কলকাতার পুজো
চোরবাগান চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপূজায় ভোগ রান্না করেন বাড়ির পুরুষ সদস্যরা

শুভদীপ রায় চৌধুরী
উত্তর কলকাতা মানেই বনেদি বাড়ির দুর্গাদালানে বহু বছরের ঐতিহ্যকে ফিরে পাওয়া। তিলোত্তমার এই মহোৎসব বহু প্রাচীন, তার মধ্যে অন্যতম হল মধ্য কলকাতার চোরবাগানের চট্টোপাধ্যায় পরিবার।
চোরবাগানের রামচন্দ্র ভবনের নির্মাতা রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বাড়ির ঠাকুরদালানে ১৮৬১ সালে শুরু করেন দেবী দুর্গার আরাধনা স্ত্রী দুর্গাদাসীর পরামর্শে। রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহু টাকা উপার্জন করে ১২০ নং মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে বাড়ি তৈরি করলেন। সেই বাড়িতেই পুজো শুরু করেন রাঢ়ী শ্রেণির ব্রাহ্মণ।

অন্যান্য বহু বাড়িতে রথের সময় কাঠামোপুজো হলেও, চট্টোপাধ্যায় পরিবারে কাঠামোপুজো অনুষ্ঠিত হয় জন্মাষ্টমী তিথিতে। কাঠামোপুজোর দিন একটি লাঠিকে (পরিবার সূত্রে জানা যায় এই লাঠির বয়স পুজোরই সমসাময়িক) পুজো করা হয়। তার পর সেই লাঠিটি দিয়ে আসা হয় কুমোরটুলিতে। সেখানেই নিমাই পালের স্টুডিওতে সপরিবার মৃন্ময়ী তৈরি হন।
অতীতে বাড়িতেই ঠাকুর তৈরি হত, রূপ দিতেন নিমাই পালের পূর্বসূরিরা। তবে বর্তমানে কুমোরটুলি থেকেই মা আসেন চট্টোপাধ্যায়দের বাড়িতে দেবীপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে। দুর্গাপুজোর পঞ্চমীর দিন দেবীকে বেনারসি শাড়ি ও বিভিন্ন প্রাচীন স্বর্ণালংকার পরানো হয়।
পরিবারের সদস্য অরিত্র চট্টোপাধ্যায় একটি বিশেষ রীতির কথা জানালেন। তিনি বলেন, “এই বাড়িতে ষষ্ঠীর দিন রাত্রিবেলা হয় বেলবরণ উৎসব। কথিত আছে, কৈলাস থেকে মা এসে বেলগাছের তলায় বিশ্রাম নেন। তাই ষষ্ঠীর দিন বাড়ির মহিলারা গভীর রাত্রে মায়ের চার দিকে প্রদক্ষিণ করে বরণ করেন ও দেবীকে স্বাগত জানান সে বছরের জন্য।”
সপ্তমীর দিন বাড়িতেই কলাবউ স্নান করানো হয়। আগে এই বাড়িতে ডাকের সাজের প্রতিমা হলেও পরে পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে চট্টোপাধ্যায় পরিবারে পুজো করে থাকেন শিশিরকুমার চট্টোপাধ্যায়।
অতীতে এই বাড়িতে বলিদান হত। সপ্তমী ও সন্ধিপূজায় একটি করে ও নবমীর দিন তিনটি পাঁঠাবলি দেওয়া হত। সেই প্রথা আজ বন্ধ, বর্তমানে প্রতীকী বলিদান হয় পুজোর সময়।

চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এই বাড়িতে ভোগ রান্না করেন বাড়ির পুরুষ সদস্যরা। খিচুড়ি, নানান রকমের ভাজা, শুক্তনি, চিংড়িমাছের মালাইকারি, ভেটকিমাছের ঘণ্ট, লাউচিংড়ি, চাটনি, পায়েস, পানতুয়া ইত্যাদি নানান রকমের ভোগ রান্না করে দেবীকে নিবেদন করা হয়।
এই বাড়িতে দুর্গাপুজোর দশমীর দিন হয় রান্নাপুজো, যাকে বলা হয় দুর্গা-অরন্ধন দিবস, অর্থাৎ আগের দিন সমস্ত রান্না করা হয়। দশমীর দিন ভোগ থাকে পান্তাভাত, ইলিশমাছের অম্বল, চাতলার চাটনি, কচুশাক ইত্যাদি।
