ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে মহালয়ার দিনটি। পিতৃপক্ষের অবসান হতে চলেছে। রাত পোহালেই শুরু হয়ে যাবে দেবীপক্ষ। শারদীয়া দুর্গাপূজা তথা অকালবোধনের লগ্ন এসে যাবে।
কিন্তু শরতের এই পুজো অকালবোধন কেন? সংস্কৃত ‘অকাল’ ও ‘বোধন’ শব্দদুটি বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ‘অকাল’ শব্দের অর্থ ‘অসময়’ অর্থাৎ যে সময় শুভকর্মের পক্ষে অযোগ্য, অনুপযুক্ত। অন্যদিকে ‘বোধন’ শব্দটির অর্থ হল ‘উদ্বোধন’। এ ক্ষেত্রে নিদ্রাভঙ্গ করা বা জাগানো। ‘অকালবোধন’ শব্দবন্ধটির অর্থ ‘অসময়ে বোধন বা জাগরণ’। শরৎকালে দেবীদুর্গার আরাধনা অসময়ের আরাধনা। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই সময়কে ‘অকাল’ বলা হচ্ছে কেন?
শ্রাবণ থেকে পৌষ, এই ছ’মাস চলে সূর্যের দক্ষিণায়ণ অর্থাৎ সূর্যের গতি থাকে দক্ষিণদিক দিয়ে। আর মাঘ থেকে আষাঢ়, এই ছ’মাস চলে সূর্যের উত্তরায়ণ অর্থাৎ সূর্যের গতি থাকে উত্তরদিক দিয়ে। দেবতাদের কাছে উত্তরায়ণ হল দিন আর দক্ষিণায়ণ হল রাত্রি। রাত্রিকালে দেবীদুর্গা নিদ্রিত থাকেন। সেই অর্থে এই দক্ষিণায়ণের সময়টুকু অকাল। দেবী নিদ্রিত থাকেন বলে তাঁর বোধন করে অর্থাৎ তাঁকে জাগিয়ে পুজো করতে হয়। শরৎকালে দুর্গাপুজো অসময়ের পুজো বলেই একে ‘অকালবোধন’ বলা হয়।
হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে দুর্গাপূজার বিধিসম্মত সময় হল চৈত্রমাস। চৈত্রমাস বসন্ত ঋতুর মধ্যে পড়ে। তাই চৈত্রমাসে দুর্গার যে পুজো হয় তা বাসন্তীপূজা নামে পরিচিত। পুরাণে আছে, রাজা সুরথ দুর্গাপূজা করেছিলেন বসন্তকালেই। রাজা সুরথ চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথিতে শাস্ত্রবিধিমতে দেবী দুর্গতিনাশিনীর পূজা করেছিলেন। বসন্তকাল উত্তরায়ণে পড়ে আর উত্তরায়ণে যেহেতু দেবতাদের দিন তাই ওই সময়ে বাসন্তীপূজায় বোধনের প্রয়োজন হয় না।
রামচন্দ্র লঙ্কার রাজা রাবণকে বধ করার আগে দেবী পার্বতীর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে তাঁর পূজা করেছিলেন। সময়টা ছিল শরৎকাল, সূর্যের দক্ষিণায়ণের অন্তর্গত। সেই সময়টা দেবতাদের রাত। তাই দেবী পার্বতীকে জাগানোর প্রয়োজন ছিল। তাই রাম দেবী পার্বতীকে পুজোর আগে বেলগাছের তলায় তাঁর বোধন করেছিলেন। সময়টা অসময় ছিল, তাই এই পুজো ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত হয়।
একসময়ে এই বাংলায় বাসন্তীপূজার চল ছিল অনেক বেশি। তারপর ধীরে ধীরে ‘অকালবোধন’ তথা শরৎকালের দুর্গাপূজা সেই জায়গা দখল করে নেয়। এখন দুর্গাপুজো বললে লোকে শারদীয়া দুর্গাপূজাকেই ধরে নেয়।