প্রবন্ধ
‘ভাইপো’কে কেন ভয়?
ভাইপোকে ঘিরেই কোনো অশুভ বা বিপদের আশঙ্কা ঘণীভূত হয়েছে মুরলীধর সেন লেনে?


ভোটের আগে বাজার গরম করাটাই সব থেকে বড়ো কাজ। ভোটের ফলাফলে যা হবে, তা হবে। কিন্তু ভোটের আগে দল, দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে যে কোনো ইস্যুতেই গরমাগরম বুলি ঝেড়ে পিকচারে থাকতে হবে। একুশে নীলবাড়ি দখলে রাখা এবং দখল করার উভমুখী লক্ষ্যপূরণে সেই প্রক্রিয়াই শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্য-রাজনীতিতে।
একটু পিছনে তাকালে দেখা যাবে, শেষ কয়েকটি বিধানসভা ভোটে সব থেকে বেশি ব্যবহৃত শব্দগুলির মধ্যে অন্যতম ‘কৃষি ভিত্তি, শিল্প ভবিষ্যৎ’, ‘হার্মাদ’, ‘সিঙ্গুর’, ‘নন্দীগ্রাম’, ‘পরিবর্তন চাই’, ‘চিটফান্ড’, ‘সারদা’, ‘নারদা’ ইত্যাদি। এই তালিকা অবশ্য অতি দীর্ঘ। ভোট যত এগিয়ে আসে নিত্যনতুন শব্দ সংযোজিত হয় রাজনীতির কারবারিদের বুলির অভিধানে। এ বারে হাতে রয়েছে আরও বেশ কিছু সময়, তবে এখনই বেশ কিছু শব্দ শাসক-বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের মুখে-মুখে ঘুরছে। উপরতলা থেকে সেই সমস্ত শব্দ ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে নিচুতলায়।
করোনাভাইরাস নিয়ে একটা চাপা আতঙ্ক ছিল গত মাস আটেক সময় ধরে। লকডাউন উঠেছে, দোকানপাট, কলকারখানা, অফিস খুলেছে। বাস-ট্রেন-মেট্রো সবই চলছে। তবে ভোটের হাওয়া ঢুকতেই এখন করোনা থাকলেও সেই আতঙ্ক আর নেই। শীত ঢুকে পড়লেও ভোটের গরমে ফুটতে শুরু করেছে বাংলা। যত দিন গড়াবে, ততই উঠবে বাষ্প এবং বিষবাষ্প। অভিযোগ, পালটা অভিযোগ এবং অভিযোগ খণ্ডন করতে কতই না নিত্যনতুন শব্দের আমদানি হবে। এখন যা হচ্ছে।
আপাতত শাসক-বিরোধী তরজায় বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলির মধ্যে সেরার তালিকায় রয়েছে ‘বহিরাগত’ এবং ‘ভাইপো’। রাজ্যের শাসক দল নাম ধরে ধরে বলে দিচ্ছে কারা বহিরাগত। গায়ে লাগতেই বিজেপি নেতারা আবার পালটা দিচ্ছেন। রাজ্য-রাজনীতিতে শব্দটা পুরনো হলেও নতুন রূপে বিজেপির আমদানি ভাইপো। তৃণমূল বলছে, বুকের পাটা নেই নাম বলার, তাই ভাইপো বলছে।
২০২১ বিধানসভা ভোটকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গকে পাঁচটি জোনে ভাগ করে দলের পাঁচ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দায়িত্ব দিয়েছে বিজেপি। কিন্তু তাঁরা কেউ-ই এ রাজ্যের নন। তৃণমূলের অভিযোগ, যাঁরা রাজ্যের অলিগলি চেনেন না, তাঁদের দায়িত্ব দিয়ে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে, রাজ্য তাঁদের কোনো যোগ্য নেতা নেই। তাই বহিরাগতদের উড়িয়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সর্বোপরি বাংলার মানুষকে বোঝেন না। রাজ্যের মানুষ এ সব মোটেই মেনে নেবে না।
তৃণমূল এই ইস্যুতে লাগাতার আক্রমণ শানিয়েছে, পালটা দিয়েছে বিজেপি। ফলাফল দেখা যাচ্ছে, আখেরে লাভ হয়েছে তৃণমূলের। কারণ, হিন্দিভাষী ওই পাঁচ পর্যবেক্ষককে কয়েক দিনের জন্য সে ভাবে আর প্রকাশ্যে নিয়ে আসেনি বিজেপি। তৃণমূলের তুলে ধরা খামতিগুলো হয়তো পূরণের চেষ্টা চলছে গেরুয়া শিবিরে। তার পর আটঘাট বেঁধে পুরোদমে ময়দানে নামিয়ে দেওয়া হবে তথাকথিত ‘বহিরাগত’দের। এই কাজ দেশের সব থেকে ধনী রাজনৈতিক দলের কাছে মোটেই অসাধ্য নয়।
