শম্ভু সেন
আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,/বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।
সত্যিই, এক টুকরো বিশ্বলোকের দর্শন পেলাম সোমবার সন্ধ্যায়, সাক্ষী থাকলাম এক বিরল সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার, আর একটু সমৃদ্ধ হল অভিজ্ঞতার ঝুলি।
উপলক্ষ, আর্জেন্তিনার স্বাধীনতার ২০০ বছর। স্থান, আইসিসিআর-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেন্টারের সত্যজিৎ রায় অডিটোরিয়াম। উদ্যোক্তা, ভারতে আর্জেন্তিনা রিপাবলিকের দূতাবাস, ইন্দো হিস্পানিক ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকাডেমি আর সোনাঝুরি।
আর্জেন্তিনা বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভাসে একটা ফুটবল–পাগল দেশের ছবি, যার প্রতিনিধিত্ব করেন মারাদোনা আর মেসি। তাই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কোপা আমেরিকার ফাইনাল দেখতে বসে পড়ে বাঙালি, চিলের কাছে আর্জেন্তিনার হারের পর ব্যথায় ভরে ওঠে মন। আর সেই খেলায় হারের জেরে মেসি যখন আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের কথা ঘোষণা করেন, তখন সমস্ত আর্জেন্তিনাবাসীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বাঙালি কাতর ভাবে বলে ওঠে, ‘মেসি, ফিরে এসো’।
মারাদোনা আর মেসির বাইরে বাঙালির কাছে আর্জেন্তিনার পরিচিতি রবীন্দ্রনাথের সূত্র ধরে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে পেরু যাওয়ার সময় কবি অসুস্থ হয়ে পড়লে আর্জেন্তিনায় যাত্রাবিরতি ঘটান। সেখানে তিনি সে দেশের নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, লেখিকা ও সাহিত্য সমালোচক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ওকাম্পোর সাহচর্যে কবি সেখানে প্রায় দু’ মাস কাটান। দু’ জনের মধ্যে গড়ে ওঠে এক বিরল মধুর সখ্যতা।

এ হেন মারাদোনা, মেসি আর রবীন্দ্রনাথের বাইরে গিয়ে যে ভারত-আর্জেন্তিনার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া উচিত, সোমবারের সন্ধ্যায় উপস্থিত বক্তাদের মধ্যে ভাষণে সেই সুরই ধরা পড়ল।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতে আর্জেন্তিনা দূতাবাসের সংস্কৃতি শাখার প্রধান মার্তিন সুয়াইয়া। মার্তিনের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ইন্দো হিস্পানিক ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর ড. দিব্যজ্যোতি মুখোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, সাড়ে চার মাস হল ভারতে এসেছেন তিনি। আর তাঁর কলকাতায় আসা মূলত দেশের স্বাধীনতার ২০০ বছরের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এবং স্প্যানিশ ভাষার চর্চা নিয়ে খোঁজখবর করতে। উল্লেখ্য, আর্জেন্তিনা হল স্প্যানিশভাষী দেশ হিসাবে বিশ্বে বৃহত্তম। কলকাতায় এসে এই শহরের ভালোবাসায় বাঁধা পড়েছেন মার্তিন। কূটনীতিকের আনুষ্ঠানিক জোব্বা ঝেড়ে ফেলে মার্তিন এ দিন ছিলেন পুরোপুরি ঘরোয়া। তাঁর ছোট্ট ভাষণে মন জয় করে নিলেন কলকাতার। মার্তিনের বক্তৃতায়েও এল ফুটবল, এলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্ববাসীর একতা, তাঁদের মধ্যে মৈত্রীর যে কথা কবি বলেছেন, তা যে আজকের বিশ্বে খুবই প্রাসঙ্গিক, সে কথাই মনে করিয়ে দিলেন মার্তিন।
এর আগে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেন্টারের আঞ্চলিক অধিকর্তা গৌতম দে স্পষ্ট বলেন, আমাদের দেশ পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিসাধনে যতটা আগ্রহী, লাতিন আমেরিকার দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির ব্যাপারে ঠিক ততটাই উদাসীন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, ফুটবল আর রবীন্দ্রনাথের বাইরেও দু’ দেশের সম্পর্কের উন্নতির বিপুল সুযোগ রয়েছে।
