দুর্গা পার্বণ
মল্লিকবাড়ির ঠাকুরদালানে মা সিংহবাহিনীকে দর্শন করেই শ্রীরামকৃষ্ণ হয়েছিলেন সমাধিস্থ

শুভদীপ রায় চৌধুরী
‘সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্।/চতুর্ভুজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।/ শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্।/ চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে।।/ রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্।/ নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।।
অর্থাৎ দেবী জগদ্ধাত্রী সিংহেস্কন্ধে আরূঢ়া, নানা অলংকারে সেজে আছেন ও নাগরূপে যজ্ঞোপবীতধারিণী। দেবীর বাম দিকে রয়েছে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু এবং ডান দিকে রয়েছে চক্র এবং পঞ্চবাণ। দেবী রক্তবস্ত্র ধারণ করেছেন এবং মুখমণ্ডল প্রভাতসূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণা। নারদাদিমুণিগণ তাঁর নিত্যসেবা করে থাকেন – এ রকম বর্ণনাই করা রয়েছে দেবী জগদ্ধাত্রীর ধ্যানমন্ত্রে।
মূলত ‘জগদ্ধাত্রী’ এই শব্দটির প্রাথমিক অর্থ হল যিনি জগতকে ধারণ করে আছেন বা বলা যেতে পারে যিনি জগতের পালিকা মহাশক্তি, তিনিই জগদ্ধাত্রী। যিনি নিত্যা, শাশ্বতী এবং যিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়, এই তিন গুণের প্রকাশ। দেবী রক্তবর্ণের ও তাঁর পরিধানে রক্তবস্ত্র। তদুপরি দেবীর সিংহাসনস্থ রক্তকমলে রজোগুণের প্রভাব দেখা যায় এবং তিনি স্বয়ং রজোদীপ্ত বলেই মহাশক্তিময়ী। আবার অপর দিকে তিনি করীন্দ্রাসুর নামক এক অসুরকে বধ করেছিলেন। সে জন্য অনেকে দেবীকে করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী নামেও ডেকে থাকেন।
ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কথায়, যিনি মনকরীকে বশ করতে পারেন তাঁর হৃদয়েই জগদ্ধাত্রীর উদয় হয়। সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতিকে জব্দ করে রেখেছে। মানুষের দুর্বল মন মত্ত হস্তীর সঙ্গে তুলনীয়। আর সেই কারণেই হাতি মহিষাসুরেরই গজরূপ। সেই চঞ্চল, দুরন্ত মনকে বশ করাই দেবী জগদ্ধাত্রীর উদ্দেশ্য।
প্রচলিত ঐতিহাসিক কাহিনি অনুযায়ী বঙ্গে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রথম শুরু করেছিলেন দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা। আজও সেই কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে ধুমধাম করে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। এ ছাড়াও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোও বিখ্যাত তবে আজ এমন এক প্রাচীন জগদ্ধাত্রী আলোচ্য বিষয়, যিনি অধিক পরিচিত ‘সিংহবাহিনী’ নামেই। তিনি মল্লিক বংশের মা সিংহবাহিনী।