অন্য দিকে ভাইপো ইস্যুও আজকের নয়। তবে বিজেপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা যেমন অমিত শাহ, পশ্চিমবঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় থেকে শুরু করে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এই হাতিয়ার ব্যবহার করায় অন্য মাত্রা পেয়ে গিয়েছে ‘ভাইপো’।
এ বিষয়ে দিলীপের সাম্প্রতিক বক্তব্য, “ভালোবেসে ভাইপো বলা হয়। আমি বলছি খোকাবাবু। উনি কোলে চড়ে রাজনীতিতে এসেছেন। কোলে চড়ে এসে সাংসদ হয়েছেন। যাঁরা দলের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরা ব্রাত্য। সাধারণ মানুষ সব কিছু দেখছে”। ও দিকে ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ এবং মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি বলেছেন, “দিলীপ ঘোষ গুন্ডা। কৈলাস বিজয়বর্গীয়র ছেলে আকাশ বিজয়বর্গীয় গুন্ডা। অমিত শাহ, সুনীল দেওধররা বহিরাগত। ওরা ভাইপো-ভাইপো করছে, নাম ধরে বললে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছি। তাই নাম বলতে ভয় পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত নাম বলতে ভয় পান”।
সিপিএম নেতারাও বলছেন, “সবাই জানে কে এই ভাইপো”। কিন্তু বিজেপির নিশানায় থাকা ভাইপো যদি এই ভাইপো হন, তা হলেও রাজ্যের মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে বলে মনে হয় না। কারণ, এই ভাইপো যখন রাজনীতিতে ছিলেন না, তখন সেই ভাইপোরা ছিলেন। এই ভাইপো যখন থাকবেন না, তখন অন্য ভাইপোরা রাজনীতিতে থাকবেন। তফাতটা শুধু এ দিক আর ও দিককার।
গত বছরে লোকসভা ভোটের আগে গেরুয়া শিবিরে নাম লেখান রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যের ভাইপো অর্কদীপ। দার্জিলিংয়ের সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ আহলুওয়ালিয়ার হাত থেকে পতাকা নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ‘ভুল স্বীকার’ করে বিজেপি ছেড়েছিলেন দাপুটে সিপিএম নেতার ভাইপো।
এই তো ক’ সপ্তাহ আগে বিজেপিতে যোগ দিলেন প্রাক্তন বিধায়ক সুভাষ মাহাতোর ছেলে সিদ্ধার্থ। পরের সপ্তাহেই দলবদল করলেন তাঁর ভাই সুব্রত। দু’জনেই সম্পর্কে বাগমুণ্ডির কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল মাহাতোর ভাইপো। যা দেখে কাকা নেপাল জোরের সঙ্গে জানিয়েছেন, ভাইয়ে-ভাইয়ে বিভেদের চেষ্টা করে লাভ হবে না, বাঘমুণ্ডিতে কংগ্রেসই বিপুল ব্যবধানে জিতবে।
চলতি মাসেই সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম উঠে আসেন পশ্চিম বর্ধমান জেলার বিজেপির সভাপতির ভাইপো। বিজেপি নেতা লক্ষ্মণ ঘোড়ুইয়ের ভাইপো, সহদেব ঘোড়ুইয়ের বিরুদ্ধে দলীয় কর্মীর মেয়েকে ধর্ষণ-ব্ল্যাকমেলের অভিযোগ ওঠে। তাঁর বাড়িতে আদালতের সমনও যায়। ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে হাজিরা দিতে বলা হয়। রাজনীতিতে ভাইপো, এবং অভিযোগের নিশানায় এমন ভাইপোদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ওয়েটের দিক থেকে কোথাও ‘হেভি’ আর কোথাও ‘লাইট’।
ক’দিন আগেই যেমন গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত মনোহর পর্রীকরের ভাইপো অখিল সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিলেন আয়ুষমন্ত্রী শ্রীপদ নায়েকের বিরুদ্ধে মুখ খুলে। নায়েকের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ তুলে একটি ভিডিও পোস্ট করেন বিজেপি নেতা অখিল। বলেন, মন্ত্রীর নিজের কেন্দ্রটিই তাঁর কাছে উপেক্ষিত। ভোটে জেতার পর তিনি না কি ওই কেন্দ্র থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। বিতর্ক সামাল দিতে অখিলকে ‘শিশু’ এবং তাঁর আচরণকে ‘শিশুসুলভ’ তকমা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
