও মনের কথা?
বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী এই অবস্থান উপলব্ধি করেই স্বভাবসিদ্ধ আক্রমণ থেকে নিরাপদ দূরত্ব রাখছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন তাঁর ডান হাত অমিত শাহ। একাধারে কংগ্রেস ও নেহরুকে দায়ী করলেন কাশ্মীর সমস্যার জন্য। এর পর যথারীতি উতোরচাপান শুরু। যেটা চেয়েছিলেন শাহ অ্যান্ড কোং। কারণ এটাই তাঁদের স্বপ্নের দ্বৈরথের মসৃণ ভূমি। সর্ব অর্থে পাঁচ বছরের পারফরম্যান্স বা কাজের ভিত্তিতে নির্বাচনে যাওয়ার ঝুঁকি যথেষ্ঠই। অথচ জাতীয় আবেগের ইস্যুকে উগ্র মেরুকরণের যূপকাষ্ঠ বানানো গেলে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দিব্যি ভোট কুড়োনো যাবে। এই প্রক্রিয়ায় ছায়া খুঁজতে বাধা নেই। গণতান্ত্রিকতার স্বাভাবিক শর্ত জিঙ্গোবাদের সুবাদে শিকেয় তোলা যাক। শাসনের বিচ্যুতিরও জয়গান গাইতে হবে। অন্যথায় জুটবে ‘দেশদ্রোহী’ খেতাব। এবং কে বা কারা এই ডাইনি বাছাই করে যাবে একেবারে নীচে তৃণমূল স্তরে, ওপরতলা তার খবর নেবে না। কারণ এটা মেরুকরণের প্রয়োজনে। সর্বত্র সব দেশে কালে এমনটাই ঘটেছে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। কোথাও তার পরিবর্তন হয়নি।
‘৮৪-র শিখবিরোধী বাতাবরণের মতো আপাতত কাশ্মীরিদের নিয়ে জিগির বসন্তবাতাস ভারী করে তুলেছে। কাশ্মীরি মানেই জঙ্গি বা পাকপন্থী প্রচার কাশ্মীরের পাহাড়ি পথের পাকদন্ডী আরও দুর্গম করে তুলেছে। গুটিকতক রাজনীতির কারবারিকে ধ্বজা করে নানা নামের গোষ্ঠী অমুক সেনা তমুক সেনা নামে মদোন্মত্ত প্রচার চালাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। জনপ্রিয় নেতাদের নামধারী সেনার প্রচার হয়তো বা তাঁদেরও দুর্নাম করার কৌশল। কে বা কারা, কীসের উদ্দেশ্যে স্পর্শকাতর জাতীয় স্বার্থের ইস্যু নিয়ে এই আগুন আগুন খেলা খেলছে, কেন্দ্রীয় শাসন নিশ্চয় তা নজরে রেখেছে।
প্রবন্ধ
স্বামী নিত্যসত্যানন্দ মহারাজের সঙ্গে সেই কুড়িটা মিনিট কোনো দিনও ভুলব না
খুব বেশি হলে কুড়িটা মিনিট সময় কাটিয়েছিলাম স্বামীজির সঙ্গে। কিন্তু তাতেই কত আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল কত দিনের পরিচিত।

শ্রয়ণ সেন
“এই ব্যাটা, অত প্রণামটনাম করতে হবে না! এমনিই আশীর্বাদ করলুম।”
আজও খুব স্পষ্ট ভাবে মনে পড়ছে কী সুন্দর আর মজার ছলে কথাটা আমায় বলেছিলেন স্বামী নিত্যসত্যানন্দ মহারাজ। এখনও পরিষ্কার ভাবে মনে পড়ছে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার সেই দিনটা।
২০২০-এর জানুয়ারি। দার্জিলিংয়ের রায় ভিলায় বেড়াতে গিয়েছি। এই বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। সেটি বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে গড়ে ওঠা নিবেদিতা শিক্ষা-সংস্কৃতি কেন্দ্র। আর তারই দায়িত্বে ছিলেন স্বামী নিত্যসত্যানন্দ মহারাজ।
‘ছিলেন’ কেন বললাম? কারণ, রবিবার সন্ধ্যায় মন খারাপ করা খবরটি পেলাম।
রামকৃষ্ণলোকের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন স্বামী নিত্যসত্যানন্দ মহারাজ। অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।
সংবাদটা বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। মাত্র এক বছর আগেই যে মানুষটা আমাদের সঙ্গে মজার ছলে কিছুটা সময় কাটালেন, ‘ভূতকোঠি’ থেকে নিবেদিতা-সাধনার কেন্দ্র গড়ে ওঠার গল্প শোনালেন, যে মানুষটার সঙ্গে গত জানুয়ারিতেও প্রায় সাক্ষাৎ হয়েই যাচ্ছিল, তিনি আকস্মিক ভাবে চলে গেলেন কেন? কী-ই বা তাড়া পড়েছিল তাঁর।
২০১৩ সালে যে বাড়িটায় ‘রামকৃষ্ণ মিশন নিবেদিতা এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার’ (Ramakrishna Mission Nibedita Educational and Cultural Centre) গড়ে ওঠে, সেই রায়ভিলা তার আগে পর্যন্ত স্থানীয়দের কাছে ভূতকোঠি নামে পরিচিত ছিল।
–“প্রথম যখন এসেছিলেন, আপনাদের ভয় করেনি?”