শক্তিধারার এক বিশেষ রূপ হলেন দেবী দুর্গা। তিনি জগদ্ধাত্রী হিসাবেও পরিচিত আপামর ভক্তসাধারণের কাছে। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন সিংহবাহিনীর উল্লেখ পাই। এ ছাড়া দেবী সিংহবাহিনীর উল্লেখ পাই বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে দেবী সিংহবাহিনী ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজা হর্ষবর্ধনের বড়ো ভাই রাজ্যবর্ধনের কুলদেবী। মা সিংহবাহিনীর সেই উজ্জ্বলতা এবং বিগ্রহের সাজসজ্জা প্রমাণ করে যে বিগ্রহটি বহু বছরের রাজপরিবারের ঐতিহ্য।
আরও পড়ুন: সপ্তমীতে থানকাপড়ে সিঁদুর দিয়ে কলাবউকে সাজানো হয় খড়দহের নিত্যানন্দপ্রভুর প্রতিষ্ঠিত দুর্গাপুজোয়
দেবী সিংহবাহিনীর উচ্চতা প্রায় দেড় ফুটের কাছাকাছি এবং এটি অষ্টধাতুর প্রাচীন বিগ্রহ এবং যে বিগ্রহে সোনার পরিমাণ সব চেয়ে বেশি। সিংহবাহিনীর পিছনের চালচিত্রটি রুপোর। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে পতন হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের। সেই সময় আর্যাবর্ত জুড়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন বিভিন্ন প্রাদেশিক শাসক। এর পর দেবী সিংহবাহিনী চলে যান জয়পুরের রাজা মানসিংহের কাছে, তিনিই তাঁকে কুলদেবী হিসাবে পুজো করতেন। কিন্তু মুঘল আক্রমণে সেই আশ্রয়ও নিরাপদ হল না, তাই বিধর্মীদের হাত থেকে দেবীকে রক্ষা করতে রাজপুরোহিত বিগ্রহ নিয়ে পালিয়ে গেলেন বহু দূরে। পূর্ব বঙ্গের চট্টগ্রামে দেবীকে লুকিয়ে রাখলেন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গুহায়।
সপ্তগ্রামের অন্তর্গত ত্রিবেণী নিবাসী সুবর্ণবণিক্ গৌতম গোত্রীয় বনমালী দে মল্লিক ১০১৪ বঙ্গাব্দে (১৬০৮ খ্রিস্টাব্দ) দেহত্যাগ করলে তাঁর পুত্র বৈদ্যনাথ দে মল্লিক ব্যবসায়িক কাজের জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন। তিনি স্বর্ণ ও রৌপ্যের ব্যবসা করতেন। কোন পূজারি ব্রাহ্মণের তত্ত্বাবধানে অম্বর অধিপতি রাজা মানসিংহের কুলদেবী সিংহবাহিনী মাতার ধাতুময় বিগ্রহ থাকে তা তিনি জানতে পারেন এবং দেবীর নানান অলৌকিক কাহিনিও শোনেন।
বৈদ্যনাথ দে মল্লিক মহাশয় একদিন ভোররাতে স্বপ্নাদেশে দেখলেন, সমুদ্রের ধারে এক পাহাড়ের গুহায় পড়ে আছেন মা সিংহবাহিনী। দেবীই তাঁকে স্বপ্নাদেশে পথনির্দেশও দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে রাজপুরোহিতকে দেবী স্বপ্নাদেশে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তিনি দে মল্লিক বংশে পুনরায় স্থাপিত হবেন এবং সে জন্য বৈদ্যবংশীয় সুবর্ণবণিক্ বৈদ্যনাথ মল্লিকের হাতে যেন তিনি বিনা দ্বিধায় মূর্তিটি তুলে দেন।
মল্লিক মহাশয়কে মা বলেন, “তোমার ভক্তিতে আমি সন্তুষ্ট, তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যথাবিধি পূজার্চনা করো।” সেই স্বপ্নাদেশ পেয়ে বৈদ্যনাথ মহাশয় পরদিন বিগ্রহ আনতে গেলে রাজপুরোহিত মূর্তিটি দিলেন না। দ্বিতীয় রাত্রে দেবী আবারও পুরোহিতকে স্বপ্নে বললেন, “এ নির্জনে আমার যথাযথ পূজা হচ্ছে না। আগামী কাল প্রভাতে বৈদ্যনাথ পুনরায় আসবে, সেই সময় তুমি আমাকে অবশ্যই তাঁর হাতে সমর্পণ করবে।” দেবীর কথামতো বৈদ্যনাথ দে মল্লিকের হাতে মা সিংহবাহিনীকে তুলে দিলেন রাজপুরোহিত। মল্লিক মহাশয় সানন্দে সেই বিগ্রহ নিয়ে সপ্তগ্রামে ফিরলেন এবং দেবীকে সাড়ম্বরে স্থাপন করলেন।