আবার উত্তরপ্রদেশে কাকা-ভাইপোর সম্পর্কের নরম-গরম সম্পর্ক অনেকের কাছেই চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে প্রায়শই। কাকা শিবপাল যাদব এবং ভাইপো অখিলেশ সিংহ যাদবের নাটকীয় বিচ্ছেদ এবং সন্ধি নতুন কিছু নয়! দু’জনের রাজনৈতিক উঠোন ভিন্ন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে ফের কাছাকাছি আসছে মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি এবং শিবপালের প্রগতিশীল সমাজবাদী পার্টি। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোট ২০২২-এ, তার আগেই অবশ্য একুশের মহারণ এ রাজ্যে। ইস্যু আসবে, ইস্যু তলিয়েও যাবে। কিন্তু একটা ইস্যুকে জাগিয়ে রাখতে হবে আর একটা ইস্যু আসা না পর্যন্ত। এই এখন যেমন চলছে ‘বহিরাগত’ অথবা ‘ভাইপো’কে ঘিরে।
তবে গেরুয়া শিবিরের সমালোচনা শুনে মনে হতে পারে, ভাইপোর জন্য রাজ্যের শাসক দলের ভাবমূর্তির ক্ষতি হচ্ছে এবং হবে, এমন আশঙ্কায় তৃণমূলের থেকেও যেন বেশি চিন্তিত বিজেপি। বদনামের বিষোদ্গার করে ভাইপোকে রোখা, না কি তৃণমূলকে ভাইপোমুক্ত করে স্বস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বিজেপি, আক্রমণের ধরনে সেটাই মাঝেমধ্যে ঘুলিয়ে যাচ্ছে।
বিজেপি কেন্দ্রে। তার হাতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। ফলে কখন কয়লা আর কখন গোরু পাচার নিয়ে তদন্ত হবে, সেটা তারাই স্থির করবে। সেই সূত্র ধরেই ভোটের মুখে এই পাচারের নেপথ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কাঠগড়ায় তুলে আক্রমণ শানাতেই পারে বিজেপি। তবে এগুলো যতটা পরিষ্কার, ততটা পরিষ্কার নয় ভাইপোর কারণে তৃণমূল থেকে কয়েকজন নেতামন্ত্রীর ছেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিতে বিজেপির মুষড়ে পড়ার ঘটনা। তা হলে কি, ‘দিদি’র দিকে থেকে বিজেপির ভয়ের অভিমুখ এখন ঘুরছে ‘ভাইপো’র দিকেই? ভাইপোকে ঘিরেই কোনো অশুভ বা বিপদের আশঙ্কা ঘণীভূত হয়েছে মুরলীধর সেন লেনে?
আরও পড়তে পারেন: সামনে ভোট, বরাদ্দ-ব্যবসা তো জমবেই!
প্রবন্ধ
শিল্পী – স্বপ্ন – শঙ্কা: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যেমন দেখেছি, ৮৭তম জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
স্বপ্ন বদলে যায়, হারিয়েও যায় – শঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়। আজ ওঁর জন্মদিন। আমরা প্রস্তুত তো? শিল্পীর স্বপ্ন সফল করতে?

ডা. পাঞ্চজন্য ঘটক
আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম না। আর পাঁচজন বাঙালির মতো ওঁর গুণমুগ্ধ ছিলাম। আজ ঠিক দু’ মাস চার দিন হল উনি চলে গেছেন। ওঁর মৃত্যু-পরবর্তী দিনগুলোয় অজস্র লেখা ও মূল্যায়ন দেখেছি। বিশেষ একটা ঘটনার কথা ভেবেছিলাম কেউ লিখবেন। এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তাই এই লেখা।
পর্দা আর মঞ্চ ছাড়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আমি দু’ বার দেখেছি কাছ থেকে। ২০১০ সালে লন্ডনে এবিপির উদ্যোগে ‘আনন্দ-উৎসব’ হয়। আমাদের উত্তর ইংল্যান্ডের ‘পারাবার কালচারাল গ্রুপ’ একটি ছোটো নাটকের কিছু অংশ মঞ্চে পরিবেশন করার আমন্ত্রণ পায়। তারকাখচিত সমাবেশ – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, সোহা আলি খান, কুমার শানু, অঞ্জন দত্ত. আইয়ুব বাচ্চু, অলকা ইয়াগনিক। এঁদের মতো তাবড় শিল্পীরা তিন দিন ধরে মঞ্চ আলো করে থাকবেন। দফায় দফায়। আর তার ভেতরে ফিলারের মতো থাকবে বিলেতের স্থানীয় সংগঠনের ছোটো ছোটো প্রোগ্রাম। আমাদের বলা হয়েছিল মিনিট পনেরোর ভেতর একটা নাটক করতে। বিলেতে এ রকম অনুষ্ঠান এর আগে কখনও হয়নি, পরেও নয়।
