
সেই কবে আবু সয়ীদ আইয়ুব বামপন্থী নন্দনতত্ত্বের বিরোধিতা করে ‘ডেকাডেন্ট’ সাহিত্যের জয়গান করেছিলেন এ বাংলায়। তারপর কত জল কত নদী দিয়ে বয়ে গেল, কিন্তু শিল্পের দায়বদ্ধতা নিয়ে আতঙ্ক কমল না একটুও। তাই সিনেমার শেষে মরে যাওয়া আদি বোস যখন শুয়ে থাকেন, তাঁকে দেখে দর্শকদের মনে প্রশ্ন জাগে না, “সরোজিনী চলে গেলো অতদূর?/ সিঁড়ি ছাড়া – পাখিদের মত পাখা বিনা?” সে প্রশ্ন যাতে না ওঠে সেভাবেই কাহিনি সাজিয়েছেন বাংলা সিনেমার ফার্স্ট বয়।
জীবনকে অনুকরণ করতে গেলে থ্রিলার টানটান হয় না। তার জন্য একটা সাইকো লাগে। সৃজিত মুখার্জি সেই চেনা ফর্মুলাতেই নিজের দক্ষতার পুনরাবৃত্তি করতে চেয়েছেন। শেষটা যথেষ্ট প্রেডিক্টেবল হলেও পেরেছেন। পারতে তাঁকে ১০০ শতাংশ সহযোগিতা করেছেন টলিউডের নায়কদের মধ্যে একমাত্র যিনি অভিনয়টা করতে পারেন, সেই ঋত্বিক। ফলে ‘ভিঞ্চি দা’ টিকিট কেটে হলে গিয়ে দেখার মতো ছবি হয়ে উঠেছে। যদিও চিত্রনাট্যের যাবতীয় সাহায্য পেয়েও অতি অভিনয়ের ভয়াবহ দুর্বলতা একটুও অতিক্রম করতে পারেননি রুদ্রনীল। বরং বেশ বাস্তব লাগে তোতলা সোহিনীকে।
কিন্তু সে সব কথা গৌণ। মূল ব্যাপারটা হল, রাষ্ট্র ও তার আইন ও পুলিসি ব্যবস্থাকে বেপর্দা করে নিজস্ব ভঙ্গিতে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নানা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটিয়ে চলল যে চরিত্রটি, সেই চরিত্রটি সযত্নে নির্মাণ করার পরিশ্রম করলেন না পরিচালক। ডিস্টার্বড শৈশব থেকে এমন মানুষ হয়ে ওঠাটা নেহাতই কষ্টকল্পনা। উলটে গল্পটি এমন বানালেন পরিচালক, যাতে রাষ্ট্রের বদলে শিল্পীর প্রতিশোধের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল এক সাইকো রাষ্ট্রদ্রোহী। যে কিনা শহরের এক কোণে বসে মৃত মানুষের চিৎকার শোনে। অথচ প্রচলিত সিস্টেম সজ্জাশিল্পী ভিঞ্চি দাকে কাজ-সম্মান কিছুই দেয়নি। সেই ক্ষোভের কাহিনি নিয়েও থ্রিলার বানানোর কথা ভাবতে পারতেন পরিচালক। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে শিল্পীর প্রায়োরিটি ঠিক করার স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে শিল্পী চরিত্রটির শিল্পের মধ্যে বাঁচার স্বাধীনতাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন সৃজিত(স্রেফ কয়েকটি দীর্ঘ একঘেয়ে সংলাপময় দৃশ্য ছাড়া)। মনে হয় বুঝি ,’কোল্যাটারাল ড্যামেজ’-এর থেকে বড়ো সমস্যা এ দুনিয়ায় নেই।
যাই হোক, মঞ্চের ডাকসাঁইটে অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য পর্দায় আবারও ঝুলিয়েছেন। তাঁর অভিনয়ের ফ্যানরা অনেক আশা নিয়ে তাঁকে দেখতে হলে যান, কিন্তু কখনও তাঁকে বলে বলে দশ গোল দেন শাশ্বত, কখনও বা ঋত্বিক। তাঁর চোখের ভাষার দুর্বলতা বারবার নজরে আসে। শিক্ষিত স্বরক্ষেপও সবসময় কাজে আসে না। তাছাড়া এই ছবিতে তাঁর চরিত্রটির তেমন গুরুত্বও নেই। ভাবতে ভয় লাগে, আদি বোস আর বিজয় পোদ্দার বার কয়েক মুখোমুখি হলে অনির্বাণের কী অবস্থা হত।
তা হয়নি, বরং ছবির শেষে মুখ ও মুখোশদের শান্ত হতে বলেছেন অনুপম রায়। প্রেমের গানটি ছাড়া বাকি দুটো গান কে জানে কেন, গুনগুন করতে ইচ্ছে করে। আর তার মাঝে আদি বোসের প্রস্থেটিক মুখোশ লাগিয়ে সরোজিনী চলে যায় ‘কোন দূর মেঘে’। নিৎসেও তাঁর হদিশ পান না।