টরেন্টোয় ‘ভায়োলেন্স এগেনস্ট উইমেন’-এর সক্রিয় কর্মী রুবিনা চৌধুরী। বর্ণবাদ নিয়ে খবরঅনলাইনে লিখতে শুরু করলেন ধারাবাহিক।
বর্ণ চোখের আড়াল করা যায় না বলেই এর বাদটি দুর্ভেদ্য; কোনও ভাবেই লুকোনো যায় না। চোখের সামনে নিজের অভেদ্য রূপ প্রকাশ করে। তৈরি হয় ভেদাভেদের অন্য মাত্রা। এক ভাষা, এক সংস্কৃতি হলেও বর্ণ জানিয়ে দেয় তার উপস্থিতির ভিন্ন রূপ। কিছুতেই মিলতে পারে না যেন। তাই সাদা আর কালো। আর মিলতে না-পারার মধ্যে রয়েছে ঔপনিবেশিকতা এবং নির্যাতনের এক দীর্ঘ ইতিহাস।
ছোটবেলায় পড়া সেই ‘নিগ্রোদের দেশে’ বা উঠতি বয়সে টিভির পর্দায় দেখা রুটসের কিনতাকুনতেকে কোনও দিন ভোলা হয়নি আমাদের প্রজন্মের। সত্তর দশক থেকে আশির দশকে হাঁটতে হাঁটতে সময় আমাদের দিয়েছে অনেককে; বব মারলি, অপরা উইনফ্রে, মোহাম্মদ আলি, ডায়ানা রস, এর পর ভুবনমাতানো মাইকেল জ্যাকসন। বর্ণবাদ নিয়ে যা কিছু জানা সেই সময়ে, আংশিক বিলুপ্ত মনে হয়েছে সুদূর প্রাচ্যে বয়ঃসন্ধিকালে। অ্যালেক্স হেলিকে এক অতীত বৃত্তান্তের লেখক ভেবেছিলাম। আরও বয়স বাড়ার কালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখে বার বার শুনেছি কিছু নেতৃত্বের নাম; মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, দেসমন্ড টুটু, অলিভার ট্যাম্বো, ম্যালকম এক্স, ফ্রেডারিক ডগলাস, হেইলি সেলাসি, এমন আরও কিছু নাম। টিভির পর্দায় দেখতাম কফি আনান আর সংবাদপত্রে নেলসন ম্যান্ডেলার মুখ। ব্রিটিশের সূর্য না ডোবার মতো কালো মানুষদের বিরূদ্ধে নির্যাতনের সূর্যটাও ডোবেনি, তাই এত প্রতিবাদ পৃথিবী জুড়ে। দূর থেকেই জানা হল এক চিরকালীন নির্যাতনের পালার কথা, যার যেন কোনও কূলকিনারা নেই, শেষও নেই।
মাইকেল জ্যাকসনের দুর্ঘটনা, এর পর প্লাস্টিক সার্জারি করে সাদা হওয়ার ঘটনায় কালো মানুষদের হইচইয়ের বিসংবাদে প্রথম জেনেছিলাম সাদা মানুষদের বিপক্ষে ঘৃণার লাল রঙ কত গাঢ় কালো মানুষদের মনে।
কোনও কিছু দেখা হয় না নিজের চোখে না দেখলে, চেনা হয় না নিজে না ছুঁলে।
জীবনস্রোতে ভেসে এক দিন উঠলাম উত্তর আমেরিকার সৈকতে জীবিকার তাগিদে কানাডায়। যে দিন রাতে পৌঁছলাম, ঠিক তার পরের দিন সকালেই কিছুটা উত্তর মিলল এত কালের জমে থাকা প্রশ্নের। এত দ্রুত তার প্রয়োজন আমি অনুভব না করলেও সময় করেছিল হয়তো। পরিচিত হিতাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়-বন্ধুরা দেখা করতে এসে উপদেশ তালিকায় রেখেছিল, ‘কালোদের কাছ থেকে খুব সাবধানে থাকবে, ওদের চালচলন একেবারেই কিন্তু ভালো নয়’। আরও একটা বিষয়ও জানিয়ে দিল, ‘ওদের যেন নিগ্রো বলো না, বলবে, ব্ল্যাক পারসন এবং ব্ল্যাক কমিউনিটি’। নিগ্রো শব্দটি এ দেশে এখন কটূ এবং তিরস্কারের পর্যায়ে ধরা হয়। সময় গড়াতে থাকল, এক বন্ধু শিকাগোতে নতুন চাকরি পেয়ে পাড়ি জমাল, তাকে পুরোনো শহরে ঘুরে যেতে বললাম। এ-কথায় সে-কথায় জানতে চাইলাম, “কেমন লাগছে এত বড় শহর”? উত্তর যেন তৈরিই ছিল। বলল, “সব ভালো, ওই কালো লোকগুলো ছাড়া”। অথচ আমার মনে সব সময় তৈরি হয়েছে এর উল্টো ধারণা। গুয়েল্ফ নামের ছোট একটা শহরে ছিলাম; অ্যাংলো স্যাক্সন অধ্যুষিত বসতিতে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায়। কালো মানুষদের দেখা যেত না বললেই চলে। আমার আশপাশের মানুষদের মধ্যে সব চেয়ে পরোপকারী বন্ধু ছিল আফ্রিকা থেকে আসা পরিবারগুলো। স্কুলে ভালো ছাত্র-ছাত্রী ছিল তাদের সন্তানরা। তখনও কোনও আমেরিকান কালো মানুষের সাথে মেলামেশার সৌভাগ্য হয়নি। বড় শহরে যারা বসবাস করত, যেমন, টরন্টো, শিকাগো, নিউ ইয়র্কে, টেলিফোন আলাপে তাদের নিত্যদিনকার অনুযোগ শুনতাম কালো চামড়ার মানুষদের বিরূদ্ধে। মিডিয়াকেই বা বাদ দিই কেন? তারা তো সব চেয়ে বেশি সোচ্চার এদের বিরূদ্ধে।
কানাডায় পা রেখেও কাছে যেতে পারছিলাম না এত বড় সম্প্রদায়টির। যাদের জন্ম এ দেশে, যাদের সংস্কৃতি, ভাষা কোনওটাই এখন আর ইংরেজি ভাষাভাষীর চাইতে আলাদা কিছু নয়, তারা অচেনা রয়ে গেল আর সেই বিষয়টি আমাকে শান্তি পেতে দিচ্ছিল না একেবারেই। আরও সময় গড়াল, আরেকটু বড় শহর, হ্যামিলটনে পাড়ি দিলাম শিক্ষার উদ্দেশ্যে। বলা বাহুল্য, এ দেশের সার্টিফিকেট ছাড়া ভালো কোনও চাকরি এ দেশে আশা করা যায় না, বিশ্বায়ন বর্ণবাদের আরেক দিক। (চলবে)
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।
rubina chowdhuryr lekha khub valo laglo.khub valo hoto jodi barna biddesh kathata ei prithibi theke muche jeto.