আরও পড়ুন: দুর্গাপুজোর সূচনা: মতিলাল শীল বাড়ির কাঠামোপুজো হল উল্টোরথের দিন
দুর্গাপুজোর দশমীর দিন পরিবারের সদস্যরা মিলে মায়ের সামনে এক প্রার্থনাসংগীত পরিবেশন করেন। সকলে মিলে দেবীর কাছে অশ্রুজলে প্রার্থনা জানান ১৬ পঙক্তির স্তব গেয়ে। অতীতে এই চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে এক কীর্তনের দল ছিল, ‘রাধারমণ কীর্তন সমাজ’ নামে। দলটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের চিন্তামণি চট্টোপাধ্যায় ও মণীন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। এঁরাই মূলত গান করতেন। তাই সেই প্রাচীন কাল থেকেই ঠাকুরের বিসর্জনের আগে সবাই মিলে প্রচলিত সুরে গানটি করেন – ‘ভজিতে তোমারে শিখি নাই কভু / ডাকি শুধু তোমায় মা বলে।/ সাধনার রীতি জানি নাকো নীতি / পূজি শুধু তোমায় আঁখিজলে…”।
কলকাতার পুজো
দুর্গাপুজোর সূচনা: মতিলাল শীল বাড়ির কাঠামোপুজো হল উল্টোরথের দিন

শুভদীপ রায় চৌধুরী
কলকাতার বনেদিবাড়িতে এ বছরের উমা-বন্দনার জয়ধ্বনি শুরু হয়ে গেল বলা যেতেই পারে। গুটিকতক বনেদিবাড়ি ছাড়া বাকি সমস্ত বনেদিবাড়িতেই কাঠামোপুজো হয়ে গেল রথের দিন আবার কারও বা উলটোরথের দিন।
উত্তর কলকাতার বনেদিবাড়ির মধ্যে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে কলুটোলার শীলদের বাড়ি। এই বাড়ির দুর্গাপুজোর কাঠামোপুজো হয়ে গেল উলটোরথের দিন। এ বার তৈরি হবে শীলবাড়ির মৃন্ময়ী প্রতিমা।

পুজোর সময় ঠাকুরদালান ঝলমল করবে ঝাড়বাতির আলোয় আর শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হবে গোটা ঠাকুরদালান। শীলবাড়ির পুরোহিত ও প্রতিমাশিল্পী বংশপরম্পরায় আসেন তাঁদের বাড়িতে পুজোর সময়।
শীল পরিবারের দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন উত্তর কলকাতার স্বনামখ্যাত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মতিলাল শীল আনুমানিক ১৮৩০সালে। মতিলালবাবু ও তাঁর স্ত্রী আনন্দময়ী দাসী কলুটোলার বাড়িতেই শুরু করেন দেবী দুর্গার আরাধনা। মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদ তিথিতে ঘট স্থাপন করা হয়, সেখানেই পুজো চলে।
এই বাড়ির দুর্গাপুজোয় অন্নভোগ নিবেদনের প্রথা নেই তবে চালের নৈবেদ্য, ফল ও বাড়িতে তৈরি মিষ্টান্ন নিবেদন করা হয় দেবীর উদ্দেশে। দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন মতিলাল শীলের ঘাটে নবপত্রিকার স্নান হয় ও সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। মহাষ্টমীর দিন সন্ধিপূজার সময় বাড়ির মহিলারা ধুনো পোড়ানোয় অংশগ্রহণ করেন। মহানবমীর দিন রাতে ব্রাহ্মণ-বিদায় হয় ঘটা করে।

