
২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের প্রথম বড়ো ভোট। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে শাসক দল যে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও মোটের উপর ভালো ফল করবে, সে কথা মানতেন বিরোধী দলের নেতারাও। তবুও তৃণমূল কোনো রকমের ঝুঁকি নিতে চায়নি।
বাম আমলের ভোটে ‘ভুতুড়ে ভোটার’ শব্দটা আগেই আমদানি হয়ে গিয়েছিল। একের ভোট অন্যে দিয়ে চলে যাওয়াকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করতেন তৎকালীন বিরোধী দুই কংগ্রেস নেতৃত্ব। কিন্তু রাত বারোটা-একটায় ‘ভূতে’ ভোট দিচ্ছে, এমন দৃশ্য হয়তো প্রথম বার দেখা গেল ওই ২০১৩-য়। প্রতিবেদকের এক সহ-সাংবাদিক সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দিও করলেন। তখনও হোয়াটঅ্যাপের এত চল বা ঢল না থাকায় রাত বারোটায় মোবাইলে কল করে তিনি বলেন, “দাদা, এখনও বুথের সামনে লম্বা লাইন। নিজের চোখে দেখছি, যেন ‘ভূত’ ভোট দিয়ে যাচ্ছে”।
১৩ জুলাইয়ের নির্ধারিত ওই ভোট বেশ কিছু বুথে গড়িয়েছিল পর দিন অর্থাৎ ১৪ জুলাই পর্যন্ত। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে বুথের সামনে সেই লম্বা লাইন ভোটের নির্ধারিত সূচিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ক্যালেন্ডারে পরের দিনেও। সেই ভোট নিয়ে অবশ্য শাসক-বিরোধী কোনো পক্ষেই তেমন কোনো শোরগোল পড়েনি। এক মাত্র তৎকালীন কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়াকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “ভোট নয়, ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে”।
তবে হ্যাঁ, এ কথাও অস্বীকার করার নয়, রাজ্যের সর্বত্র এই ঘটনা চোখে পড়েনি। কিন্তু কোনো কোনো এলাকায় নিশ্চিত জয়কে আরও সুনিশ্চিত করতে গণতন্ত্রের মেলায় কোথাও কোথাও এমন ঘটনাও বিরল ছিল না। তৃণমূলের তৎকালীন ভোট-সেনাপতি মুকুল রায় এখন বিজেপিতে গিয়ে তেমনই কিছু ‘পাপ’ কাজের দৃষ্টান্ত হয়তো তুলে ধরছেন প্রকাশ্যে।
তৃণমূলের এক মন্ত্রী বলছিলেন, রাজ্যে তৃণমূলের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের সাফল্যের হাত ধরেই। সে বার ভোটে তৃণমূলের জেলা পরিষদ দখল অনেকটাই প্রভাব ফেলেছিল ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে। এক থেকে আচমকা ১৯ সাংসদ পেয়ে যায় তৃণমূল। একই ভাবে পরিবর্তনের পর ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের একাধিপত্যের ছাপ পড়ে দু’বছর পরের লোকসভা ভোটে। ২০১৪ সালের লোকসভায় ৩৪টি আসন জিতে নেয় তৃণমূল। স্বাভাবিক ভাবেই এ বারের পঞ্চায়েত সে দিক অনেকটাই গুরুত্ব বহন করছে শাসক দলের কাছে।

আগামী ২০১৯ লোকসভা ভোটকে পাখির চোখ করে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে প্রভাব বাড়ানোয় জোরদার কর্মসূচি নিয়ে ফেলেছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি-বিরোধী জোট গঠনে মূখ্য ভূমিকা নিতে মুখিয়ে আছেন তিনি। তাঁর ঘনিষ্ট মহল সূত্রে এমনটাও জানা গিয়েছিল, এ বারের পঞ্চায়েতে তিনি প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মতোই খবু একটা মাথা ঘামাবেন না। সে দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়-সহ জেলার দাপুটে নেতাদের হাতে। কিন্তু মনোনয়ন নিয়ে তৈরি হওয়া হিংসার আবহে নেতিবাচক সমালোচনা এড়াতে বাতিল করেছেন তেমন পরিকল্পনা। আপাতত বদল করেছেন দেশব্যাপী ফেডারেল ফ্রন্ট গঠনের সক্রিয়তারও।
এ দিকে বদল ঘটেছে ভূতেও। কারণ বিজেপি নেতা মুকুলবাবুর থেকে তৃণমূলের আর কোন নেতা এত ভালো করে জানেন ভূতের গতিবিধি! বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য বলছেন, তিনি পঞ্চায়েত ভোট বুথে শেষ হতে দেবেন না, টেনে নিয়ে যাবেন শ্মশানে। কিন্তু মুখে তিনি যা-ই বলুন, শ্মশানের বাসিন্দাদের কন্ট্রোল করার পূর্ব অভিজ্ঞতা এ মহূর্তে মুকুলের থেকে বেশি আর কার-ই বা আছে?
হয়তো সে কারণেই এ বারের ভোটে শুধু ‘ভূতে’ আস্থা না রেখে ‘ভৈরবের’ তাণ্ডব চলছে উভয় তরফে!
(মতামত প্রতিবেদকের নিজস্ব)