–“না। আসলে জানেন তো, যারা দুষ্টুমি করে, আমার মতে তারা ভীতু হয় বেশি। তাই এরা আমাদের কোনো বাধা দেয়নি।”
— “সাত বছর হল আপনারা এসেছেন, স্থানীয়দের মনোভাব কেমন বুঝছেন?”
স্বামীজি তখন বলেছিলেন, প্রথমে স্থানীয়দের সন্দেহ ছিল। ‘ভূতকোঠি’তে আবার কী শুরু হচ্ছে, এই নিয়ে ভয়ডরও ছিল। কিন্তু মিশনের কাজ শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সেই ভয় কেটে যায়।

ওই আড্ডার মধ্যেই পেছন থেকে এসে স্বামীজির গাল টিপে জড়িয়ে ধরল এক কিশোরী।
— “এঁরা বোধহয় নিজেদের বাড়িতে ভালোবাসা খুব একটা পায় না, না?”
— “ভালোবাসার অভাব তো ছিলই। সেটা আমরা পূরণ করার চেষ্টা করছি। মনে হচ্ছে সফলও হচ্ছি।”
এই কেন্দ্রের জন্যই এই আশেপাশের খুদেদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রায় ৭০ জনের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন এখানকার মহারাজরা। স্কুল থেকে সোজা এখানে চলে আসে খুদেগুলো। বিভিন্ন বিষয়ে পড়ানোর পাশাপাশি আদর্শ মানুষ কী ভাবে হবে, সেই পাঠও দেওয়া হয়। আর এই সবই হচ্ছিল স্বামী নিত্যসত্যানন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।
বাঙালি সমতল আর নেপালি দার্জিলিংয়ের মধ্যে তাঁরা একটা সেতুবন্ধনের কাজ করছে বলেও জানিয়েছিলেন স্বামী নিত্যসত্যানন্দ, আর সেই ব্যাপারে তাঁরা অনেকটাই সফল হয়েছেন।
এ ছাড়া নানা রকম ত্রাণকাজ তো রয়েছেই। দার্জিলিংয়ের সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। বৃষ্টি-ধস-ভূমিকম্প কত কী লেগে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে প্রথমেই ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে মিশন। এ ছাড়া চা-বাগানগুলিতে রোজই ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়।
খুব বেশি হলে কুড়িটা মিনিট সময় কাটিয়েছিলাম স্বামীজির সঙ্গে। কিন্তু তাতেই কত আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল কত দিনের পরিচিত।
গত মাসে যখন দার্জিলিং গিয়েছিলাম, ইচ্ছে ছিল একবার স্বামীজির সঙ্গে দেখা করে আসি। কিন্তু সেটা হয়নি। কিন্তু তখন একবারও মনে হয়নি যে তাঁর সঙ্গে আর কোনো দিনও দেখা হবে না।
শুনলাম স্বামীজি নাকি ধ্যান করতে করতে দেহত্যাগ করেছেন। তাঁকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। কে বলতে পারে, হয়তো আগে থেকেই বুঝে গিয়েছিলেন এমন সময় আসতে চলেছে তাঁর। এই কারণেই বোধহয় এঁরা মহাপুরুষ!
