উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়
জয়নগর: আজ বাদে কাল দেবীপক্ষের সূচনা। উমা আসবেন সপরিবার বাপের বাড়িতে। আকাশে-বাতাসে এখন শিউলির গন্ধ। শারদোৎসব বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকে বাঙালি তাঁর যাবতীয় আনন্দ-উল্লাস-আরাধনাকে একসূত্রে গেঁথেছে এই দুর্গাপুজোর মাধ্যমে। বনেদি থেকে বারোয়ারি, সর্বত্রই কোনো এক শক্তি বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত প্রাত্যহিকতার গ্লানিময়তা থেকে আমাদের দূরে রাখে।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার অন্যতম প্রাচীন পৌরশহর জয়নগরকে আমরা সকলেই চিনি সুপ্রসিদ্ধ মোয়ার প্রস্তুতকেন্দ্র হিসেবে। তবে জয়নগরের মোয়া যেমন ঐতিহাসিক, তেমনই জয়নগর অঞ্চলের ইতিহাসও একইরকমভাবে সুপ্রাচীন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। আদিগঙ্গার প্রাচীন প্রবাহপথে সুন্দরবনের অন্তগর্ত এই অঞ্চল গড়ে উঠেছে পাশাপাশি দুটি এলাকা জুড়ে, যার একটি হল জয়নগর, অন্যটি মজিলপুর।
জয়নগরের কিছু ঐতিহাসিক বনেদি বাড়ি এখনও তাদের ইতিহাসকে আগলে ধরে বেঁচে রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বেশ কয়েকটি প্রাচীন বনেদি বাড়ি দুর্গাপূজার মধ্যে অন্যতম হল জয়নগরের দত্ত জমিদারবাড়ির দুর্গাপুজো। অনেকেই আবার এই দত্তবাড়ির দুর্গাপূজাকে সাদা দত্তবাড়ির দুর্গাপুজো বলে। ১৬৭৫ সালে জমিদার রামচন্দ্র দত্ত কলকাতা থেকে সুন্দরবনে এসে নিজের জমিদারি স্থাপন করেন। এরপর মা দুর্গার স্বপ্নাদেশে শুরু হয় দুর্গাপুজো। তৎকালীন রামচন্দ্র দত্তের জমিদারি ছিল ৯৪টি মৌজা এবং ৬টি থানা জুড়ে। এতটাই ছিল জমিদারির আধিপত্য। দশদিন ধরে এই দত্তবাড়িতে পূজা উপলক্ষ্যে মহাকর্মযজ্ঞ চলত। মহালয়ার পরের দিনেই হত দেবীর বোধন। এর পর টানা ১০ দিন চলত দেবীর পূজা। একসময় বন্দুকে আওয়াজ করে পুজোয় বসতেন পুরোহিতরা।
কালের নিয়মে জমিদারিপ্রথা আর নেই। জমিদারি চলে গেলেও এখনও রয়ে গেছে দুর্গাপূজার সেই প্রাচীন রীতিনীতি, যদিও অতীতের সেই জৌলুস অনেকটাই ভাটা পড়েছে। এখনও এই দত্তবাড়িতে টানা ১০ দিন ধরে দেবীর আরাধনা করা হয়। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতানুসারে এখানে পূজিত হন দেবী দুর্গা। এখনও প্রথা মেনেই রথযাত্রার দিন কাঠামোপূজা হয়। বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পী, পুরোহিত ও বাদ্যকাররা এই বাড়িতে পূজোয় শামিল হন। বলিদানপ্রথা এখনও রয়েছে এই দত্তবাড়িতে। পুজো শুরু হওয়ার আগে এখন আর বন্দুকের আওয়াজ করা হয় না বটে তবে আতশবাজি জ্বালিয়ে পুজো শুরু করা হয়।
দত্তবাড়ির দুর্গাপুজো এ বছর ৩৪৯তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। এই দত্তবাড়িতে বারুইপুরের ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন আনাগোনা ছিল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি দত্তবাড়িতে প্রায়ই এসে ছুটি কাটাতেন এবং দত্তবাড়ির দুর্গাপুজোয় শামিল হতেন। জয়নগরের এই দত্তবাড়িতে বসেই তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসটি। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি উপন্যাসে এই দত্তবাড়ির উল্লেখ রয়েছে।
পরিবারের এক সদস্য শিবেন্দ্রনারায়ণ দত্ত বলেন, “কর্মসূত্রে কলকাতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় পরিবারের সদস্যরা থাকলেও পুজোর সময় তাঁরা তাঁদের এই বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। প্রাচীন যে প্রথা সেই প্রথা মেনেই এখনও পর্যন্ত ১০ দিনের দুর্গাপূজা আমরা করে থাকি। এই পূজোর সঙ্গে বহু ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। দত্তবাড়ির ছেলে যোগেন্দ্রনারায়ণ দত্তের বন্ধু হওয়ার সুবাদে তৎকালীন বারুইপুরের ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্রের দত্তবাড়িতে আনাগোনা ছিল। এই দত্তবাড়ির প্রতি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুরও নিবিড় টান ছিল। নেতাজি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বেশ কয়েকটি সভা এই দত্তবাড়ির সামনের মাঠেই করেছিলেন। এখনও নেতাজির পৈতৃক বাড়িতে দত্তবাড়ির দুর্গাপুজোর প্রসাদ পাঠানো হয়।”
বহু ইতিহাসের সাক্ষী দত্তবাড়ি পুজোর কটা দিন যেন আগের মহিমায় ফিরে যায়। তাই এত কিছুর মধ্যেও বনেদিয়ানার স্বাদ পেতে আসতেই হবে আপনাকে জয়নগর দত্তবাড়িতে।