বনেদি বাড়ির পুজোর ইতিহাস ছুঁয়ে দেখতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে শোভাবাজার রাজবাড়িতে। সেই সূত্রে অলোককৃষ্ণ দেবের কাছে।

রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সপ্তম প্রজন্ম অলোককৃষ্ণ। বংশের বড় ছেলে। ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দিলেন। কথার মাঝে কী বলে ডাকব যখন ভাবছি, বলে উঠলেন, “আমি কিন্তু আট থেকে আশি সবার অলোকদা” – ব্যাস! সব নিয়ম ভেঙে শুরু হল আড্ডা। আমার আবদারে একটুও বিরক্ত না হয়ে বলতে শুরু করলেন রাজবাড়ির পুজোর ইতিহাস।

শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা রাজা নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭ সালে প্রথম দুর্গাপুজো করেছিলেন। নিজের সন্তান না থাকায় ভাইপো গোপীমোহনকে দত্তক নেন, পরে নবকৃষ্ণের এক ছেলে হয়। সেই ছেলে রাজা রাজকৃষ্ণ দেব ১৭৯০ সালে গোপীনাথের পুজো ছেড়ে রাস্তার উল্টোদিকে শুরু করেন নতুন পুজো। এবছর তাঁদের ২২৭তম পুজো।
দুর্গাকে বাড়ির মেয়ে হিসেবে পুজো করা হয় এখানে। এক চালচিত্রের প্রতিমা। দুর্গা এখনও থাকেন চিকের আড়ালে, রাজবাড়ির মেয়েরা যেরকম থাকতেন। একে বলে জগজগা।
পুজোর তিন দিন পাঁঠাবলির প্রচলন আছে আজও। অন্ন ভোগের রেওয়াজ নেই, তার বদলে আছে রাজবাড়ির ভিয়েনে তৈরি মিঠাই। আগে তৈরি হত প্রায় ৫০-৬০ রকমের মিঠাই, এখন কারিগর কম, তা-ও নেই নেই করে ২০ থেকে ৩০ রকমের মিঠাই তৈরি হয়।
সন্ধিপুজোর আরম্ভ আর শেষ জানানোর জন্য আগে ব্যবহার করা হত কামান। এখন অবশ্য ব্ল্যাংক ফায়ার করা হয় বন্দুকে।
রাজবাড়ির পুজোই শুধু নয়, পুজো সম্পর্কিত সমস্ত আনুষঙ্গিক কাজ চলে আসছে বংশ পরম্পরায়। প্রতিমাশিল্পী, পুরোহিত তো বটেই, এমনকি যাঁরা পুজোর ভোগ রাঁধেন, যাঁরা দশকর্মা-সামগ্রী সরবরাহ করেন, যাঁরা জল সরবরাহ করেন, যাঁরা সানাই-ব্যান্ড বাজান, তাঁরাও ছ’-সাত পুরুষ ধরে এই কাজ করে আসছেন। শুনলে আশ্চর্য হতে হয়, যাঁদের নৌকোয় প্রতিমা বিসর্জন হয়, তাঁরাও সেই নবকৃষ্ণ দেবের আমল থেকে এই কাজ করে আসছেন। বংশ পরম্পরায় প্রতিমা তৈরির যে প্রথা চলে আসছে সেই প্রথা ধরে রাখার দায়িত্ব এখন বর্তেছে দিলীপ পালের উপর।
এপার বাংলার যে কোনো বাড়ির মতোই মেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় দশমীর দিন চালু আছে কনকাঞ্জলি প্রথা। মেয়েকে রওনা করিয়ে খবর পাঠানো হয় জামাইকে। দুখানা নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া হয়, একটা বাড়ির সামনে, অন্যটা নৌকোয়। দুটো পাখি কেন জানতে চাওয়ায় রসিক অলোকদা বলে উঠলেন, “ওমা! একটা যদি মিস করে যায়, আরেকটা স্ট্যান্ড বাই রাখতে হবে তো!” গত সাত-আট বছর ধরে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে বন্ধ হয়ে গেছে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো। এখন ভরসা মাটির নীলকণ্ঠ।
আর বিসর্জন কীভাবে হয় জানতে চাওয়া হলে অলোককৃষ্ণবাবু জানান, রাজবাড়ি থেকে বিসর্জনের দিন বাগবাজারের জোড়াঘাট অবধি প্রতিমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর চাপানো হয় নৌকোয়।
গল্পে গল্পে সন্ধে হয়ে এসেছে। রাজবাড়িতে সাজো সাজো রব। খুব ব্যস্ততা চারপাশে। মেয়ে আসছে বাপের বাড়িতে। ভাবছেন, পুজোর এখনও দিন পনেরো দেরি, এত আগে থেকে ব্যস্ততা কীসের? বাঃ! রাজবাড়ি বলে কথা। দুর্গা এখানে কদিন বেশি থাকবে না বুঝি? দেবীপক্ষের সাতদিন আগেই বোধন হয় দেবীর। এটাই বরাবরের নিয়ম। তা হলে এই শনিবারেই তো বোধন!
এবার আমার ফেরার পালা। সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন অলোকদা। ওঁর চোখেমুখে যেন সত্যিই মেয়েকে ঘরে আনার আকুলতা। তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে খুব মনে পড়ছিল একটা চেনা সুর- ‘যাও যাও গিরি, আনিতে গৌরী, ঊমা বড় দুঃখে রয়েছে’।
ছবি সৌজন্য : অমলকৃষ্ণ দেব