আমরা খুবই উত্তেজিত। আমাদের গ্রুপের তিন জনে মিলে একটা মজার নাটক করতাম – ‘রাজযোটক’। মিনিট চল্লিশের। সময় কম ছিল। তাই ওই নাটকের কিছু দৃশ্য কাটছাঁট করে মিনিট পনেরোর মতো একটা স্ক্রিপ্ট খাড়া করা হল। মার্চ মাসের মাঝামাঝি ‘পারাবার’ গোষ্ঠীর সবাই মিলে চললাম আনন্দোৎসবে। তিন জন নাটক করব। বাকিরা উৎসাহ দেবেন আর জমাটি একটি অনুষ্ঠান দেখবেন।
অনুষ্ঠানের দিন পৌঁছে গেলাম উত্তর লন্ডনের সুবিশাল আলেকজান্ড্রা প্যালেসে। আমাদের আর্টিস্ট এন্ট্রি কার্ড থাকায় মঞ্চের পেছন দিকে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। গ্রিনরুম দেখে আসার জন্য। মঞ্চের পেছনে অনেকটা এলাকা। কয়েকটা ঘর তারকাদের জন্য। আর বাকিদের ড্রেসআপ খোলা জায়গাতেই করতে হবে বুঝলাম। কয়েক জন উদ্যোক্তা গোছের লোক বড়ো বড়ো ব্যাজ পরে ব্যস্তভাব দেখিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। আমি বরাবর একটু উৎসুক গোছের। তারকাদের ঘরে কেউ আছে কিনা দেখতে গিয়ে দেখলাম একটির ভেতরে বসে আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পর্দা খোলাই ছিল। একেবারে সামনাসামনি ওঁকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেছিলাম। একটু সামলে উঠে বললাম, “ভেতরে আসব?” উনি বললেন, “এসো, এসো”।
সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রণাম করলাম পায়ে হাত দিয়ে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছিলেন। গরম চাদর গায়ে। চামড়ার বাঁধা স্যান্ডেল আর মোজা পায়ে। মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “ভালো থেকো”। পরিচয় জানতে চাইলেন। বললাম, “ডাক্তারি করি আর শখের অভিনয় মাঝেসাঝে। এই মঞ্চে পরের দিন একটা ছোট্ট নাটক করব। তেমন কিছু নয়। ফিলার প্রোগ্রাম। আমাদের নাটক আর কে দেখতে আসছে এখানে”।
একটু ক্লান্ত লাগছিল ওঁকে। ধীরে ধীরে বললেন, “কোনো নাটক ছোটো নয়। নাটকের কোনো রোল ছোটো নয়। একটা লোকও যদি না থাকে হলে, তুমি তোমার শ্রেষ্ঠ অভিনয় করবে। স্টেজটাকে সম্মান জানিয়ে”।
আরেক বার প্রণাম করলাম ওঁকে। বললাম, “এই কথাগুলো চিরকাল মনে রাখবো”। মনে হচ্ছিল উনি একটু বিশ্রাম করতে চাইছেন। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। কথাগুলো মনে রেখেছি। নাটক, শ্রুতি-নাটক, সিনেমা – যেটুকু সুযোগ পাই, নিজের পুরোটা দেওয়ার চেষ্টা করি।
একবার পেছনে তাকালাম। সোফায় মাথা এলিয়ে বিশ্রামের চেষ্টা করছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। স্কাইলাইট দিয়ে তেরছা সূর্যের আলো পড়েছে চোখের উপর। একবার ভাবলাম পর্দা টেনে দিই। মনে হল, না থাক। সূর্যের এই স্পটলাইট আরো অনেক দিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মুখের ওপর থাকুক। সরাসরি।
এর আগে এক বার

৬ ডিসেম্বর ১৯৯২। রবিবার। সন্ধ্যাবেলা খবর পাওয়া গেল বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। কলকাতায় দমচাপা পরিস্থিতি। সেই রাতে বিরাট দাঙ্গা কিছু হয়নি। মনে হয় দাঙ্গা শুরু হয় দিন কয়েক পর। পার্কসার্কাস অঞ্চলে ছিল আমাদের হোস্টেল। অশান্ত হয়ে ওঠে ওই অঞ্চল। কারফিউ, প্যারামিলিটারি, র্যাফ, মিলিটারি, আগুন, বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু – দিন কয়েকের ভেতর বদলে যায় আমাদের চেনা কলকাতা। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর প্রশাসনের তৎপরতায় দিন সাতেকের ভেতর দাঙ্গা আয়ত্তে আসে।