স্বামী নিত্যসত্যানন্দ মহারাজ হয়তো শরীরে থাকলেন না। কিন্তু দার্জিলিংয়ের রায় ভিলা জুড়ে তিনিই থাকবেন। তাঁর দেখানো পথেই যে নিবেদিতা-সাধনার কেন্দ্রটি চলবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
প্রবন্ধ
‘কয়েকটা টাকার বিনিময়ে নেতাজির স্মৃতি ধুলোয় মিশিয়ে দেব?’, বলেছিলেন পদমবাহাদুর
মুখে বড়ো বড়ো কথা বললেও, নেতাজির আদর্শে চলার ব্যাপারে আমরা লবডঙ্কা। কবে আমরা ওঁর আদর্শে চলব, ঠিক পদমবাহাদুরের মতো?

শ্রয়ণ সেন
আবার সেই পথে। এই তো ঠিক এক বছর আগে ২০২০-এর জানুয়ারিতে ঘুরে গিয়েছিলাম এখান থেকে। এই জানুয়ারিতে দার্জিলিঙের পথে গিদ্দা পাহাড়ের পাশ দিয়ে যেতে যেতে স্মৃতিতে ডুব দিলাম। মনের মধ্যে ভেসে উঠল পদমবাহাদুর ছেত্রীর মুখটা আর ওঁর কথাগুলো।
“তখন ওরা কত করে আমায় বলল বাড়ির ইটগুলো বিক্রি করে দিতে, এতে আমার টাকা হবে। কিন্তু আমি ওদের কথা শুনিনি। আমার তখন একটাই লক্ষ্য, যে করেই হোক, ওদের হাত থেকে বাড়িটা বাঁচাতেই হবে।”
বেশ গর্ব করেই কথাগুলো বলেছিলেন পদমবাহাদুর। নেতাজি ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ তথা নেতাজি মিউজিয়ামের দেখভালের পুরো দায়িত্ব তাঁর ওপরে। তিন বছরের দুরন্ত নাতিকে সঙ্গে নিয়ে পুরো বাড়িটা আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বাড়িটার অবদান হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। কারণ এই বাড়িতে খুব বেশি কারও পা-ও পড়ে না।

“খুলা হ্যায়, খুলা হ্যায়।”
মূল ফটক দিয়ে বাড়ির দিকে এগোতেই আমাদের উদ্দেশ করে বলেছিল মিষ্টি অথচ দুরন্ত সেই শিশুটি। শীতের দিনের মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে দাদুর কোলে বসেছিল নাতি। আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, মিউজিয়াম খোলা আছে, ভেতরে যেতে পারি।
বাইরে জুতো খুলে প্রবেশ করলাম। এটা তো ঠিকই, যে কোনো পবিত্র স্থানে প্রবেশ করতে গেলে জুতো খুলতেই হবে। নেতাজিকে ভালবাসেন, এমন যে কোনো মানুষের কাছে এই বাড়ি একটা সাধনাস্থল।
নেতাজির বহু বিরল ছবি, তাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাবপত্র আর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে লেখা চিঠি এখানে সযত্নে রাখা আছে।
১৯২২ সালে রলি ওয়ার্ড নামক এক ব্যক্তির কাছ থেকে কার্শিয়াংয়ের গিদ্দাপাহাড়ে অবস্থিত এই বাড়িটি কিনে নেন নেতাজির দাদা, তথা স্বাধীনতাসংগ্রামী শরৎচন্দ্র বসু।
১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫, এই বাড়িতেই ব্রিটিশ সরকারের হাতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল শরৎ বসুকে। এর পরের বছরেই নেতাজির পালা। এই বাড়িতে তাঁকে সাত মাসের জন্য বন্দি করে রাখা হয়।
দ্বিতীয় বার যখন এই বাড়িতে নেতাজি আসেন, তখন তিনি বন্দি নন। সেটা ১৯৩৭ সালের অক্টোবর। হরিপুরা কংগ্রেসের ভাষণ এই বাড়িতে বসেই লিখেছিলেন নেতাজি। এখান থেকে গান্ধীজি ও জওহরলাল নেহরুকে চিঠিও লিখেছিলেন।

এই বাড়িতে থাকাকালীনই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠি পেয়েছিলেন নেতাজি। তাতে ‘বন্দেমাতরম’ গানের প্রসঙ্গও ছিল।
