প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী
পুরো ব্যাপারটাই মাটি হয়ে যেত, দেবকে যদি কিছু করে দেখানোর সুযোগ দিতেন অপর্ণা সেন। অমন সব বাঘা বাঘা অভিনেতার ছড়াছড়ি যেখানে, সেখানে দেবকে ঢোকানো যে ঝুঁকির, তা অপর্ণার জানারই কথা। তাই জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমাটি বানাতে গিয়ে কোনও চান্স ফ্যাক্টর রাখেননি তিনি। ব্রডওয়ের মেজাজে শেক্সপিয়র, আপাদমস্তক একটি সিরিয়াস ছবিকে ছন্দে ছন্দে সাজানো। সত্যি বলতে ‘আরশিনগর’-এ অপর্ণা সেন চমকে দিয়েছেন বা চালু ভাষায় ফাটিয়ে দিয়েছেন।
বঙ্গ সংস্কৃতির বন্ধ্যা বাজারে যখন যে কোনও কিছু নিয়েই যারপরনাই মাতামাতির পরিবেশ করে তোলার চেষ্টায় মিডিয়া আদা জল খেয়ে লেগে থাকে, তখন এমন একটা সিনেমা বানাতে হল সত্তর-ছোঁয়া এক পরিচালককে, এটাই যন্ত্রণার। তবু যাক, সময়ের দাবি মেনে একটা ছবি তো হল, দাঙ্গার অর্থনীতি আর রাজনীতির একটা নিখুঁত চিত্রায়ন তো বাংলার সেলুলয়েডে ধরা থাকল, শেক্সপিয়রকে ‘নতুন করে দেখার’ চালু ফ্যাশনকে ১৮০ ডিগ্রি উল্টে একটা আইকনিক ছবি বানানো যে সম্ভব, তা তো প্রমাণিত হল।
পার্বতী বাউল থেকে দেবজ্যোতি মিশ্র, গান এ ছবির সম্পদ। সেট, কোরিওগ্রাফি, অ্যাকশনের দৃশ্যে নাচের প্রয়োগ, ছন্দে ছন্দে ডায়লগ – আধুনিক সিনেমার ভাষায় বাংলা ছবি দেখার এই অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। আপাদমস্তক সিরিয়াস সিনেমায় (মোড়কহীন) এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এর আগে বাংলায় হয়নি।
অভিনয় নিয়ে তো বলার কিছু নেই। কে না আছেন। ওয়াহিদা রহমান, রূপা গাঙ্গুলি, শংকর চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, দেবরাজ রায়, শুভাশিস মুখার্জি, পরান বন্দ্যোপাধ্যায় (চিনতে সময় লাগবে), অপরাজিতা আঢ্য, জয়া শীল (দু একজন বাকি রয়ে গেল) এবং এক ও অনন্য যিশু সেনগুপ্ত। ব্যোমকেশ, রাজকাহিনি পেরিয়ে আরশিনগরে এসে পড়েছেন যিশু। অলিগলি পেরিয়ে তার অভিনয় জীবন এখন জাতীয় সড়কে। আবীর, পরমব্রতর মতো মিডিয়ার নির্মাণদের কিছুটা টেনশন এ বার হওয়াই উচিত। জুলিয়েট ওরফে জুলেখা খানের ভূমিকায় ঋত্বিকা সেন বেশ ভালো।
অপর্ণা সেন তাঁর এই সাহসী ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় কাউকেই তেমন খাপ খুলতে দেননি। পুরোটাই ডিরেক্টরস মুভি। তাই রোমিও ওরফে রণ ওরফে ঘাটালের সাংসদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অভিনয়ের নিন্দা করার পাশাপাশি বলে রাখা দরকার, ফর্মে নতুনত্ব, অনেক জরুরি কথা প্রায় অনায়াস দক্ষতায় বলতে গিয়ে রণ-জুলির প্রেমটা তেমন জমেনি ‘আরশিনগর’-এ। অথবা সেটা দেখতে না পাওয়া হয়তো এই দর্শকেরই দুর্বলতা।
সে যা-ই হোক, বাঙালি যে সিনেমাটা বানাতে জানতো শুধু নয়, এখনও জানে, তা ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’–এর পর আরও এক বার প্রমাণিত হল। ভেরোনা এখন আমার আপনার ঘরের পাশেই। সেই আরশিনগরে পার্বতী বাউল গান গেয়ে চলেছেন, পড়শিকে স্পর্শ করতে বলছেন। ভেবে দেখুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো….
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।