ঠিক মনে নেই তারিখটা – মনে হয় ১৩ বা ২০ ডিসেম্বর। রবিবার। বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে একটি শান্তিমিছিল আহ্বান করা হয়। একটু অন্য রকম এই মিছিল। বলা হয় কোনো দলীয় পতাকা, ফেস্টুন থাকবে না এই মিছিলে। থাকবে না কোনো দলীয় স্লোগান। এই শান্তিমিছিলের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা। মিছিলের রুট ঠিক মনে নেই, তবে শুনলাম দুপুর তিনটে নাগাদ আমাদের হোস্টেলের কাছ দিয়ে মিছিল যাবে। মল্লিকবাজার অঞ্চল দিয়ে সার্কুলার রোড ধরে দক্ষিণের দিকে। আমরা কয়েক জন ঠিক করলাম ওখানে মিছিলে যোগ দেব। একটু আগেভাগে নোনাপুকুর ট্রামডিপোর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। খানিক পর দেখলাম শীতের দুপুরের রোদ মেখে এগিয়ে আসছে এক মহামিছিল। কারো হাতে কোনো পতাকা নেই।
শুধু কয়েকটা স্লোগান শোনা যাচ্ছে –
‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, / দাঙ্গা নয় শান্তি চাই’।
‘দাঙ্গাবাজ লোক যত, / বাংলা থেকে দুর হটো’।
মিছিলের একদম সামনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নীল জিন্স পরা। গায়ে নীল জিন্সের পুরো হাতা জ্যাকেট। হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। চোখে কোনো সানগ্লাস নেই। কাছাকাছি সানগ্লাস চোখে কোনো সেলিব্রিটি চোখে পড়ল না। আশেপাশে সাধারণ মানুষ। হিন্দু, মুসলিম পোশাকে খানিকটা আলাদা বোঝা গেলেও স্লোগান সবার গলায় এক। আর তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আমরা মিছিলে প্রবেশ করলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঠিক পেছনে। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল ওঁর দিকে। চোয়াল শক্ত – কখনও মনে হচ্ছিল ‘হীরক রাজার দেশ’-এর উদয়ন পণ্ডিত, কখনও বা ফুটে উঠছিল ‘অভিযান’-এর নরসিং ড্রাইভারের চাপা অসন্তোষ। আর মাঝে মাঝে একটা ফরসা মুঠো করা হাত উঠে যাচ্ছিল শীতের নীল আকাশের দিকে – ‘দাঙ্গা নয়, শান্তি চাই’। সে দিনও কি পশ্চিম দিক থেকে সূর্যের তেরছা আলো পড়ছিল শিল্পীর মুখে? এত দিন পর ঠিক মনে করতে পারছি না।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে না চিনলেও ওঁর সঙ্গে মিছিলে হেঁটেছি। ওঁর গলায় গলা মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছি। এটা আমার একটা বিরাট গর্ব। বাঙালি অকুণ্ঠ সম্মান জানিয়েছেন তাঁদের প্রিয় শিল্পীকে। মৃত্যুর পর অমর করে দিয়েছেন। এখন ওঁর স্লোগানকে সত্যি করার দায়িত্ব বাঙালির ওপর।
স্বপ্ন বদলে যায়, হারিয়েও যায় – শঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়। আজ ওঁর জন্মদিন। আমরা প্রস্তুত তো? শিল্পীর স্বপ্ন সফল করতে?
(ছবিটি এঁকেছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ সোমজিত ঘোষ)
আরও পড়ুন: রবিবারের পড়া: শহর ছেড়ে তুমি কি চলে যেতে পারো তিন ভুবনের পারে
প্রবন্ধ
একুশের মহারণ কি শুধুই তৃণমূল বনাম বিজেপি?
নির্বাচনী লড়াইটা শুধু মাত্র তৃণমূল-বিজেপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তেমন উপসংহারে এখনই পৌঁছানো সম্ভব নয়!