চিঠির একটি অংশে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “…যে রাষ্ট্রসভা ভারতবর্ষের সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র, সেখানে এই গান সর্বজনীন ভাবে সঙ্গত হতেই পারে না।”
এই বাড়িতে বহু দুর্লভ ছবির পাশাপাশি নেতাজি-কেন্দ্রিক প্রচুর চিঠিরও সংগ্রহ রয়েছে। সব চিঠি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার মতো সময় ছিল না। ‘বন্দেমাতরম’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠির ব্যাপারটি একটি সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছিলাম। ওই চিঠির উত্তরও রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন নেতাজি। কিন্তু তাঁর সেই জবাবের হাতের লেখা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
কার্শিয়াংয়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে নেতাজি কত যে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণও রয়েছে এখানে রক্ষিত বহু চিঠিতে।
নেতাজিকে নিয়ে এমন দুর্লভ ছবির সম্ভার ভারতে আর কোথাও আছে বলে মনে করতে পারি না।
নেতাজি এখানে থাকাকালীন প্রাতর্ভ্রমণে বেরোতেন। পাগলাঝোরায় প্রাতর্ভ্রমণরত নেতাজি, এমনই একটি ছবি রয়েছে। বসু পরিবারের সঙ্গে নেতাজির ছবি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই পটেলের সঙ্গে তোলা ছবিও।
এ ছাড়া নেতাজির ব্যবহার করা খাট, চেয়ার-টেবিল সবই সযত্নে রাখা হয়েছে। কার্শিয়াংয়ের ‘পয়েন্টস’ ভ্রমণের মধ্যেই নেতাজির এই বাড়ি পড়ে। কিন্তু এখানে আসতে হবে আলাদা ভাবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময়ে দিয়ে ভালো করে দেখতে হবে। তবেই মনের শান্তি পাওয়া যাবে।
১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাড়িটি বসু পরিবারের অধীনে ছিল। এর পর বাড়িটি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার অধিগ্রহণ করে। সংস্কার করে তা কলকাতার ‘নেতাজি ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ’-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
নেতাজির দুর্লভ ছবি, চিঠিপত্র আর ব্যবহৃত আসবাবপত্র নিয়ে এই সংগ্রহশালাটি উদ্বোধন হয় ২০০৫ সালে। ২০১৮ সালে সেই সংগ্রহশালার সংস্কারের কাজও হয়েছে।
নেতাজির এই বাড়িটার সঙ্গেই নিজেকে একাত্ম করে দিয়েছেন পদমবাহাদুর। তাঁর কথাবার্তা, আচার আচরণে বোঝা যায়, আশির কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া এই বৃদ্ধ নেতাজিকে কখনও না দেখলেও তাঁকে রোজ অনুভব করেন।
শত চেষ্টা করেও পদমবাহাদুরকে ক্যামেরার সামনে আনা গেল না।

১৯৭৩ থেকে এই বাড়িটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন পদমবাহাদুর। তখন দিনপ্রতি দু’ টাকা হাজিরায় বসুদের কাছ থেকে এই বাড়িটির দেখভালের দায়িত্ব পান।
-“তব মহিনে মে ষাট (৬০) রুপ্যায় মিলতা থা।” গলায় গর্ব ঝরে পড়েছিল।
এর পর বাড়িটা কত ঝড়ঝাপটার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তবুও তিনি ছিলেন তাঁর লক্ষ্যে অবিচল।
