টরন্টোয় ‘ভায়োলেন্স এগেনস্ট উইমেন’-এর সক্রিয় কর্মী রুবিনা চৌধুরী। বর্ণবাদ নিয়ে ধারাবাহিক লিখছেন খবরঅনলাইনে।
জীবনের প্রেক্ষাপট পালটে গেল পড়াশোনা শেষ হলে। মঞ্চ বদলের পালা এল। পাড়ি জমালাম টরন্টোতে। কেস স্টাডি করার সময় বার বার পড়েছি জেন অ্যান্ড ফিন্চ এলাকার বিষয়ে, বিশদ আলোচনার বিষয় ছিল এলাকাটি। বলতে গেলে লেবেল আঁটা হয়েছে অপরাধীদের আবাসিক এলাকা নামে। কোনও খুন, লুটতরাজের নায়ক অজ্ঞাত হলেই পুলিশে প্রথমেই হাজির হয় ওই এলাকায়। নিশ্চয় বুঝতে বাকি রইল না যে ওখানকার অধিকাংশ বসবাসকারী কালো বর্ণের; শুধুমাত্র আফ্রিকান আমেরিকান নয়, ক্যারিবিয়ানরাও টরন্টোতে এসেছে, ১৮০০ সাল থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে জ্যামাইকা এবং বারবাডিয়ান থেকে কিছু সংখ্যক কালো মানুষ এসেছিল এই প্রদেশে। কিন্তু ব্যাপক আকারে পাড়ি জমিয়েছে সত্তর দশকে, (সার্চ লরোজ, দ্য কানাডিয়ান এনস্লাইকোপিডিয়া, ২০১৫)। এ ছাড়াও আছে সোমালিয়ান, সুদান, ইথিওপিয়ান, যাদের বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচেই বসবাস করে এবং নির্দিষ্ট অন্য একটি এলাকায়। যেখানে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই ঢুকে যায় দিনে বা রাতে যে কাররও বাড়িতে। তছনছ করে ঘর, উদ্দেশ্য জঙ্গি বা মাদক। না পেলেও বাধা দেবে কে, যাদের বড় একটি অংশ ইংরেজি বলতে পারে না। দেশের যুদ্ধের কারণে এ দেশে এসেছিল, আবার এ দেশের পুলিশি অত্যাচার। শিশুরা মানসিক ভাবেই ভীতিগ্রস্ততায় ভুগছে, বয়ঃসন্ধিকালে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধপ্রবণতায়। সমাজকর্মীরা তৎপর হয়ে উঠেছে, কিন্তু সরকার নিশ্চুপ। অবস্থানের কোনও অগ্রগতিও নেই তাই। ওদেরকেই জাগতে হবে, কিন্তু জাগতে দেবে কে? শাসকদের ঘুম বড্ড প্রিয়। এই বিষয়ে পরে বিশদ ভাবে লিখব। তামিলরাও আছে ওই দলে নিজেদের গাত্রবর্ণের অলঙ্করণে, যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ বসবাসের এলাকা ভিন্ন। ওরা যে সময়ে এ দেশে এসেছিল তখন সাদারা ওদের সাথে মিশত না, ওদের ঠাঁই হয়েছিল কালোদের ঠিকানায়। ওদের পরবর্তী প্রজন্মের বেশির ভাগ তাই কালোবর্ণের সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে। যে সংস্কৃতি নিউইয়র্ক বা শিকাগো শহরে কালোবর্ণের মানুষের মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে চতুরানন দখলদারিত্বের প্রয়োজনে। ভূগোলবিদ্যায় জানা যায় যে উপমহাদেশ আফ্রিকার অংশ ছিল, তামিলরা সেই ভূখণ্ডের আদিবাসী। আফ্রিকা মূল্যায়ন না করলেও উত্তর আমেরিকায় ওরা সেই স্বীকৃতি পেয়েছে, বিশেষ করে পুলিশ সার্ভিসের কাছে, মূলধারা মানুষের চোখে।