এ দিনের অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল সাংস্কৃতিক অংশটুকু। অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন সৃজিত দত্ত, একটি আর্জেন্তিনীয় লোকগীতি শুনিয়ে। যে স্প্যানিশ গানটি শুনলে বোঝা যায়, আর্জেন্তিনায় পারিবারিক বন্ধনটি কতটা দৃঢ়। মাঝে আরও দু’টি আর্জেন্তিনীয় লোকগীতি এবং তাদের বাংলা অনুবাদের এক ঝলক শোনা গেল অ্যাশলি রায় ও সৃজিত দত্তের কণ্ঠে। এটি ইন্দো হিস্প্যানিক ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকাডেমির প্রকাশিতব্য একটি সিডির অংশবিশেষ। এতে সুর সংযোজনা ও পরিচালনা করেছেন বিখ্যাত সংগীত পরিচালক দ্রোণ আচার্য।

অনুষ্ঠানের শেষে ছিল ‘সোনাঝুরি’র এক অনবদ্য উপস্থাপনা ‘অনন্য রবীন্দ্রনাথ’ – গান, কবিতা আর গদ্যপাঠের বাংলা-স্প্যানিশ কোলাজ, এক অত্যাশ্চর্য মিশেল। এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বহুমুখী রবীন্দ্রনাথকে। মা-সন্তানের সম্পর্ক কেমন ছিল কবির কাছে, নারীকে কী চোখে দেখতেন কবি, কবির কাছে জাতীয়তাবোধ মানে কী, কবির দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে ওই আলেখ্যে। আর অবশ্যই ওকাম্পোর সঙ্গে সম্পর্ক। ১৯১৪-য় প্রকাশিত আন্দ্রে জিদের গীতাঞ্জলি-অনুবাদ পড়ে রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী হয়ে পড়েন ওকাম্পো। তার পর কেটে গেল দীর্ঘ দশটা বছর। হঠাৎই সুযোগ ১৯২৪-এ। পেরু যাচ্ছিলেন কবি। পথে অসুস্থ। ঠিক হল বুয়েনস আইরেসে কিছু দিন থাকবেন। উঠলেন প্লাসা হোটেলে। খবর পেয়ে কবির সঙ্গে পরিচিত হতে ওকাম্পো পৌঁছে গেলেন হোটেলে। এবং অসুস্থ কবির দেখভাল করতে তাঁকে নিয়ে গেলেন বুয়েনস আইরেসের উপকণ্ঠে প্লাতা নদীর তীরে সান ইসিদ্রো-তে। সেখানে বোনের বাড়ি ‘মিরাল রিয়ো’-তে রাখলেন কবিকে। হাঁটা-দূরত্বে ছিল ওকাম্পোর আরেকটি বাড়ি। চলতে লাগল নিয়মিত যাতায়াত। গভীর সখ্যতার বাঁধনে বাঁধা পড়লেন দু’ জনে। এই বাড়িতে প্রায় দু’ মাস থেকে কবি ৩০টি কবিতা রচনা করেন। সেই কবিতাগুলি বাঁধা পড়ল ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থে, যার প্রকাশ ১৯২৫-এ, উৎসর্গ কবির ‘বিজয়া’ তথা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। ‘পূরবী’র খসড়ায় যে বিচিত্র কাটাকুটি করতেন রবীন্দ্রনাথ, তা নজরে আসে ওকাম্পোর। ওকাম্পোর ক্রমাগত উৎসাহদান এবং সেখান থেকেই শেষ বয়সে কবির চিত্রকর হয়ে ওঠা। ১৯৩০-এ প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজনে উদ্যোগী ভূমিকা ছিল ওকাম্পোর। সেখানেই দ্বিতীয় ও শেষ বার দেখা দু’জনায়।
এ ভাবেই আর্জেন্তিনার স্বাধীনতার ২০০ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানের সূত্রে সোমবার সন্ধ্যায় আমরা ফিরে যাই রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর নিখাদ অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সেই দিনগুলিতে। ৯ জুলাই আর্জেন্তিনার স্বাধীনতা দিবস। কলকাতার সৌভাগ্য, দিল্লির দূতাবাসে সেই উৎসব আনুষ্ঠানিক ভাবে পালনের আগেই আর্জেন্তিনীয় দূতাবাস, ইন্দো হিস্পানিক ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকাডেমি আর সোনাঝুরির উদ্যোগে আইসিসিআর-এ পালিত হল স্বাধীনতা-উৎসব। আমরা উপভোগ করলাম এক অনাবিল আনন্দ-সন্ধ্যা। ধন্যবাদ ত্রয়ীকে।
লিড ছবি: বক্তৃতা দিচ্ছেন ভারতে আর্জেন্তিনা দূতাবাসের সংস্কৃতি শাখার প্রধান মার্তিন সুয়াইয়া।
ছবি: শ্রয়ণ সেন
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।
কভার করবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ! শুধু একটা কথা, আমি শ্রীজিৎ, সৃজিত নই। 🙂