কথা প্রসঙ্গেই উঠে এসেছিল ১৯৮৬ সালের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের কথা। সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে সেই আন্দোলন মারাত্মক ধ্বংসাত্মক চেহারা নেয়। গত ১৫ বছরে গোর্খাল্যান্ড নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে, সুবাস ঘিসিংয়ের জঙ্গি আন্দোলনের কাছে সে সব নেহাতই শিশু।
তখনই পদমবাহাদুরের কাছে আন্দোলনকারীদের প্রস্তাব আসে এই বাড়ির এক একটা ইট বিক্রি করে দিয়ে বিনিময় টাকা নেওয়ার। আর প্রকারান্তরে সে টাকার কিছুটা অংশ আন্দোলনকারীদের দিয়ে দেওয়া।
পদম কিন্তু ছিলেন তাঁর লক্ষ্যে অবিচল। আন্দোলনকারীদের কথা কানেই তোলেননি তিনি। সোজা জানিয়ে দেন, নেতাজির স্মৃতিকে এ ভাবে ধুলোয় মিশে যেতে তিনি দেবেন না।
তাঁর কথায়, “মাত্র কয়েকটা টাকার জন্য নেতাজিতে বিকিয়ে দেব! আমি গরিব হতে পারি, লোভী নই।”
আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আপশোশ, কার্শিয়াংয়ের এক নেপালি বৃদ্ধ নেতাজির আদর্শে চলতে পারেন, কিন্তু আমরা পারি না। আজ ১২৫ বছরে পড়লেন নেতাজি। মুখে বড়ো বড়ো কথা বললেও, নেতাজির আদর্শে চলার ব্যাপারে আমরা লবডঙ্কা। কবে আমরা ওঁর আদর্শে চলব, ঠিক পদমবাহাদুরের মতো?
ছবি: লেখক
আরও পড়ুন: সুভাষের খোঁজে সুভাষগ্রাম ও অন্যত্র
প্রবন্ধ
শিল্পী – স্বপ্ন – শঙ্কা: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যেমন দেখেছি, ৮৭তম জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
স্বপ্ন বদলে যায়, হারিয়েও যায় – শঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়। আজ ওঁর জন্মদিন। আমরা প্রস্তুত তো? শিল্পীর স্বপ্ন সফল করতে?

ডা. পাঞ্চজন্য ঘটক
আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম না। আর পাঁচজন বাঙালির মতো ওঁর গুণমুগ্ধ ছিলাম। আজ ঠিক দু’ মাস চার দিন হল উনি চলে গেছেন। ওঁর মৃত্যু-পরবর্তী দিনগুলোয় অজস্র লেখা ও মূল্যায়ন দেখেছি। বিশেষ একটা ঘটনার কথা ভেবেছিলাম কেউ লিখবেন। এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তাই এই লেখা।
পর্দা আর মঞ্চ ছাড়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আমি দু’ বার দেখেছি কাছ থেকে। ২০১০ সালে লন্ডনে এবিপির উদ্যোগে ‘আনন্দ-উৎসব’ হয়। আমাদের উত্তর ইংল্যান্ডের ‘পারাবার কালচারাল গ্রুপ’ একটি ছোটো নাটকের কিছু অংশ মঞ্চে পরিবেশন করার আমন্ত্রণ পায়। তারকাখচিত সমাবেশ – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, সোহা আলি খান, কুমার শানু, অঞ্জন দত্ত. আইয়ুব বাচ্চু, অলকা ইয়াগনিক। এঁদের মতো তাবড় শিল্পীরা তিন দিন ধরে মঞ্চ আলো করে থাকবেন। দফায় দফায়। আর তার ভেতরে ফিলারের মতো থাকবে বিলেতের স্থানীয় সংগঠনের ছোটো ছোটো প্রোগ্রাম। আমাদের বলা হয়েছিল মিনিট পনেরোর ভেতর একটা নাটক করতে। বিলেতে এ রকম অনুষ্ঠান এর আগে কখনও হয়নি, পরেও নয়।
আমরা খুবই উত্তেজিত। আমাদের গ্রুপের তিন জনে মিলে একটা মজার নাটক করতাম – ‘রাজযোটক’। মিনিট চল্লিশের। সময় কম ছিল। তাই ওই নাটকের কিছু দৃশ্য কাটছাঁট করে মিনিট পনেরোর মতো একটা স্ক্রিপ্ট খাড়া করা হল। মার্চ মাসের মাঝামাঝি ‘পারাবার’ গোষ্ঠীর সবাই মিলে চললাম আনন্দোৎসবে। তিন জন নাটক করব। বাকিরা উৎসাহ দেবেন আর জমাটি একটি অনুষ্ঠান দেখবেন।
