মহাসপ্তমীতে স্নানের পর মণ্ডপে নবপত্রিকার প্রবেশ, আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু দুর্গাপুজোর

মহাসপ্তমীতে স্নানের পর মণ্ডপে নবপত্রিকার প্রবেশ ঘটে। আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুজো।

0
ছবি: সংগৃহীত

পাপিয়া মিত্র

নাতনির হাত ধরে ঠাম্মি দুর্গাঠাকুর দেখতে গিয়েছেন। ঠাম্মি না এক রত্তি নাতনি, কে যে কারও অভিভাবক ভাবা যায় না। অবশ্য ভাবার দরকার নেই। ঠাকুর দেখা নিয়ে কথা। কিন্তু ওই যে প্রশ্নের ঝাঁক। গণেশের পাশে ঘোমটা দেওয়া গাছটা কে? লক্ষ্মীর পেঁচা কেন চশমা পরে? কার্তিকের ময়ূর কেন নাচছে না? ঠাম্মি হয়রান। কিন্তু গণেশের পাশে ঘোমটা দেওয়া গাছটা কি গণেশের বৌ, এটা মোক্ষম প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর জানতে জানতে জীবনের এক বেলা কেটে গেল।

মহাসপ্তমীতে স্নানের পর মণ্ডপে নবপত্রিকার প্রবেশ ঘটে। আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুজো।

এই নবপত্রিকা নিয়ে তো কত ক্লাব কত সময় থিম করেছে। কিন্তু নবপত্রিকা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমকে বোঝাতে বোঝাতে থিমকর্তাদের কালঘাম ছুটে গিয়েছে। গণেশের পাশে লালপাড় শাড়ি জড়িয়ে যেটি থাকে সেটি নবপত্রিকা নামে পরিচিত। এ বার প্রশ্ন এরকম নামই বা হল কেন? বা ইনি কে?

দুর্গাপুজো বাঙালির শ্রেষ্ঠ পুজো হলেও সারা ভারত জুড়ে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়, তবে নানা নামে। যেমন কন্যাকুমারিকায় ‘কন্যাকুমারী’, বিন্ধ্যাচলে ‘বিন্ধ্যবাসিনী’, দাক্ষিণাত্যে ‘অম্বিকা’, কর্ণাটকে ‘কল্যাণী’ ও ‘জয়দুর্গা’, গুজরাতে ‘হিঙ্গলা’ ও ‘রুদ্রাণী’, কাশ্মীরে ‘অম্বা’, জম্মুতে ‘বৈষ্ণোদেবী’, হরিদ্বারে ‘হরিপ্রিয়া’, রাজস্থানে ‘ভবানী’, মিথিলায় ‘উমা’, অমরকণ্টকে ‘চণ্ডিকা’ ইত্যাদি। বঙ্গদেশে ‘দুর্গা’ তো আছেনই।

দুর্গাপুজো প্রকৃতপক্ষে শাকম্ভরী মূর্তিকল্পনার আড়ালে নবপত্রিকার পুজো। কৃষিভিত্তিক সমাজ গঠনের পর্বে শষ্যদায়িনী ধরিত্রীমাতার আরাধনাই নবপত্রিকার পুজো। বাঙলার দুর্গাপুজোর এই নবপত্রিকাকেই কলাবৌ রূপে পুজো করা হয়। পুরাণ সূত্র থেকে জানা যায়, দেবীর যে ন’টি রূপ সেগুলির প্রতীক হিসেবে ন’টি বিভিন্ন গাছের অংশ নিয়ে গড়া হয় নবপত্রিকা। ন’টি বিভিন্ন গাছ হল কলাগাছ (ব্রহ্মাণী), কালোকচু (কালিকা), মানকচু (চামুণ্ডা), হলুদ (উমা), জয়ন্তী (কার্তিকী), বেল (শিবা), ডালিম (রক্তদন্তিকা), অশোক (শোকরহিতা), ধান (লক্ষ্মী)।  সাদা অপরাজিতা লতা ও হলুদ রঙের সুতো দিয়ে এগুলি বেঁধে তৈরি করা হয় নব পত্রিকা।

বাঙলার দুর্গাপুজোয় নবপত্রিকার স্নান একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বারোয়ারি পুজোতে গঙ্গা বা অন্য কোনো নদী বা পুকুরে নবপত্রিকা স্নান করানো হয়। আর বাড়ির পুজোতে বেশ ঘটা করে নবপত্রিকা স্নান অনুষ্ঠিত হয়।

কলাবৌ বা নবপত্রিকা স্নানের জন্য লাগে তেল-হলুদ, অষ্টকলস, মাথা ঘষা, পঞ্চরত্নের জল, পঞ্চামৃত (দুধ, দই, ঘি, চিনি, মধু), পঞ্চশস্য (ধান, যব, তিল, মুগ, মাসকলাই), পঞ্চগব্য, পঞ্চকষায় (জাম, কুল, বকুল, বেড়েলা, শিমুল ছালের রস), বৃষ্টির জল, ডাবের জল, শিশির, সমুদ্রের জল, তীর্থের জল, আখের রস, বরাহদন্ত মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা, সর্বোষধি, মহৌষধি, চতুষ্পদ মৃত্তিকা, পদ্মরেণু, অগুরু, চন্দন, ফুলন তেল — এই সব উপাচারে কলাবৌকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে গণেশের পাশে রাখা হয়, যার অন্য নাম ‘পুষ্টি’।

দুর্গাকে নবপত্রিকা রূপে পুজো করা হলেও তাঁর প্রতীক এই ‘পুষ্টি’ বা কলাবৌকে কেন দুর্গা পুত্র গণেশের পাশে স্থাপন করা হয়, তার আবার নানা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। ভারতীয় উপমহাদেশে সভ্য মানুষের উদ্ভব ও বিকাশের পর্যায়ে আদিম সাম্যতন্ত্রী সমাজ ও দাস সমাজের মধ্যবর্তী স্তর থেকে এই সব দেবদেবীর পুজোর সূচনা হয়। লিখিত রূপে পরবর্তী কালে এলেও শাস্ত্রীয় ধ্যানধারণাগুলি তৈরি হতে থাকে।

একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, গনেশ মাতৃভক্ত। তাই দুর্গার চালচিত্রে নবপত্রিকাকে সর্বদাই গণেশের পাশে রাখা হয়। নবপত্রিকা তো মা দুর্গারই প্রতীক। সুতরাং তাঁর তো সবচেয়ে প্রিয় সন্তানের পাশে থাকাই স্বাভাবিক। আসলে নবপত্রিকাকে তো দুর্গার মৃন্ময়ী রূপের পাশে কোথাও তো একটা জায়গায় রাখতে হবে। গণেশের পাশের জায়গাটিকেই উপযুক্ত জায়গা হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে।  

dailyhunt

খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল

বিজ্ঞাপন