
জেসমিন প্রেমা
দু’ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ব জুড়ে করোনা অতিমারির প্রাদুর্ভাব ছিল। তখন সাধারণ মানুষের চলাফেরা সীমিত পর্যায়ে নেমে যায়। কিন্তু যুদ্ধ, সহিংসতা, নিপীড়ন আর মানবাধিকার লঙ্ঘন-সহ বিভিন্ন কারণে ৩০ লক্ষেরও বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থীর খাতায় নাম লিখিয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুসারে ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ২৪ লক্ষ। বিশ্বের মোট শরণার্থীর মধ্যে তুরস্কই একক ভাবে আশ্রয় দিয়েছে ৩৬ লক্ষ মানুষকে। একটি দেশে আশ্রয় পাওয়া শরণার্থী-সংখ্যায় এটি পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ থেকে ২০২০, এই সময়ে শরণার্থী হিসেবে ১০ লক্ষ শিশু জন্ম নিয়েছে।
২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয়, ২০০১ সালের ২০ জুন থেকে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস (World Refugee Day) হিসেবে পালন করা হবে। এই দিনটি বেছে নেওয়ার কারণ হল, ১৯৫১ সালে শরণার্থীদের অবস্থান নির্ণয়-বিষয়ক একটি কনভেনশনের ৫০ বছর পূর্তি হয় ২০০১ সালে। অবশ্য ২০০০ সাল পর্যন্ত আফ্রিকান শরণার্থী দিবস নামে একটি দিবস কয়েকটি দেশে পালন করা হত, যা এখন রাষ্ট্রপুঞ্জের মাধ্যমে বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। এখন বিশ্বের মাথাব্যাথার অন্যতম কারণ শরণার্থী।
রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর, UNHCR) গত ২৩ মে এক বিবৃতিতে বলেছে যে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে ৬০ লক্ষেরও বেশি মানুষ ইউক্রেন থেকে পালিয়ে গেছে। এই নিয়ে বিশ্বে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রথম বার ১০ কোটি ছুঁয়েছে।

ইউএনএইচসিআর বিবৃতিতে আরও বুলেছে, বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক। এই সংখ্যা বিশ্বকে যুদ্ধ বন্ধের তাগিদ দিচ্ছে। যুদ্ধ রেকর্ডসংখ্যক মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের এই সংখ্যাকে সতর্কবার্তা তথা ‘ওয়েক-আপ-কল’ বলে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী সংস্থার হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি (Filippo Grandi)।
বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ ও সংঘাতে খাদ্য সংকট বাড়ছে। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক এগেনস্ট ফুড ক্রাইসিস (global network against food crises), রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (Food and Agricultural Organisation, FAO), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (World Food Programme) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (European Union, EU) সমন্বয়ে গঠিত সংস্থাটি সম্প্রতি পৃথিবীব্যাপী খাদ্য সংকট নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, চলমান যুদ্ধ, সহিংসতা এবং নিপীড়ন ইত্যাদি কারণে খাদ্যসংকটের পাশাপাশি শরণার্থীর নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে ৫৩টি দেশ বা অঞ্চলের প্রায় ১৯.৩ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটের মধ্যে ছিল। ২০২০ সালের তুলনায় এ ধরনের মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪ কোটি। যার মধ্যে রয়েছে ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কারের দক্ষিণাংশ, দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেনের পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। এ সব দেশের মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। অনাহার ও মৃত্যু বন্ধ করার জন্য এবং জীবিকার পথ সচল করার জন্য ওই প্রতিবেদনে জরুরি পদক্ষেপ করার আবেদন জানানো হয়।
জলবায়ু সংকট, পরিবেশ বিপর্যয়, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে এমন চিত্র সামনে এসেছে। ২০২১ সালে নানা সংঘাতের কারণে সব চেয়ে বেশি মানুষ খাদ্যসংকটে পড়েছে। পৃথিবীর ২৪টি দেশের ১৩.৯ কোটি মানুষকে তীব্র খাদ্যসংকটের মুখে ঠেলে দেয়। ২০২০ সালে ২৩টি অঞ্চলের ৯.৯ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে পড়েছিল। এক বছরে নতুন করে খাদ্যসংকটের মিছিলে যুক্ত হয় আরও ৪ কোটি মানুষ।
রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা শরণার্থীর ৭০ শতাংশই পাঁচটি দেশের। যার মধ্যে সিরিয়া ৬৮ লক্ষ, ভেনেজুয়েলা ৪৯ লক্ষ, আফগানিস্তান ২৮ লক্ষ, দক্ষিণ সুদান ২২ লক্ষ এবং মায়ানমার থেকে ১১ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে।
এ সব মানুষকে তাৎক্ষণিক সুরক্ষা এবং সহায়তা দিতে অস্থায়ী ভাবে কোনো দেশ হয়তো আশ্রয় দিয়ে থাকে। কিন্তু শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আপতকালীন সময়ে এ সব শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়ের পাশাপাশি খাদ্য, পানি, চিকিৎসার মতো মৌলিক সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপুঞ্জ বলছে, করোনা মহামারির কারণে বাস্তুচ্যুতির হার কমলেও বিভিন্ন দেশে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ২০২০ সালে ১১ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন।
রাষ্ট্রপুঞ্জের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ ৮ কোটি ২৪ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুতির শিকার। যার মধ্যে ৪২ শতাংশ তরুণ ও তরুণীর বয়স ১৮-এর নীচে। মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ইত্যাদি অমানবিক অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পেতে ২০১৭ সালে প্রায় ৭ লক্ষ বাস্তুচ্যূত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মায়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন এড়িয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা কমপক্ষে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে।

২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার ৭৩তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশে এখন ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলিতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সাম্প্রতিক উপচে পড়া ভিড় তার পরিকাঠামোয় প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। শরণার্থী শিবিরে শিক্ষা, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি-সহ নানা পরিষেবা এবং সঠিক স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। এই শিবিরগুলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সংক্রামক রোগ সংক্রমণের ক্ষেত্রেও ঝুঁকিপূর্ণ।
পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের গবেষক ড. রূপকুমার বর্মণের মতে, বাস্তুচ্যুতি, রাষ্ট্রহীনতা, উদ্বাস্তু, শরণার্থী ও নাগরিকত্বের সমস্যায় সমগ্র পৃথিবী জর্জরিত। অম্বেডকরর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. রূপকুমার বর্মণ গত ২০ বছর ধরে এ বিষয়ে গবেষণা করে চলেছেন।
লেখক জেসমিন প্রেমা বাংলাদেশের সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার (স্কাস) চেয়ারম্যান
আরও পড়তে পারেন
রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হওয়ার প্রস্তাবে ‘না’ করে দিলেন গোপালকৃষ্ণ গান্ধী
১৬ পেরোলেই বিয়ে করতে পারবে মুসলিম মেয়েরা, রায় পঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাই কোর্টের
গভীর রাতে লোন রিকভারি এজেন্টের ফোন! অভব্য আচারণ! অভিযোগ পেলেই কড়া ব্যবস্থার বার্তা দিল আরবিআই
বাংলা ছেড়ে অন্য এক বাঙালি রাজ্যের হয়েই খেলবেন ঋদ্ধিমান! জল্পনা বাড়ছে