অনুষ্ঠানের দিন পৌঁছে গেলাম উত্তর লন্ডনের সুবিশাল আলেকজান্ড্রা প্যালেসে। আমাদের আর্টিস্ট এন্ট্রি কার্ড থাকায় মঞ্চের পেছন দিকে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। গ্রিনরুম দেখে আসার জন্য। মঞ্চের পেছনে অনেকটা এলাকা। কয়েকটা ঘর তারকাদের জন্য। আর বাকিদের ড্রেসআপ খোলা জায়গাতেই করতে হবে বুঝলাম। কয়েক জন উদ্যোক্তা গোছের লোক বড়ো বড়ো ব্যাজ পরে ব্যস্তভাব দেখিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। আমি বরাবর একটু উৎসুক গোছের। তারকাদের ঘরে কেউ আছে কিনা দেখতে গিয়ে দেখলাম একটির ভেতরে বসে আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পর্দা খোলাই ছিল। একেবারে সামনাসামনি ওঁকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেছিলাম। একটু সামলে উঠে বললাম, “ভেতরে আসব?” উনি বললেন, “এসো, এসো”।
সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রণাম করলাম পায়ে হাত দিয়ে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছিলেন। গরম চাদর গায়ে। চামড়ার বাঁধা স্যান্ডেল আর মোজা পায়ে। মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “ভালো থেকো”। পরিচয় জানতে চাইলেন। বললাম, “ডাক্তারি করি আর শখের অভিনয় মাঝেসাঝে। এই মঞ্চে পরের দিন একটা ছোট্ট নাটক করব। তেমন কিছু নয়। ফিলার প্রোগ্রাম। আমাদের নাটক আর কে দেখতে আসছে এখানে”।
একটু ক্লান্ত লাগছিল ওঁকে। ধীরে ধীরে বললেন, “কোনো নাটক ছোটো নয়। নাটকের কোনো রোল ছোটো নয়। একটা লোকও যদি না থাকে হলে, তুমি তোমার শ্রেষ্ঠ অভিনয় করবে। স্টেজটাকে সম্মান জানিয়ে”।
আরেক বার প্রণাম করলাম ওঁকে। বললাম, “এই কথাগুলো চিরকাল মনে রাখবো”। মনে হচ্ছিল উনি একটু বিশ্রাম করতে চাইছেন। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। কথাগুলো মনে রেখেছি। নাটক, শ্রুতি-নাটক, সিনেমা – যেটুকু সুযোগ পাই, নিজের পুরোটা দেওয়ার চেষ্টা করি।
একবার পেছনে তাকালাম। সোফায় মাথা এলিয়ে বিশ্রামের চেষ্টা করছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। স্কাইলাইট দিয়ে তেরছা সূর্যের আলো পড়েছে চোখের উপর। একবার ভাবলাম পর্দা টেনে দিই। মনে হল, না থাক। সূর্যের এই স্পটলাইট আরো অনেক দিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মুখের ওপর থাকুক। সরাসরি।
এর আগে এক বার

৬ ডিসেম্বর ১৯৯২। রবিবার। সন্ধ্যাবেলা খবর পাওয়া গেল বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। কলকাতায় দমচাপা পরিস্থিতি। সেই রাতে বিরাট দাঙ্গা কিছু হয়নি। মনে হয় দাঙ্গা শুরু হয় দিন কয়েক পর। পার্কসার্কাস অঞ্চলে ছিল আমাদের হোস্টেল। অশান্ত হয়ে ওঠে ওই অঞ্চল। কারফিউ, প্যারামিলিটারি, র্যাফ, মিলিটারি, আগুন, বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু – দিন কয়েকের ভেতর বদলে যায় আমাদের চেনা কলকাতা। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর প্রশাসনের তৎপরতায় দিন সাতেকের ভেতর দাঙ্গা আয়ত্তে আসে।
