শম্ভু সেন
তিন মাথার মোড়টা একেবারে শুনশান। রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়া নেই বললেই চলে। দু’-একটা সরকারি বাসের টিকি মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে। দোকানপাট প্রায় সব বন্ধ। বন্ধের চেহারা। হবে না, আজ যে ভোটের দিন।
হ্যাঁ, পঞ্চম দফা তথা ষষ্ঠ দিনের ভোটে আমাদের শিকে ছিঁড়েছে। যাই হোক, ভোটের দফারফা হয়নি। নির্বিঘ্নে ভোটটা দিয়ে ওই তেমাথা মোড়ে। না, না, যা ভাবছেন তা নয়। ভোট দেখতে নয়। আসলে সক্কাল সক্কাল মাভৈ বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম পবিত্র গণতান্ত্রিক কর্তব্যটি সমাধা করতে। তাই প্রাতরাশে খ্যাঁটনের ব্যবস্থা হয়নি। সেই উদ্দেশ্যেই বেরিয়ে পড়া।
আটসকালে এই তিন মাথার মোড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী সদাজাগ্রত। কারণ কাছেপিঠেই একটা প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। সেখানে নিশ্চয়ই ভোটের বুথ হয়েছে। তাই এখানে এদের টহল, ট্র্যাফিক পুলিশের নাকাবন্দি ইত্যাদি। হঠাৎ চোখ গেল রাস্তার ও-পারে। আরে! ওখানে তো আমারও যাওয়ার কথা। থমকে গেলাম। একটা খোলা দোকানের সামনে জটলা, আর রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জওয়ান। ওটা তো মিষ্টির দোকান। কিছু ঝামেলা হল নাকি ? মনে পড়ে গেল ২১ তারিখ উত্তর কলকাতায় ভোটের দিন নকুড়ের বিখ্যাত মিষ্টির দোকান খুলে রাখার ‘অপরাধে’ দোকান-মালিকই পুলিশের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে গেলেন। এখানেও সে রকম কিছু হল নাকি!
আবার অন্য রকমও মনে হল। ভোটের দিন বুথের কাছেপিঠে তো ১৪৪ ধারা জারি থাকে। তা অবৈধ জমায়েত ভাঙার জন্যই কি কেন্দ্রীয় বাহিনী হাজির ? দূর থেকেই বোঝার চেষ্টা করছিলাম। আসলে জানেন তো, ভিতু ভেতো বাঙালি। অকারণ ঝুটঝামেলায় জড়াই কেন ? গিন্নিও পই পই করে বারন করে দিয়েছেন – “যাবে, আর খ্যাঁটনটি নিয়ে চলে আসবে। এ-দিক ও-দিক বেচাল দেখলে এক দম মাথা গলাবে না।” আমি আবার এ সব ব্যাপারে গিন্নিকে খুব মান্যি করি।
কিন্তু জওয়ানটি দেখলাম রাইফেল কাঁধে নিয়ে দোকানে ঢুকল, আবার একটু পরেই বেরিয়ে গেল। জমায়েত যেমন কে তেমন। ব্যাপারটা কী মশায়! একটু কাল্টিভেট করতে হচ্ছে। হঠাৎ জটায়ুর ভূত ঘাড়ে চাপল। গিন্নির সাবধানবাণী ভুলে এগিয়ে গেলাম। আসলে আমার গন্তব্য তো এটাই ছিল।
ওমা! কাছে গিয়ে দেখি দোকানের বাইরে বেশ বড়ো একটা লাইন পড়েছে। জনা পঁচিশেক তো হবে। ফুটপাত থেকে লাইনটা এঁকেবেঁকে দোকানে ঢুকে গিয়েছে। মিষ্টির দোকানে লাইন দিয়ে কী বিক্রি হচ্ছে মশায় ? বুঝতে একটুও সময় লাগল না। হাতে মাটির ভাঁড়ে তরকারি আর ঠোঙায় গরম কচুরি নিয়ে মুখে পরিতৃপ্তির একটা হাসি ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। জিজ্ঞেস করে জানলাম বিশ্বজয় করতে তাঁকে আধ ঘণ্টার উপর লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। “আসলে গরম গরম ভাজা, নিমেষে উধাও হয়ে যাচ্ছে। কড়াইয়ে আবার চাপাতে হচ্ছে। তাই একটু সময় লাগছে” – এতটুকু বিরক্তি নেই ওঁর মুখে।
সেই অপরেশ লাহিড়ীর গানটা মনে পড়ে গেল – ‘সামনে পিছে ডাইনে বামে, চলতি বাসে কিংবা ট্রামে, এখানে যাও, সেখানে যাও, লাইন লাগাও, লাইন লাগাও’। কোথায় লাইন দেওয়ার কথা নেই সেই গানে ? হাটবাজারে, পথেঘাটে, হাসপাতালে, খেলার মাঠে, রেলের গাড়ির টিকিট কাটে, বায়স্কোপে খেলার মাঠে…। কিন্তু শিবদাস বাঁড়ুজ্যে মশাই বোধহয় এতটা ভাবতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত লাইন দিয়ে কচুরি কেনা!
ভোটের বাজারে পড়ে পাওয়া ছুটি। এই সুযোগ কি বাঙালি ছাড়ে ? গণতান্ত্রিক কর্তব্যটি পালন করি বা নাই করি, এই ছুটি কি উপভোগ না করে পারা যায় ? আর ছুটি উপভোগ করা মানেই তো ভালোমন্দ কিছু খাওয়া। তার ওপর রাস্তায় গাড়িঘোড়া কিছু নেই, সুতরাং কোথাও হারিয়ে যাওয়ার মানা না থাকলেও, আজ তার উপায় নেই। তাই সারা দিন ভালোমন্দ খাওয়াই হোক, আর জমিয়ে আড্ডা। তা সকাল থেকেই শুরু হোক না, প্রাতরাশ দিয়ে।
চুপি চুপি বলে রাখি। আমিও তো সেই ধান্ধাতেই এসেছি এখানে। ভোটটা দিয়ে এসে গিন্নিকে আমতা আমতা করে বলেছিলাম, “আজ একটু অন্য রকম ব্রেকফাস্ট করলে হয় না। রোজই তো সেই রুটি কিংবা পাঁউরুটি। ভোটের দিন। দেশের প্রতি একটা ডিউটি পালন করলাম। সেটা একটু এনজয় করব না ?” তা গিন্নিও দেখলাম বিশেষ আপত্তি করলেন না।
জীবনে লাইন তো কম মারিনি। এটাই বোধহয় বাকি ছিল – প্রায় ৪০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার পর আরও ৪০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে কচুরি কেনা।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।