খবর অনলাইন ডেস্ক: প্রচারের বহর দেখে মনে হতেই পারে, মাস কয়েক বাদের বিধানসভা ভোটে মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল এবং বিজেপি। এই দুই দলের গুঁতোগুঁতিতে ভুগতে পারে কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের শরিক দলগুলি। কিন্তু নির্বাচনী লড়াইটা শুধু মাত্র তৃণমূল-বিজেপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তেমন উপসংহারে এখনই পৌঁছোনো সম্ভব নয় বলেই ধারণা রাজনৈতিক মহলের।
বাম ও কংগ্রেস যে নির্বাচনী জোট গড়ছে, সেটাও এক প্রকার নিশ্চিত। কিন্তু আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা চলছে। ফলে দুই শক্তি যদি একত্রিত হয়, তা হলে একাধিক আসনে তৃণমূল-বিজেপির জয়ের পথে কাঁটা হতে পারে এই বিরোধী জোট। এ কথা ঠিক, অঙ্কের জটিল হিসেব অনেকাংশেই ভোটের বাক্সে সে ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে না। তবুও শেষ বছরে রাজ্যের সব থেকে বড়ো কয়েকটি নির্বাচনের সংক্ষিপ্ত ফলাফলে নজর বুলিয়ে নেওয়া যেতেই পারে।
বিধানসভা নির্বাচন ২০১১
তৃণমূল-৩৮.৯৩ শতাংশ, আসন-১৮৪
সিপিএম-৩০.০৮ শতাংশ, আসন-৪০
বিজেপি-৪ শতাংশ, আসন-০
কংগ্রেস-৯.০৯, আসন-৪২
লোকসভা নির্বাচন ২০১৪
তৃণমূল-৩৯.০৫ শতাংশ, আসন-৩৪
সিপিএম-২৯.৭১ শতাংশ, আসন-২
বিজেপি-১৭.০২ শতাংশ, আসন-২
কংগ্রেস-৯.৫৮, আসন-৪
বিধানসভা নির্বাচন ২০১৬
তৃণমূল-৪৪.৯১ শতাংশ, আসন-২১১
সিপিএম-১৯.৭৫ শতাংশ, আসন-২৬
কংগ্রেস-১২.২৫, আসন-৪৪
বিজেপি-১০.১৬ শতাংশ, আসন-৩
লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
তৃণমূল-৪৩.৬৯ শতাংশ, আসন-২২
বিজেপি-৪০.৬৪ শতাংশ, আসন-১৮
বামফ্রন্ট-৬.৩৪ শতাংশ, আসন-০
কংগ্রেস-৫.৬৭, আসন-২
লোকসভা ভোটের সাফল্য ধরে রেখে প্রথম বারের জন্যে রাজ্যের ক্ষমতা দখলে নেমেছে বিজেপি। পরিস্থিতি এমনই যে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা বঙ্গ-সফরকে কার্যত রুটিনে পরিণত করে নিয়েছেন। শাসকদলের একাধিক হেভিওয়েট গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়েছেন। মিটিংয়ে-মিছিলে গেরুয়া পতাকার ভিড় উপচে পড়ছে।
তবে ২০২১ বিধানসভায় যে শেষ লোকসভার থেকে বিজেপির ভোটের হার কমতে পারে, সে বিষয়েও একাধিক যুক্তি রয়েছে পরিসংখ্যানপ্রেমীদের ঝুলিতে। সঙ্গে রয়েছে ভিন রাজ্যের সাম্প্রতিক বিধানসভা ভোটগুলির পরিসংখ্যানও। আসলে দেশে এমন কোনো রাজ্য নেই, যেখানে বিধানসভায় বিজেপির ভোট লোকসভার থেকে বেড়েছে। অর্থাৎ, ঘুরিয়ে বললে সর্বত্রই লোকসভার থেকে ভোট কমেছে বিধানসভায়।
কয়েকটি রাজ্যে শেষ লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট
বিহার: লোকসভা (২০১৯)-৫৩.২৫ শতাংশ, বিধানসভা (২০২১)-৩৭ শতাংশ (এনডিএ-গত ভাবে)
দিল্লি: লোকসভা (২০১৯)- ৫৬.৮৬ শতাংশ, বিধানসভা (২০১৯)-৩৮.৫১ শতাংশ
ঝাড়খণ্ড: লোকসভা (২০১৯)- ৫৫ শতাংশ, বিধানসভা (২০১৯)-৩৩ শতাংশ
হরিয়ানা: লোকসভা (২০১৯)- ৫৮ শতাংশ, বিধানসভা (২০১৯)-৩৬ শতাংশ
মহারাষ্ট্র: লোকসভা (২০১৯)- ৫১ শতাংশ, বিধানসভা (২০১৯)-৪২ শতাংশ
উপরের পরিসংখ্যান তুলে ধরার কারণ দ্বিমুখী। একটি দিক হল, বিজেপি যদি পশ্চিমবঙ্গের ২০১৯ সালের লোকসভা সাফল্য ধরে রাখে অথবা আরও এগোয়, তা হলে তৃণমূলের প্রত্যাবর্তনের পথ অবরুদ্ধ হতেই পারে। কিন্তু উলটো দিকে অন্যান্য রাজ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ২০২১-এ বিজেপির প্রাপ্ত ভোট যদি কমে যায়, তা কোথায় যাবে?