ঠিক মনে নেই তারিখটা – মনে হয় ১৩ বা ২০ ডিসেম্বর। রবিবার। বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে একটি শান্তিমিছিল আহ্বান করা হয়। একটু অন্য রকম এই মিছিল। বলা হয় কোনো দলীয় পতাকা, ফেস্টুন থাকবে না এই মিছিলে। থাকবে না কোনো দলীয় স্লোগান। এই শান্তিমিছিলের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা। মিছিলের রুট ঠিক মনে নেই, তবে শুনলাম দুপুর তিনটে নাগাদ আমাদের হোস্টেলের কাছ দিয়ে মিছিল যাবে। মল্লিকবাজার অঞ্চল দিয়ে সার্কুলার রোড ধরে দক্ষিণের দিকে। আমরা কয়েক জন ঠিক করলাম ওখানে মিছিলে যোগ দেব। একটু আগেভাগে নোনাপুকুর ট্রামডিপোর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। খানিক পর দেখলাম শীতের দুপুরের রোদ মেখে এগিয়ে আসছে এক মহামিছিল। কারো হাতে কোনো পতাকা নেই।
শুধু কয়েকটা স্লোগান শোনা যাচ্ছে –
‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, / দাঙ্গা নয় শান্তি চাই’।
‘দাঙ্গাবাজ লোক যত, / বাংলা থেকে দুর হটো’।
মিছিলের একদম সামনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নীল জিন্স পরা। গায়ে নীল জিন্সের পুরো হাতা জ্যাকেট। হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। চোখে কোনো সানগ্লাস নেই। কাছাকাছি সানগ্লাস চোখে কোনো সেলিব্রিটি চোখে পড়ল না। আশেপাশে সাধারণ মানুষ। হিন্দু, মুসলিম পোশাকে খানিকটা আলাদা বোঝা গেলেও স্লোগান সবার গলায় এক। আর তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আমরা মিছিলে প্রবেশ করলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঠিক পেছনে। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল ওঁর দিকে। চোয়াল শক্ত – কখনও মনে হচ্ছিল ‘হীরক রাজার দেশ’-এর উদয়ন পণ্ডিত, কখনও বা ফুটে উঠছিল ‘অভিযান’-এর নরসিং ড্রাইভারের চাপা অসন্তোষ। আর মাঝে মাঝে একটা ফরসা মুঠো করা হাত উঠে যাচ্ছিল শীতের নীল আকাশের দিকে – ‘দাঙ্গা নয়, শান্তি চাই’। সে দিনও কি পশ্চিম দিক থেকে সূর্যের তেরছা আলো পড়ছিল শিল্পীর মুখে? এত দিন পর ঠিক মনে করতে পারছি না।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে না চিনলেও ওঁর সঙ্গে মিছিলে হেঁটেছি। ওঁর গলায় গলা মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছি। এটা আমার একটা বিরাট গর্ব। বাঙালি অকুণ্ঠ সম্মান জানিয়েছেন তাঁদের প্রিয় শিল্পীকে। মৃত্যুর পর অমর করে দিয়েছেন। এখন ওঁর স্লোগানকে সত্যি করার দায়িত্ব বাঙালির ওপর।
স্বপ্ন বদলে যায়, হারিয়েও যায় – শঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়। আজ ওঁর জন্মদিন। আমরা প্রস্তুত তো? শিল্পীর স্বপ্ন সফল করতে?
(ছবিটি এঁকেছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ সোমজিত ঘোষ)
আরও পড়ুন: রবিবারের পড়া: শহর ছেড়ে তুমি কি চলে যেতে পারো তিন ভুবনের পারে
-
রাজ্য14 hours ago
পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করল তৃণমূল
-
শিক্ষা ও কেরিয়ার2 days ago
কেন্দ্রের নতুন শিক্ষানীতির আওতায় মাদ্রাসায় পড়ানো হবে গীতা, রামায়ণ, বেদ-সহ অন্যান্য বিষয়
-
শিক্ষা ও কেরিয়ার2 days ago
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ মামলায় নয়া মোড়, ফের কলকাতা হাইকোর্টে রাজ্য
-
গাড়ি ও বাইক20 hours ago
আরটিও অফিসে আর যেতে হবে না! চালু হল আধার ভিত্তিক যোগাযোগহীন পরিষেবা