প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী
…সে ঘোমটাটুকু প্রফুল্লকে ধরিয়া বসাইবার সময় খুলিয়া গেল। ব্রজেশ্বর দেখিল প্রফুল্ল কাঁদিতেছে।
ব্রজেশ্বর না বুঝিয়া-আ ছি ছি। বাইশ বয়সই ধিক। ব্রজেশ্বর না-ভাবিয়া না-চিন্তিয়া যেখানে বড় ডবডবে চোখের নীচে দিয়া এক ফোঁটা জল গড়াইতে ছিল-সেই স্থানে আ ছি ছি ব্রজেশ্বর হঠাৎ চুম্বন করিলেন।…
দেবী চৌধুরাণীর ব্রজেশ্বরের বয়স মোটে বাইশ ছিল আর প্রতিম ডি গুপ্তর সাহেব, বিবি, গোলাম-এ পার্নো মিত্র-র বয়স সম্ভবত আরও কম। অন্য কথা জানি না তবে না ভেবে চিন্তে কাজ করার ব্যাপারে সে কাল আর এ কালের মিল কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভারি প্রকটই থেকে গিয়েছে। তো, বিশাল বড়লোকের মেয়ে পার্নো বাড়ির সামনের রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকা ট্যাক্সি ড্রাইভার ঋত্বিক চক্রবর্তীর প্রেমে পড়ে গেলেন। এটুকু পুরনো দিনের সিনেমার মতন। কিন্তু ঠিক ওটুকুই। তারপর যা যা হল, সেগুলো না হলে পরিচালক মশাই এমন অসামান্য একটি বাংলা ছবি বানাতে পারতেন না।
ঋত্বিক চক্রবর্তী নামক গোলামটি নানারকম সমাপতনে মিলিয়ে দিলেন সুপারি কিলার সাহেব অঞ্জন দত্ত এবং যৌন অতৃপ্তি থেকে দেহ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া বিবি স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়কে।
সেই স্বস্তিকা, যিনি এই মুহূর্তে দেশের হাতে গোনা কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের অভিনেত্রীর একজন এবং বাংলা ছবির চিরকালের সেরা তিন জনের একজন। স্বস্তিকা সম্পর্কে এ সব কথা চট করে কেউ বলেন না। হয়তো সেসব সিনেমার বাইরের কারণে। তবে শুধু স্বস্তিকা নন। ছবির চার প্রধান অভিনেতারই, অভিনয়ের জন্য প্রচুর সুনাম এবং এই ছবিতে অনেকটা করে জায়গা পেয়ে প্রাণ ঢেলে কাজ করেছেন।
কাহিনি পরম্পরায় ছোটখাটো খুঁত চাইলে ধরাই যায়, তোলা যায় নানা কূট প্রশ্নও, কিন্তু মন চাইছে না। কারণ, এ ছবির সাহেব, বিবি, গোলাম আলাদা আলাদা কারণে ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে। চালু নৈতিকতার বিপরীতে অবস্থান করেও সাহেব আর বিবি-র চরিত্র দুটি কারও ক্ষতি না করে নিজের শর্তে বাঁচার চেষ্টাটুকু অন্তত করে(বৃহত্তর অর্থে তা যতই অদ্ভুতুরে শোনাক না কেন) এবং শেষমেষ গোলাম এবং তার ভালবাসার প্রতি প্রণিপাত করে ছোট এক প্রতিশোধের কবিতা রচনা করে। না কি গদ্যই বলা সমীচিন, জানি না। তবে একেবারে ভেঙেচুরে যাওয়া গৃহবধূ স্বস্তিকা কীসের জোরে অমন একটা সামাজিক ন্যায়ের কাজে অংশ নিলেন, যদি না নতুন এক মূল্যবোধ তার আয়নায় ও প্রান্তে এসে হাজির হয়ে থাকে ?
এমনই নানা প্রশ্ন থেকে যায়, ঘণ্টা দুয়েকের টানটান ছবিটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও। বিদেশি ছবির ছায়া স্পষ্ট গোটা নির্মাণে। তা হোক, তবু ‘ঘষা কাঁচে ঘষা লাগা চোখ’ যা চায়, তা তো দিতে পেরেছেন পরিচালক। সাজানো ড্রইং রুমের বাইরে কলকাতার অলিগলি পাকস্থলিতে ক্যামেরা ঘোরানোর চেষ্টা-টাতো অন্তত করেছেন। সঙ্গীতের যথাযথ সাহায্য পেয়েছেন, তা নিশ্চয় তাঁর প্রাপ্য ছিল।
সবচেয়ে বড় কথা, ঋত্বিক-পার্নোর প্রেম পর্বের ছোট্ট অংশটুকু বাদে দর্শককে তিনি কমফর্ট দিতে চাননি শেষ পর্যন্ত। বাংলায় এমন ছবি ? উঁহু, শেষ কবে দেখেছি, বিশ্বাস করুন, কিছুতেই মনে পড়ছে না।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।