
শোলের জয় যেদিন মহব্বতের গুরুকুলের প্রধান হয়ে পুনর্জন্ম নিলেন, ততদিনে কী ভারতের মানচিত্রে রামগড় নামের গ্রামগুলির রূপান্তর হয়ে গেছে? না কী সিনেমা পর্দায় ধীরে ধীরে বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে রামগড়, বাসন্তী, মৌসি বা তাঁর টাঙা।
পথের পাঁচালি। প্রায় সত্তরে পা দিল। ভরা বর্ষা, ঝিঝি-র ডাক, অপু-দুর্গা, রেলগাড়ি, কাশফুল এ সব কিছুই পুরোনো হয়ে গেছে। প্লট, সাব প্লট সত্যান্বেষণে মিলে মিশে বাঙলা ছবির পর্দা জুড়ে রিলিফ চাইছি আমরা। এসবের মধ্যেই ‘সহজ পাঠের গপ্পো’। সহজ কথা সোজা করে শোনার ধৈর্য্য দাবি করছেন কেউ কেউ। তা সে যতই পুনরুক্তি হোক। ভারী গা ছমছমে ব্যাপার। প্রকৃতি, দারিদ্র্য, বিষন্ন-বিপন্ন শৈশব যা কিছু লিখেছেন বিভূতিভূষণ সব কিছু ফিরে এল পর্দায়। সত্যজিতের পথের পাঁচালির সব মাধুর্য বা তার থেকেও বেশি কিছু নিয়ে। সহজ পাঠের গপ্প, ইতিমধ্যেই চলচ্চিত্র উৎসব গুলিতে প্রশংসা পেয়েছি। শিশু-শিল্পী বিভাগে রজত কমল পাওয়া হয়ে গিয়েছে। পাওয়া উচিত-ও। আমরা শুধুই মুগ্ধ হয়ে দেখেছি, তাহলে এমনটাও করা সম্ভব এই বাজারে। মাল্টিপ্লেক্স, পপকর্নের কম্বো অফারের বেড়াজাল টপকে গোপাল বুঝি সত্যিই কুয়োতলার শ্যাতলা পরিষ্কার করতে পারে পাঁচ মিনিট ধরে। অবাক শৈশব, তার সবটুকু ইনোসেন্স সহ এত নির্মোহ ভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে পর্দা জুড়ে। বিভূতিভূষণের তালনমবী অবলম্বনে ছবি, প্লটটি রয়েছে তার সবটুকু নাটকীয়তা নিয়ে, যেমন লিখতেন তিনি। কিন্তু তাঁকে ২০১৭ তে পৌঁছে দিতে সঙ্গে রয়েছে কিছু সাবপ্লট, সহজ-সত্যি কঠিন বাস্তব, যা দুভার্গ্যজনকভাবে আজও সত্য। পর্দায় যা ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠেছিল কিছুদিন যাবৎ। শেষ দৃশ্য চোখে জল আনবেই, সে আপনি যতই বিভূতিভুষণ কন্ঠস্থ রাখুন বা পাঁচহাজার বার পথের পাঁচালি কিম্বা বাইসাইকেল থিভস দেখে থাকুন। ‘বাবুই পাখির খুব বুদ্ধি না রে দাদা’? পদ্মবিলের ওপার থেকে ভেসে আসা ছোটুর সরল প্রশ্ন আপনাকে পিছু ডাকবেই। সে যতই আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলুন এ পৃথিবীর প্রশ্ন-উত্তরের সংগে আপনার সব লেনাদেনা শেষ। বিভূতিভূষণ মোহনভাগ, তালক্ষীর, পুঁইশাকের নোলা নিয়ে বিপন্ন শৈশবের যে সহজ ছবি আঁকতেন, সেখানে বুঝি আজো পৌঁছে যাওয়া যায়। একটানা বর্ষা, কচুপাতার ছাতা, পদ্মবন ক্যামেরা এবং সাউন্ডস্কেপে মন ছুঁয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, রেললাইন আছে, আছে রেলগাড়িও তবে ঠিক পথের পাঁচালির মত করে নয়। কেমন ভাবে আছে জানতে হলে দেখতে হবে সহজ পাঠের গপ্প। রেলগাড়ি তো সভ্যতার অগ্রগতির প্রতীক, তা বাদ দিয়ে পথের গল্প কেমন করে হয়?
বাইসেকল থিভস দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সত্যজিত। একথা আমরা জানি। এরপর বহু ছবিতে শিশু শিল্পীদের সংগে শৈল্পিক দক্ষতায় কাজ করেছেন তিনি। দর্শক হিসেবে নূর ইসলাম ও শামিউল আলমকে (শিশু শিল্পী) এগিয়ে রাখলাম। সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরাগুলির মধ্যেই উল্লেখ থাকবে ওদের কাজের। ওদের পরিচয় জানা হল না, তবে এই ডায়লেক্ট কী অনুশীলনে রপ্ত করা সম্ভব? সব শেষে আরেকবার বলি, সহজ কথা সহজে বলাই যে ভাল, সত্যি কথা বলতে যে সাব প্লট লাগেনা নতুন বোতলে পুরনো মদের মতই তা একবার মনে পড়িয়ে দিল সহজ পাঠ… চিত্রনাট্য ও পরিচালনা মানসমুকুল পাল।
সম্প্রতি আরো একটি ছবি চর্চায় রয়েছে। যেটিও খানিকটা ‘আর্ট ফিলিম’ ঘরানার। বিলু রাক্ষস। ছবিটি দেখতে ভাল। নায়কের শিল্পী হতে না পারার দ্বন্দ্ব, কপোর্রেট মইতে চড়ার চাপ ইত্যাদি নিয়ে তৈরি ছবিটি কিছু প্রাসঙ্গিক নাগরিক সমস্যা নিয়ে কথা বলে। সমস্যার শিকড় খুঁজতে অবশ্য কোন বৃহত্তর সত্যের দিকে এগোয়নি ছবিটি। ঘুরপাক খেয়েছে চেনা বৃত্তে। তবু ছবিটি প্রাসঙ্গিক, কারণ এ বছরের সব থেকে বড় হিট বাংলা ছবির নাম পোস্ত। বিলু রাক্ষস কয়েকটি সমস্যার কথা সহজ ভাবে বলেছে, এবং সিনেমাটিক কথনের মধ্যেই বিনোদন মূল্য সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল সাম্প্রতিক অতীতে কর্পোরেটের চাকরি ছেড়ে বাংলা ছবির জগতে সফল হয়ছেন এক চিত্র-পরিচালক এবং একজন গায়ক-সঙ্গীত পরিচালক। বিলু কী কর্পোরেট ছেড়ে এসে বাণিজ্যিক সাফল্য না পেলে ফের হতাশ হয়ে পড়ত না কি খুঁজে নিত কোনো সহজ পাঠের গপ্প। ‘আর্ট ফিলিম’ তো এককালে এমনই নানা কিসিমের প্রশ্ন তুলত।