মতিলাল শীলের বাড়ির ঠাকুর ১৯৪৫ সাল অবধি কাঁধে করে বিসর্জন হত, কিন্তু ১৯৪৬ সাল থেকে সেই প্রথা বন্ধ আছে। ২০০০ সাল অবধি দশমীর দিন নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হত কিন্তু সেই প্রথাও আজ বন্ধ। তবে ঐতিহ্য ও আভিজাত্যে আজও অটুট মতিলাল শীল পরিবারের দুর্গাপুজো।
ছবি: রাজীব বসু
কলকাতার পুজো
কলকাতার বনেদি বাড়ির ব্যতিক্রমী দশভূজা
এই শহরের ভিতরেই আছে আরেকটা শহর। বহু ব্যবহারে এই বাক্যবন্ধটা ক্লিশে হয়ে গেলেও এর তাৎপর্য মোটেই কমেনি। প্রতিবার দুর্গাপুজো এলে সেটা দিব্যি অনুভব করা যায়। ৩০০ বছরের থেকেও প্রাচীন এই মহানগরের অলিগলিতে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস। সারি সারি পুরোনো দেওয়াল ভেঙে পড়া খিলান, নোনা ধরা ইঁটে সে সব ইতিহাস লেখা আছে। কলকাতার পুজোয় যখন থিম নিয়ে […]
এই শহরের ভিতরেই আছে আরেকটা শহর। বহু ব্যবহারে এই বাক্যবন্ধটা ক্লিশে হয়ে গেলেও এর তাৎপর্য মোটেই কমেনি। প্রতিবার দুর্গাপুজো এলে সেটা দিব্যি অনুভব করা যায়।
৩০০ বছরের থেকেও প্রাচীন এই মহানগরের অলিগলিতে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস। সারি সারি পুরোনো দেওয়াল ভেঙে পড়া খিলান, নোনা ধরা ইঁটে সে সব ইতিহাস লেখা আছে। কলকাতার পুজোয় যখন থিম নিয়ে মাতামাতি তখন কিছুটা আড়ালেই থেকে যায় ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনেদি বাড়িগুলো। কলকাতার এই সব ঠাকুরদালানে চলুন ঘুরে আসি, যেখানে অধিষ্ঠাত্রী ব্যতিক্রমী দশভূজা।
প্রথমেই যাব এমন এক বাড়িতে যেখানে দুর্গা আদতে দশভুজা হলেও তিনি দ্বিভুজা রূপে দৃশ্যমান। নেতাজি ভবন মেট্রো স্টেশনে নেমে যদুবাবুর বাজারের পাশ দিয়ে সোজা হেঁটে যান মিনিট পাঁচ-ছয়েক। পদ্মপুকুর রোড ধরে সোজা গেলে একটা তেমাথা পাবেন। তার ঠিক বাঁ হাতে একটা বাড়ি আপনার নজর কাড়বে। মস্ত বড় কাঠের দরজা ষষ্ঠী থেকে চারদিন অবারিত থাকে সকলের জন্য। ১২৫ বছরে পড়ল ভবানীপুরের এই মিত্রবাড়ির দুর্গোৎসব। কলকাতা শহরে এমন ব্যতিক্রমী প্রতিমা খুঁজে পাবেন না। আগেই বলেছি, দেবীর দুটি হাত দৃশ্যমান। বাকি আটটা হাত রয়েছে, কিন্তু দেখা যায় না। এই ছোট আটটি হাত রয়েছে কাঁধের উপরে। দেবীর চুলের আড়ালেই সেটা ঢাকা পড়ে যায়। তাই মিত্রবাড়ির সোঁদা গন্ধ মাখা দালানে এসে দাঁড়ালে এই প্রতিমা আপনাকে চমকে দেবে। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন লক্ষ্মী ও সরস্বতীর কোনও বাহন নেই। উমার দুই কন্যাই পদ্মাসনা। সিংহের মুখ ঘোড়ার মতো। এমন ঘোটকমুখী সিংহ বাংলার অনেক বাড়িতেই দেখা যায়। মনে করা হয়, ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক এই ঘোড়া। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতীককেই দেবীর বাহন করা হয়েছে।
