
আমি ছোটোবেলায়, মানে ওই ক্লাস সিক্স-সেভেনে যখন আমার জন্মরহস্য জানতে পারি তখন বিশ্বাস করুন আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছিল। আমি ভাবতে পারিনি এ রকম হতে পারে… কিংবা হয়তো ভেবেছিলাম এর চেয়ে না জন্মালেই ভালো হত… ইত্যাদি ইত্যাদি…। শুধু তা-ই নয়, এই যে শিব আর দুর্গার ছেলে-মেয়ে গণেশ–লক্ষ্মী, তাদেরও এ ভাবে জন্ম হয়েছে? মানে ঠাকুর দেবতারাও… ছি ছি… এ সব কি ঠাকুর–দেবতা–বাবা–মায়েদের করার মতো কাজ!
আর একটা বয়সে করেছে করেছে… এখন এই বয়সেও!
তা-ও কন্ডোম ছাড়া?
তার পর যা হওয়ার তা-ই হল…। ৫০ বছরের বাবলি প্রেগনেন্ট হয়ে গেলেন। মানে বড়ো ছেলে অফিস যাচ্ছে আর ছোটো ছেলে হাই স্কুল। স্বামী আর দু’ বছর পর রিটায়ার করবেন, সেই অবস্থায় প্রেগনেন্ট হয়ে গেলেন। পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন, মায় ছেলের বন্ধুবান্ধবের ঠাট্টা-টিটকিরির শিকার হতে প্রেগনেন্ট হয়ে গেলেন। এবং আশি বছরের বৃদ্ধা শাশুড়ির চোখ কপালে তুলে শ্বাসরুদ্ধ করে গঞ্জনা শুনতে শুনতে… আর হবেই তো। ধরুন আপনার বয়স ২৫ বছর। ভালো চাকরি করেন। তুলকালাম মাইনে পান কিংবা পান না, তুখোড় ইংরিজি বলেন কিংবা বলেন না…। কিন্তু ২৫ বছরের এই যে আপনি, তখন মায়ের বয়স কম করে ৪৫/৪৬ তো হবেই। সেই মা কি না এখন প্রেগনেন্ট! আপনি কোথায় মুখ লুকোবেন? না কি লুকোবেন না, তার বদলে মাকে জোর করে অ্যাবরশন করাতে নিয়ে যাবেন? মা–বাবার ভুলভাল পিছিয়ে থাকা সংস্কারে আটকালে তাঁদের বোঝাবেন? কিংবা হেব্বি ঝামেলা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবেন। বাবা এই বয়সে এমন নালায়েকের মতো কাজ করেছে বলে রাগে তাঁর মুখ দেখবেন না, মাকে এমনিতেও সোফা আলমারির মতোই ভাবতেন এখন আরও বাতিলযোগ্য সেলাই মেশিনসম ভাবতে শুরু করবেন আর যেতে আসতে ছোটো বাড়ির মধ্যে পায় ঠোক্কর খেলে যেমন হয় তেমনি করে আরও বিরক্ত হবেন? ছবির হিরো এগুলোর মধ্যে কী কী করেন জানতে হলে ছবিটা দেখতে হবে।
গল্প ইত্যাদি নিয়ে বেশি কথা না বাড়িয়ে বরং কলাকুশলীদের কথায় আসি। নীনা গুপ্তা এই বয়সে যেমন সুন্দর তেমনি অভিনয়ে নিখুঁত বাবলি মানে যার ভালো নাম আবার প্রিয়ংবদা। যে শাশুড়ির গঞ্জনা মুখ বুজে গিলে নিয়ে মিষ্টি করে স্বামীর ওপর রাগ দেখিয়ে দিতে পারেন। একদম এ রকমই তো হন নেহাতই মধ্যবিত্ত বাড়ির কাকিমা–মাসিমারা। টক ঝাল মিষ্টি চানাচুরের মতো। শাশুড়ি সুরেখা সিক্রি বাড়াবাড়ি। যতটুকু যা ওঁকে সিনেমায় দেখার সুযোগ হয়েছে মনে রাখার মতো স্ক্রিন উপস্থিতি বুঝিয়ে দিয়েছেন বরাবর, কিন্তু এখানে এত সহজে সহজ আবার এত সহজে কঠিনও যে বহু দিন পর্যন্ত ওঁর মুখের কিছু সংলাপ ভুলতে পারব না। শিবা চাড্ডা স্বল্প পরিসরে ভালোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জবরদস্ত। কিন্তু গজরাজ রাও? উনি