
জেনেছিলাম কোর্টরুম ড্রামা। হলে গিয়ে দেখা গেল ড্রামা লুকিয়ে আছে দুই উকিলের ব্যক্তিগত আকছাআকছিতে। ইতিহাস আশ্রিত সিনেমার ওই অংশটুকুই আবার কাল্পনিক বলে পরিচালক জানিয়ে দিয়েছেন সিনেমার শুরুতেই। তার মধ্যে মহিলা উকিলের ইস্যুটি নিতান্ত জরুরি এবং ন্যায্য হলেও পুরুষ উকিলটির মোটিভেশন খানিক আরোপিত লাগে। কারণ গত শতকের ত্রিশের দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যখন বেশ উঁচু মাত্রায় তখন ‘ব্রিটিশদের তৈরি আইন দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়া’ এবং চূড়ান্ত ভোগী দুশ্চরিত্র জমিদারকে তাঁর সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই করতে গিয়ে ভগৎ সিং, ক্ষুদিরামদের রেফারেন্স টানাটা ঠিক হজম হয় না। সেই তুলনায়, অর্পণা সেনের চরিত্র অনেক রক্তমাংসের যেন।
কারণটাও তৈরি করে দিয়েছেন পরিচালক। ভাওয়ালের মেজকুমারের চরিত্রের দোষ, যৌনরোগ ইত্যাদির বিবরণ যতটা দেখিয়েছেন, সেভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি তাঁর জনপ্রিয়তা। একটি দৃশ্যে যীশুর প্রজাবৎসল ভূমিকার উদাহরণ দেখিয়েছেন বটে, কিন্তু সেটা তেমন ছাপ ফেলেন না। তবে কি মহেন্দ্রকুমার ভালো শিকার করতেন, ঘোড়া চড়তেন ইত্যাদি কারণেই জনপ্রিয় ছিলেন স্রেফ। সেটাও বোঝা যায় না ছবিতে।
এস্টেট দখল করার জন্য ব্রিটিশদের চক্রান্ত দেখানো হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে প্রজাদের ওপর কী প্রভাব পড়ল, মহেন্দ্রকুমারের সন্ন্যাসী হয়ে ফিরে আসায় তাঁরা কেন অতটা উদ্বেল হয়ে গেল, তাও ‘এক যে ছিল রাজা’ দেখে বোঝা যায় না। কথা শুনে জেনে নিতে হয়।
পার্থ চ্যাটার্জির ‘দ্য প্রিন্সলি ইমপস্টার’ বই অবলম্বনে এই ছবি। সেখানে পার্থবাবু জানিয়েছিলেন, পরিবারের অন্দরে কোন রাজনীতিতে কেবল স্ত্রী, শ্যালক ও ডাক্তারের সঙ্গে ভাওয়ালের অসুস্থ রাজা দার্জিলিং চলে গেছিলেন, তা জানা যায় না। অন্য কোনো মহিলার না যাওয়াটা ছিল সন্দেহজনক। ছবিতেও তেমনটাই দেখানো হয়েছে। কিন্তু ওই জায়গাটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য চিত্রনাট্যে কোনো কাল্পনিক অংশ যোগ করা হয়নি বা ভয়েস ওভারেও বিষয়টার উল্লেখ করা হয়নি। তাই দর্শকদের ভেবে অবাক লাগে, অত কম সময়ে কীভাবে শ্যালক অত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন। অকারণ গান ইত্যাদি দিয়ে রাজার নাগা সন্ন্যাসী পর্ব না দেখিয়ে চিত্রনাট্যের এই ফাঁকগুলো ভরাট করলে তা বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ড্রাস্ট্রির ফার্স্ট বয়ের পক্ষে মানানসই হত।
এ ছবির হৃদ্পিণ্ড দীর্ঘদিন ধরে চলা মামলা। অথচ মামলার দৃশ্য কিছু চোখা সংলাপ থাকলেও কোনো ড্রামা নেই। একমাত্র একবারই দুই উকিল মহেন্দ্রকুমারকে জেরা করেছেন। বাকি কোনো সাক্ষীর ক্ষেত্রেই জেরা-পালটা জেরার দৃশ্য তৈরি করার ঝুঁকি নিতে পারেননি নির্মাতা। যা হয়েছে, তা হল বিবাহবিচ্ছিন্ন যুযুধান উকিলের বাগযুদ্ধ।
মহেন্দ্রকুমারের জনপ্রিয়তা যেহেতু সিনেম্যাটিক্যালি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই প্রায় উলঙ্গ যীশুকে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখিয়ে আবেদন তৈরি করার চেষ্টাও মাঠে মারা গেছে। ভরসা রাখতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের আক্ষরিক প্রয়োগের ওপর। চিত্রনাট্যের দুর্বলতা ঢাকতেই যেন বারবার একই গানের ব্যবহার করে আলোড়ন তৈরির চেষ্টা।
তবে মনে থেকে যায় যীশুর মৃত্যুদৃশ্য। ডাক্তার ও শ্যালকের কাছে যীশুর রাজার মতো মৃত্যু ভিক্ষার অংশটি অবশ্যই অবক্ষয়ের জীবন্ত প্রতীক হিসেবে উঠে আসে। স্বামীর ওপর ক্ষোভ থেকে তাঁর ফিরে আসাকে মেনে নিতে পারেননি রাজার স্ত্রী চন্দ্রাবতী। তাঁর অবস্থানটা স্পষ্ট করার চেষ্টা এ ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে থেকে যাবে। যাতে সঙ্গত করেছেন উকিল অপর্ণা। অঞ্জন দত্তর সঙ্গে বাগযুদ্ধের অভিনয়ে তিনি স্বাভাবিক ভাবেই ফেল মারলেও খারাপ করেননি মোটের ওপর।
যীশু অবশ্য সুবিধা করতে পারেননি। যতই গাঁজাখুরি গল্প হোক, যে চরিত্র উত্তমকুমার করে গিয়েছেন, সেই চটিতে পা গলানো শক্ত কাজ তো বটেই। তারওপর যীশুর বাঙাল বলাটা জমেনি, নাগা সন্ন্যাসীর ভূমিকাতেও স্বচ্ছন্দ মনে হয়নি আর আদালতে তাঁর তেমন কিছু করার ছিল না। বরং ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন জয়া এহসান ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ডাক্তারের চরিত্রে রুদ্রনীলের কি অতটা ব্যক্তিত্বহীন হওয়াই জরুরি ছিল!!
ঢাকার গল্পে বাঙাল ভাষার প্রয়োজনটা পরিচালক বুঝলেন অথচ সেই সময়কার কলকাতার লোকদের ডায়লেক্ট নিয়ে কেন মাথা ঘামালেন না কে জানে? অনির্বাণ, রাজনন্দিনী এমনকি ডাক্তারও আজকের কলকাতার ভাষায় কথা বলে গেলেন গোটা সিনেমা জুড়ে।
পিরিয়ড পিস বানানোয় আরও কিছু সময় ও পরিশ্রম দাবি করে মনে হয়। কিন্তু হায়, তত সময় টলিউডের কোথায়!