শেষ বছরে তৃণমূলের ভোটের হার কিন্তু ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। বিজেপির ঝুলি পূর্ণ করতে বাম-কংগ্রেসই নি:স্ব হয়েছিল। যে কারণে তৃণমূল অভিযোগ করছে, বাম-কংগ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নকে খাটো করতে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আবার উলটো কথা শোনা যাচ্ছে বিজেপি নেতৃত্বের মুখেও। তাঁরাও বলছেন, বাম-কংগ্রেসকে অক্সিজেন জোগাচ্ছেন মমতা। অর্থাৎ, সে দিকে সরাসরি দুই মূল প্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ের অবকাশ থাকছে না। অঙ্কের হিসেব যা-ই বলুক, তৃতীয় বিকল্প হিসেবে কিন্তু ভেসে থাকছে বাম-কংগ্রেসই।
আরও পড়তে পারেন: রাজ্যে বাম-কংগ্রেস জোটে সিলমোহর সনিয়া গান্ধীর
প্রবন্ধ
শুধু ‘ভেটকির পাতুরি’র লোভে নয়, মন ফিরুক প্রকৃত সুন্দরবনে…

নিজস্ব প্রতিনিধি: “ভেটকির পাতুরি, পাবদার ঝাল, কাতলার কালিয়া, আমুদি মাছ ভাজা… লুচি, তরকারি… ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন… পাঁঠার ঝোল…”।
সুন্দরবন মানেই এখন এই সব। প্রচুর ভ্রমণ সংস্থা ইদানীং সুন্দরবন প্যাকেজের আয়োজন করছে। গত তিন-চার বছরে তা মারাত্মক ভাবে বেড়ে গিয়েছে। কিছু ভ্রমণসংস্থা অবশ্যই বাঁধা গতের বাইরে বেরিয়ে পর্যটকদের জন্য অন্য রকম স্বাদের ভ্রমণের আয়োজন করে। কিন্তু বেশির ভাগ প্যাকেজই বাঁধাধরা গতে চলছে। আর বাঁধাধরা গত বলতে যেখানে খাবারের তালিকা ঘোরাঘুরির থেকে বেশি প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে।
রবিবার, সুন্দরবনে ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ৩৫ জনের একটি পর্যটকদল বেড়াতে এসেছিল সুন্দরবনে। এ দিন তাঁরা নামখানা থেকে রওনা হয়েছিলেন। রামগঙ্গা থেকে বন দফতরের অনুমতি নিয়ে দলটি যখন আজমলমারি জঙ্গলের উদ্দেশে যাচ্ছিল, তখন জলযানে রান্না হচ্ছিল। বনি ক্যাম্পের কাছাকাছি যাওয়ার সময় গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে আগুন লেগে যায়।
বরাত জোরে বেঁচে যান সব পর্যটকই। কাছেই একটি মৎস্যজীবীর ট্রলার ছিল বলে এ যাত্রায় রক্ষে হয়। কিন্তু এই ঘটনা সুন্দরবন ভ্রমণের নিরাপত্তা নিয়ে মারাত্মক প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল। সময় কি আসেনি সুন্দরবনকে অন্য রকম ভাবে চেনার?
‘সুন্দরবনের গল্প শোনার কান তৈরি করা হোক’
ভ্রমণ-ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত সৌরভ নায়েক। কিন্তু এই ধরনের বাঁধা গতের ভ্রমণের আয়োজন করতে তাঁর খুব একটা সায় নেই। একই সঙ্গে যদিও ভ্রমণার্থীদের চাহিদাটাও দেখতে হবে বলে মত তাঁর।
সৌরভের কথায়, “একটা জিনিস আমাদের বুঝতে হবে, চাহিদা অনুযায়ীই জোগান তৈরি হয়। অপারেটরদের কাছেও প্রশ্ন আসে ‘দাদা খাওয়ার মেনু কী আছে?’ সুতরাং খাওয়ার মেনুতে টান পড়া মানে প্রতিযোগিতার বাজারে তার বিজ্ঞাপন পিছিয়ে পড়বে।”
কী ভাবে সমাধান হবে এই সমস্যার। সৌরভ বলেন, “ট্রলার দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা সবার আগে জরুরি। এবং সেফটি রুলস কঠোর ভাবে যাতে মেনে চলা হয় তার নজরদারির ব্যবস্থা করা উচিত সরকারের তরফ থেকে। ট্যুরের জন্য নির্দিষ্ট মানের রেজিস্টার্ড ট্রলারকেই একমাত্র পার্মিশন দেওয়া উচিত।”

দিন দুয়েক আগেই দময়ন্তী সেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। যাদের মূল কাজ হল সুন্দরবন বায়োডাইভার্সিটি যাতে কোনো ভাবেই নষ্ট না হয়ে যায় এবং অনিয়ন্ত্রিত ভাবে রিসর্ট বা হোটেল গজিয়ে না ওঠে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা। হাইকোর্টের এই রায় অত্যন্ত ভালো একটা দিক, মনে করেন সৌরভ।
ভ্রমণ-ব্যবসায়ীদের কাছেও তাঁর বিশেষ আবেদন, “শুধু খাওয়াদাওয়া, ফূর্তি করার জায়গা হিসেবে সুন্দরবনকে প্রাধান্য না দিয়ে ভ্রমণের অন্য দিকগুলোকেও তুলে ধরার চেষ্টা করা হোক। খাওয়া কমিয়ে দিতে বলা হচ্ছে না এতে। কিন্তু সেটাই যাতে মূল বিষয় না হয়ে ওঠে সেটা মাথায় রাখা হোক, সম্ভব হলে দু’ রাত তিন দিনের বাঁধাধরা রুটের বাইরে বেরিয়ে অন্য কিছু অফবিট লোকেশনকেও সামনে তুলে আনা হোক। সুন্দরবনেরও অনেক গল্প বলার থাকে সেগুলো শোনার কান তৈরি করা হোক।”
‘মন ফিরুক সুন্দরবনে’
বাংলার বিভিন্ন দিক চষে বেড়ানো ভ্রামণিক সঞ্জয় গোস্বামী কিন্তু মনে করেন সুন্দরবনের অন্যান্য দিক তুলে না ধরলে অচিরেই পর্যটকের আগমন বন্ধ হয়ে যাবে।
তাঁর প্রশ্ন, আজকের মানুষের চাহিদা কি শুধু খাবারের মেনুতেই আবদ্ধ? তাঁর কথায়, “সুন্দরবনকে আবিষ্কার না করে কি শুধু ঝালে-ঝোলে-অম্বলেই তাঁকে খুঁজে নেব?”