কলকাতার বনেদি বাড়ির প্রতিমার বিশিষ্টতা গণেশ ও কার্তিকের স্থান পরিবর্তনে। এর নমুনা আপনি পেতে পারেন কুমোরটুলি স্ট্রিটের কবিরাজ বাড়িতে। ঋদ্ধি-সিদ্ধি-বুদ্ধির দেবতা গণেশ সাধারণত মায়ের ডানদিকে লক্ষ্মীর সঙ্গে থাকেন। বাঁদিকে থাকেন শৌর্য–বীর্যের দেবতা কার্তিক, সঙ্গে সরস্বতী। গঙ্গাপ্রসাদ সেনের বাড়িতে এর উল্টোটাই দেখতে পাবেন। বিধান সরণির লাহাবাড়ি, বউবাজারের দত্তবাড়িতে মহিষাসুরমর্দিনী নেই। এখানে দেবীর হরগৌরী মূর্তি। অর্থাৎ শিবের সঙ্গে পার্বতী। বিডন স্ট্রিটে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়িতে উমা নিয়ে আসেন জয়া-বিজয়াকে।
দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটে মল্লিক পরিবারে জয়া-বিজয়া আছেন। কিন্তু এখানে নেই লক্ষ্মী সরস্বতী। দেবীর গাত্রবর্ণে বৈচিত্র্য পাবেন সাউদার্ন অ্যাভিনিউয়ের রায় পরিবারে। দশভুজা শাস্ত্রমতে অতসী পুষ্পবর্ণা। অতসীর রঙ হলুদ হয়, নীলও হয়। রায় পরিবারের ব্যতিক্রমী দুর্গা নীল বর্ণের।
এই শহরেই আছে সোনার দুর্গা। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে হালদারদের নাটমণ্ডপ। দেবীর অভয়ামূর্তি একাধিক জায়গায় দেখা যায়। বৈঠকখানা রোডের নীলমণি সেনের বাড়িতে যেমন। দ্বিভুজা দেবী রয়েছেন বরদানের মুদ্রায়। ভবানীপুরের মিত্রবাড়ির মতোই অসুরদলনী নন। অভয়ামূর্তির দেখা পাবেন ঝামাপুকুরের চন্দ্রবাড়িতেও।
ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যে কলকাতার সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রতিমা কোনটি? এই প্রশ্নটা উঠলে আমার ভোট পাবে ভবানীপুরের দে বাড়ি। ফুলমালার ডোরে দেবী বাঁধা পড়ার আগে যদি তাঁর পায়ের নীচে অসুরটিকে দেখেন, আপনার তাক লেগে যাবে! এ তো অসুরের মতো দেখতে নয়, অথচ বুকে বিদ্ধ দেবীর ত্রিশূল। মহিষাসুরের পরনে কালো লম্বা ঝোলা কোট, তাতে পকেটও রয়েছে। সঙ্গে কালো বুট। একঝলক দেখলেই বোঝা যায়, এ অসুর নয়, মানুষের প্রতিকৃতি। আরও স্পষ্ট করে বললে এক ব্রিটিশের মূর্তি। ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী আর্য-অনার্যদের মতো কালো চুল নয় তার। অসুরের সোনালি চুল দেখে মনে পড়বে রবার্ট ক্লাইভকে। দে পরিবারের উত্তরসূরিদের এমন মূর্তির ইতিহাস জানা নেই। তবে দেখেই বোঝা যায়, ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনও কারণে বিরোধ তৈরি হয়েছিল সুতোর ব্যবসায়ী দে পরিবারের। তাই এই অসাধারণ মূর্তির ভাবনা। এই প্রতিমা শাসকের বিরোধিতায় স্বাধীনতা স্পৃহার এক অনন্য উদাহরণ।
ছবি: লেখক
-
রাজ্য2 days ago
পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করল তৃণমূল
-
গাড়ি ও বাইক3 days ago
আরটিও অফিসে আর যেতে হবে না! চালু হল আধার ভিত্তিক যোগাযোগহীন পরিষেবা
-
রাজ্য2 days ago
বিধান পরিষদ গঠন করে প্রবীণদের স্থান দেওয়া হবে, প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে বললেন মমতা
-
রাজ্য1 day ago
কেন তড়িঘড়ি প্রার্থী তালিকা প্রকাশ তৃণমূলের, সরব পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সহ-পর্যবেক্ষক অমিত মালব্য