কোত্থেকে এলেন? আমার সেই তলভারের বিরক্তিকর ইন্সপেক্টরকে মনে আছে। মানে সত্যি বলতে কি মনে ছিল না। ইরফান খান কঙ্কনাদের ভিড়ে ওঁর অভিনয় দারুণ লেগেছিল কিন্তু নাম জানতাম না। আর এই ছবি দেখে মনে হল এ রকম কত অপরাধ আমরা করি। গজরাজ রাও-এর মতো অভিনেতার নাম না জানা অবশ্যই অপরাধ। সিনেমা হলে জাতীয় সংগীতে উঠে না দাঁড়ানোর চেয়ে বড়ো অপরাধ আমার মতে (এবং হলে বা থিয়েটারে মোবাইল সাইলেন্ট না করার সমান অপরাধ)।
পরিচালক অমিত শর্মাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এর জন্য। অবশ্য অমিত শর্মা এই পুরো ছবির জন্যই কুর্নিশ পাবেন। এ রকম একটি বিষয় নির্বাচন এবং এত নিপুণ ভাবে সেটা করে ফেলার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি ওঁকে। তবে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে লেখকদের কথাও। অক্ষত ঘিলদিয়াল, শান্তনু শ্রীবাস্তব এবং জ্যোতি কাপুরের লেখনী এই জায়গায় নিয়ে গেছে ছবিটিকে।
অভিনয়ে হিরো হিরোইনের নাম উল্লেখ করিনি, না? আয়ুষ্মান খুরানা আর সানয়া মালহোত্রা। আয়ুষ্মান ভালো কিন্তু এত ভালোর মাঝখানে পড়ে গেলে ওঁর মতো সীমিত এক্সপ্রেশনের অভিনেতাদের যা হাল হয় তা-ই হয়েছে। সানয়া ভালো অভিনেত্রী। দঙ্গল ছাড়াও বিশাল ভরদ্বাজের পটাকাতে তাঁর পরিচয় দিয়েছেন কিন্তু এখানে বিশেষ কিছু করার ছিল না।
এত সবের পরেও একটা দু’টো জায়গায় খটকা লাগল… বেশ এগিয়ে থাকা ভাবনাচিন্তা না থাকলে এ রকম গল্প ভাবা যায় না। এগিয়ে থেকে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে চিরাচরিতের দিকে ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়ে দিতে গেলে ধক লাগে। সেই ধক এই ছবির নির্মাতারা দেখিয়েছেন বটে। কিন্তু কিছু মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ যা আধা ফিউডাল ভারতবর্ষে শেকড় গেড়ে রয়েছে তো রয়েছেই এবং রয়েছে মানেই তা আলিঙ্গন করার মতন এ আর কত দিন চুপচাপ মেনে নিতে হবে? পুজো দীপাবলির আগে যে সব নতুন বিজ্ঞাপন দেখায় তাতে তো থাকেই। সেখানে পণ্য বিকোতে হবে, তাই তাকে মেনস্ট্রিমের জোয়ারে গা ভাসাতেই হবে। এখনকার হিন্দি ছবি সেই জোয়ার এড়িয়ে অনেকটাই এগিয়ে চলেছে আর তাই আরও বেশি প্রত্যাশা থেকে যায়।
তাই গজরাজের চরিত্রের মধ্যবিত্তীয় সংকীর্ণতা দেখে শুরুতে যেমন ছেলে আয়ুষ্মানকে বিব্রত হতে দেখা যায় তেমনি ভাবে আর সূক্ষ্ম ডিটেলের ঝলকানি দেখি না। গল্প বিস্তারে, চরিত্রায়নে বা মুহূর্ত তৈরিতে লেখক–পরিচালক যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তাতে নিখুঁত গল্প বলা এক ছবি হয়ে উঠেছে অবশ্যই। কিন্তু এই সব দক্ষতা নৈপুণ্য ইত্যাদির পরে যে টেক অ্যাওয়ে পড়ে থাকে সেখানে নিখাদ বিনোদন আর সবার ওপরে ফ্যামিলি সত্য মার্কা মূল্যবোধ ছাড়া আর কি রইল? আপনারা দেখে ঠিক করুন বরং…