তাঁর বক্তব্য, “মনে রাখতে হবে সুন্দরবন ট্যুরিজম অন্য সব ট্যুরিজম সেক্টরের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। মানুষের কাছে সুন্দরবনের বিভিন্ন দিক তুলে না ধরলে অচিরেই কিন্তু পর্যটকদের আসা বন্ধ হতে পারে। কারণ তাদের সামনে সুন্দরবনের প্রকৃত রূপ তুলে না ধরলে একই পর্যটক বার বার যাবেন না, এবং তাতে স্যাচুরেশন আসতে বাধ্য।”
তিনি বলেন, “মানুষেরও ভাবা দরকার যে কেন যাচ্ছি সুন্দরবনে? এটা আর চারটে পর্যটনস্থানের মতো নয়, যেখানে গিয়ে মদ মাংসে শেষ হতে পারে দিন।”
ভ্রমণপ্রিয় মানুষ এবং ভ্রমণ-ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সবার কাছে সঞ্জয়বাবুর আবেদন, “আসুন আমরা সবাই মিলে নতুন সুন্দরবনকে সবার সামনে তুলে ধরি এবং নতুন ভাবে চেনার চেষ্টা করি। মাছ, মাংস, কাঁকড়া, ভেটকি, ইলিশ এ সব পালাচ্ছে না, সবই থাকবে। কিন্তু মনটাই যদি না থাকে পেট থেকেও লাভ নেই। মন ফিরুক সুন্দরবনে।”
অন্য চিন্তাধারাও ধীরে ধীরে আসছে
বাঁধা গতের বাইরে বেরিয়ে কিছুটা অন্য চিন্তাধারাও এ বার সামনে আসছে। কিন্তু তা এখনও পর্যন্ত খুবই কম। জানুয়ারি মাসে সুন্দরবন ভ্রমণে নিয়ে যাচ্ছে একটি ভ্রমণ সংস্থা। তাদের প্যাকেজে কিন্তু কোনো ভাবেই খাবারের তালিকাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি।

বরং তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে স্থানীয়দের সঙ্গে কথোপকথন, সুন্দরবনের মানুষের জীবনসংগ্রামের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। ওই সংস্থার কর্ণধার বলেন, “বেড়াতে গিয়ে যদি স্থানীয় মানুষের সঙ্গেই না মিশলাম তা হলে ভ্রমণের উদ্দেশ্যই তো সফল হল না।”
ঠিক এই বদলটাই দরকার। খাওয়াদাওয়া তো চলবেই। বাঙালির ভ্রমণে খাওয়া তো অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে, খাওয়ার লোভে গিয়ে বাঙালি যেন শুধু ‘পর্যটক’-এই নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে ‘ভ্রামণিক’ হতে পারেন।
খবরঅনলাইনে আরও পড়তে পারেন
কৃষকরা কেন প্রতিবাদ করছেন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কী করতে পারেন
-
রাজ্য2 days ago
বুধবার রাজ্যে আসছে নির্বাচন কমিশনের ফুল বেঞ্চ
-
কলকাতা3 days ago
এ বার সারা দিনের পাসে বাস-ট্রাম-ফেরিতে কলকাতা ভ্রমণ
-
দেশ3 days ago
প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকদের ট্র্যাক্টর মিছিলে স্থগিতাদেশ দিল না সুপ্রিম কোর্ট
-
প্রবন্ধ2 days ago
শিল্পী – স্বপ্ন – শঙ্কা: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যেমন দেখেছি, ৮৭তম জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য