এই শহরে ঘুরতে এসেছি বহু বার, কিন্তু বসবাসের জন্য এই এলাম। নতুন করে চেনা পরিচয় হল। একমাত্র এই শহরেই মাল্টিকালচারিজম গড়ে উঠতে পেরেছে কিছুটা। সাদাদের মানসিকতা অন্য ছোটো শহরের তুলনায় ভিন্ন। নানা দেশের বিভিন্ন চালচলন চোখে পড়ে, বিশেষ করে খাবার আর পোশাক অর্থনীতির সংযোগে। তবে এই নতুন অধ্যায়ে কিছু ভুল ভাঙল, কিছু নতুন ভুল এসে জুড়ল, কিছু শুধরোল, কিছু অজানাই রয়ে গেল।
কিছুটা গুছিয়ে উঠেই মধ্যবিত্তের প্রয়োজনে জীবিকা অন্বেষণের পালা শুরু হল। মধ্যবিত্ত মানসিকতার লক্ষণীয় দিক, যে বিষয়ে পড়াশোনা করে, তার ভিত্তিতেই চাকরির খুঁজতে নেমে পড়ে। আমিই বা অন্য পথে যাই কী করে? নেমে পড়লাম কোমর বেঁধে; পায়ে হেঁটে নয়, অনলাইনে, এর পর ডাকার অপেক্ষা। এই গতির কোনও কূলকিনারা নেই। ডাকে সারা দিতেই দেখলাম অনেক কর্মক্ষেত্রে কালো মানুষই কর্মকর্তা। অনেকেই টানল নারী এবং কালো বলেই নয়, তাদের প্রজ্ঞাবাণে। সময় গড়াতেই এক জন কানে তুলে দিল, আঙুল তাক করে দেখাল; যে মাল্টিকাল্চারিজমের কথা বলা হয়, তাতে মিলিত ভাব কোথায়! দখলে চলে গেছে শুধু কালোদের ঘরে, কিন্তু ওদের ভাষা, ওদের সংস্কৃতি তো এদেরই, তা হলে আমরা কোথায়? আছে ইউরোপীয়রা ভাষাগত প্রভেদে, সাংস্কৃতিক মিলটা ধরে রেখে। অন্যরা কোথায়? দক্ষিণ আমেরিকানরাও আছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। ধাক্কা লাগল সম্মিলনের ভাবে, অন্য দিকে জেগে উঠল সংযোগের প্রবল বাসনা। মূলধারার সংস্কৃতি কিছুতেই মুছে যেতে দেবে না এরা, তা হলেই তো ভিত নড়ে উঠবে সাম্রাজ্যের। কাগজে কলমে না হোক, সত্যিকার অর্থে এই দেশ তো ব্রিটিশ আর ফরাসিদের উপনিবেশ। স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেয় ওদের শ্রেষ্ঠত্ব, এ দেশে প্রতিষ্ঠা চাওয়া মানে নিজেকে নব জনমে বদলে নেওয়া, যে রূপান্তরের নাম আন্তর্জাতিকতা। ঔপনিবেশিকতার মানসিকতায় অভ্যস্ত আমরা উঠে পড়ে লাগি নিজেকে বদলানোর পালায়। ইংরেজি বা কুইবেকে বসবাস করলে ফরাসি শিখতে হবে, এদের পোশাক আর খাবারে অভ্যস্ত হতে হবে। আমরা শুধু গ্রীষ্মে এক-দু’ দিন দাঁড়িয়ে খাবার বিক্রি করে জানাব আমাদের অস্তিত্ব, ওরা বাহবা দেবে। বিশেষ একটি টেলিভিশনে এক ঘণ্টার একটা শো করে জেনে নেবো নিজেদের ছোট্ট জনসমাজের অবস্থান। শুধু পার্থক্য একটাই; এই শহরে প্রশ্ন করা যায়, অন্য শহরে একেবারেই না।
(চলবে)
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।