ধর্মীয় বেড়াজালের ঊর্ধ্বে উঠে দুর্গাপুজো আজ এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রতীক। একটা সময় ছিল যখন পুজো এরকম জাঁকজমক, জৌলুসে পরিপূর্ণ কর্পোরেট আকার ধারণ করেনি। ফ্ল্যাট কালচার তৈরি হয়নি। পাড়ার বাসিন্দারা একে অপরের সুখদুঃখের সঙ্গী ছিল। ‘দূর দীপবাসিনী’ হয়ে দূরে সরে যায়নি। তাই সামাজিক বন্ধন বলে বিবেচনা করেই পুজোর ক’টাদিন গোটা পাড়ার ঘরবাড়ি হয়ে উঠত পাড়ার পুজোর মণ্ডপ। পুজোর ক’টাদিনের সমস্ত আনন্দ ভাগাভাগি করতে, মজা করতে আট থেকে আশি সকলের ধ্যানজ্ঞান, বলা ভালো ‘অবারিত’ দ্বার হয়ে উঠত পুজোর মণ্ডপ। বাঙালির পুজোকে ঘিরে নস্টালজিয়াকে উসকে দিতে হাজরা উদয়ন সঙ্ঘের এবারের থিম ‘অবারিত’।
১৯৪৬ সালের টালমাটাল সাম্প্রদায়িক পরিবেশের মধ্যে জন্ম হাজরা উদয়ন সঙ্ঘের। ৭৮টি বসন্ত পার করেছে দক্ষিণ কলকাতার এই ঐতিহ্যবাহী পুজো কমিটি। গত ৭৮ বছরে নিষ্ঠার সঙ্গে সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মতো রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করে চলেছে হাজরা উদয়ন সঙ্ঘ। ৭৯তম বছরে তাদের পুজোর থিম ‘অবারিত’। সৃজনের দায়িত্বে রয়েছেন নবীন থিমশিল্পী সূচনা। ব্যক্তিগত জীবনে যিনি বিশিষ্ট থিমশিল্পী বিমল সামন্তর সুযোগ্যা কন্যা।
চলছে মণ্ডপসজ্জার প্রস্তুতি। ছবি: রাজীব বসু।
হাজরা উদয়ন সঙ্ঘের পুজোর থিম প্রসঙ্গে সূচনা বলেন, “একটা সময় পুজো আমাদের কাছে শুধু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ছিল না। ধর্মের বেড়াজালের ঊর্ধ্বে উঠে তা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বন্ধন। আমাদের গোটা বছরের রসদ আমরা খুঁজে পেতাম পুজোর ক’টাদিন ওই মণ্ডপে আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, স্বজনদের সঙ্গে সুখদুঃখ, ভাবনার আদানপ্রদান করে। এই সামাজিক বন্ধনই আমাদের সবার সঙ্গে সবাইকে একত্রিত করে রাখত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি কর্পোরেট ও ব্যবসায়িক ইঁদুরদৌড়ে। তরুণ প্রজন্ম আজ উন্নত জীবনের সন্ধানে দেশছাড়া। তারা আজ অন্য জায়গার বাসিন্দা। আমরা কোথাও আজ অনুভব করছি কর্মব্যস্ত জীবনের জেরে পুরোনো সম্পর্ক, আত্মিক বন্ধন কোথাও যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক, সামাজিক বন্ধনের সুতো যেন আজ বড়োই আলগা হয়ে যাচ্ছে।”
“এবছর হাজরা উদয়ন সঙ্ঘের পুজোয় তাই পুজো ঘিরে আমাদের অতীতের সব মধুর স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা নিয়েছি”, জানালেন সূচনা। তাঁর কথায়, “হাজরা উদয়ন সঙ্ঘের এবারের থিম ‘অবারিত’। আমাদের লক্ষ্য হল পুজোর মধুর স্মৃতিকে ফের একবার জাগিয়ে তোলা।”
কোথায় এই মণ্ডপ
শরৎ বোস রোড এবং হাজরা রোডের মোড় থেকে হাজরা রোড ধরে হাজরা মোড়ের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলে বাঁদিকে গলির মধ্যে হাজরা উদয়ন সঙ্ঘ। অথবা শরৎ বোস রোডে রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানের পাশের রাস্তা নন্দলাল জিউ রোড ধরে খানিকটা এগিয়ে ডান দিকে গেলে পেয়ে যাবেন হাজরা উদয়ন সঙ্ঘ।
আরও পড়ুন
দুর্গোৎসব ২০২৪: সমাজে আজও ‘আমরা-ওরা’, ব্রাত্যজনের কাহিনিকেই তুলে ধরছে শিবমন্দির