সে কালে বাংলার বণিকরা প্রভূত ধনশালী ছিলেন এবং বিদেশিরা তাঁদের প্রশংসাও করতেন। সপ্তগ্রাম সে কালের ব্যবসায়ীদের কেন্দ্র ছিল। কবিকঙ্কনের চণ্ডীতে তাদের কথা লিখিত রয়েছে। তাঁরা ঘরে বসে দেশবাসী ও বিদেশি বণিকদের সঙ্গে ব্যবসা করতেন। বণিকদের মধ্যে সত্যবাদিতা ও সততার কথা শুনে সম্রাট আওরঙ্গজেব একজন বণিককে তাঁর দরবারে এনে প্রভূত সম্পত্তি প্রদান করেন এবং তাঁর পরীক্ষায় সফল হওয়ায় তিনি সেই বণিককে দশ হাজার টাকা, হাতি-সহ বিশেষ সম্পত্তি পুরস্কার দিয়েছিলেন। ইনিই দে মল্লিক বংশের কৃষ্ণদাস মল্লিক। এই কৃষ্ণদাস মল্লিকই রাজারাম মল্লিকের পিতা এবং দর্পনারায়ণ ও সন্তোষ মল্লিকের পিতামহ। কৃষ্ণদাস মল্লিক ১০৮৬ বঙ্গাব্দে (১৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) দেহত্যাগ করেছিলেন।

জোব চার্নক রাজারাম মল্লিকের পরামর্শে সুতানুটিতে এসেছিলেন। ওই সময় মল্লিকরা কলকাতায় থাকতেন না বটে তবে ব্যবসার জন্য যাতায়াত করতেন এবং পরিশেষে কলকাতায় কুঠি স্থাপন করেন। রাজারাম মল্লিকের সঙ্গে ইংরেজদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে দে মল্লিকের বংশের উত্তরসূরিরা বর্গীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে কলকাতার বড়োবাজার অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। সেই সঙ্গে সিংহবাহিনীরও পদার্পণ ঘটে এই কলকাতায়। কলকাতায় বাজার প্রতিষ্ঠা করেন রাজারাম মল্লিকের কনিষ্ঠপুত্র সন্তোষ কুমার মল্লিক।
মল্লিক বংশের প্রথম সন্তান যিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি হলেন দর্পনারায়ণ মল্লিকের একমাত্র পুত্র নয়নচাঁদ মল্লিক। তাঁর জন্ম ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে। বলা বাহুল্য দেবীর আগমনে মল্লিক বংশের সদস্যরা ধনবান হয়ে ওঠেন। যদিও এই পরিবারের সদস্যরা বৈষ্ণব ছিলেন, তবুও তাঁরা সম্পূর্ণ শাক্তমতেই পুজো করেন দেবীর। এই ভাবে মানসিংহর কাছ থেকে অপহৃত হয়েও স্বমহিমায় আবার প্রতিষ্ঠিত হলেন মা সিংহবাহিনী।
গত প্রায় চারশো বছর ধরে মল্লিকবাড়ির বিভিন্ন শাখায় দেবী চক্রাকারে পূজা পেয়ে আসছেন সারা বছর। মূলত জগদ্ধাত্রীর রূপকল্পে তাঁর মূর্তি রচনা হলেও বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। যেমন মা সিংহবাহিনী সিংহপৃষ্ঠাসীনা নন, তিনি সিংহের পিঠে দণ্ডায়মানা। বাহন সিংহটি দেবীর ডান দিকে না থেকে রয়েছে বাম দিকে। সিংহের মুখটি অশ্বমুখী এবং সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড। শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব, হিন্দুধর্মের এই তিন ধারার অভূতপূর্ব মেলবন্ধন দেখা যায় বিগ্রহতেও। যেমন সিংহটি অশ্বমুখী, শৈব ধর্মের প্রতীক হিসাবে দেবীর সাথে সাথে দুই শিবলিঙ্গ (বাণেশ্বর ও বিশ্বেশ্বর) দেবীর সঙ্গে পূজা পেয়ে আসছেন। রাজ্যবর্ধনের সময় থেকেই দেবী সিংহবাহিনী মূলত সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক হিসাবেই পরিচিত। দেবীর সেবাধিকারী মল্লিক পরিবার বৈষ্ণব হলেও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় না দিয়ে দেবীকে উপাসনা করে আসছেন শাস্ত্রমতেই।
শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময়েও সিংহবাহিনীর বিশেষ সেবাপূজা হয়ে থাকে মল্লিক বংশে। দুর্গাপুজোর সূচনা ঘটে মহালয়ারও আগে কৃষ্ণানবমী তিথি থেকে। সেই দিন থেকেই চণ্ডীপাঠ শুরু হয় এবং নবমী অবধি এই চণ্ডীপাঠ চলে। তিন দিনের বিশেষ পূজা হয় সপ্তমী, মহাষ্টমী এবং মহানবমীতে। এই তিন দিন দেবী সিংহবাহিনীর দুর্গা রূপে বিশেষ পূজা হয় এবং বিশেষ প্রাচীন রীতি মেনেই আজও পুজো হয় মায়ের। সঙ্গে মায়ের ভোগদান, আরতি, শ্লোকপাঠ ইত্যাদি উপাচার তো থাকেই এই কয় দিন।
এই পুজোর সময় বাড়ির পুরুষ সদস্যরা নতুন জোড় পরেন এবং বাড়ির মহিলারা প্রাচীন গহনায় সজ্জিত হন এবং মল্লিকবাড়ির ঠাকুরদালানে সাজোসাজো রব ওঠে। দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন মায়ের বোধন হয় সন্ধ্যায়। সপ্তমীর দিন সকালে নবপত্রিকা স্নান হয় গঙ্গার ঘাটে গিয়ে। মহাষ্টমীর দিন মায়ের বিশেষ পূজা হয় আর সন্ধিপূজায় ১০৮টি দীপদান হয়। সন্ধিপূজা শুরুর আগে বাড়ির মহিলারা ধুনো পোড়ানোয় যোগ দেন। কুমারীপুজোর রীতিও রয়েছে মল্লিকবংশে মহানবমীর দিন। মহালয়া থেকেই বাড়ির সদস্যরা সম্পূর্ণ নিরামিষ আহার করেন।
এই মল্লিকবংশের যদুলাল মল্লিকের ঠাকুরদালানে মা সিংহবাহিনীকে দর্শন করে সমাধিস্থ হয়েছিলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ। দিনটা ছিল ১৮৮৩ সালের ২১ জুলাই, আষাঢ় কৃষ্ণা প্রতিপদ। সেই দিনটির বর্ণনা করে শ্রীম ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’-এ লিখেছেন, “যে-ঘরে সিংহবাহিনীর নিত্যসেবা হইতেছে ঠাকুর সেই ঘরে ভক্তসঙ্গে উপস্থিত হইলেন। মা সচন্দন পুষ্প ও পুষ্প-মালা দ্বারা অর্চিত হইয়া অপূর্ব শ্রী ধারণ করিয়াছেন। সম্মুখে পুরোহিত উপবিষ্ট। প্রতিমার সম্মুখে ঘরে আলো জ্বলিতেছে।…ঠাকুর সিংহবাহিনীর সম্মুখে হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। পশ্চাতে ভক্তগণ হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। ঠাকুর অনেকক্ষণ ধরিয়া দর্শন করিতেছেন। কি আশ্চর্য, দর্শন করিতে করিতে একেবারে সমাধিস্থ। প্রস্তরমূর্তির ন্যায় নিস্তব্ধভাবে দণ্ডায়মান। নয়ন পলকশুন্য!”
দঃ ২৪ পরগনা
মা ও শিশুসন্তানদের জন্য কাপড় ও খাবার নিয়ে হাওড়ার বালিতে ‘সহমর্মী’
মৃন্ময়ী ‘মা’ যখন মণ্ডপে ২৫ লক্ষ টাকার গয়নায় সুসজ্জিত, তখন তাঁর সন্তানেরা দু’ মুঠো অন্নের আশায় ঝাড়খণ্ড থেকে এসে বালির ইটভাটায় লড়াই করে চলেছে।

সুব্রত গোস্বামী
রাস্তায় একটা ব্যানারে হঠাৎ চোখ পড়ল। তাতে লেখা – ‘প্রতিমাতেই শুধু মা দুর্গা নন, প্রতি-মাতেই মা দুর্গা’। এই অনুভবেই বিশ্বাসী গড়িয়া সহমর্মী সোসাইটি (Garia Sahamarmi Society)।
পুজো উপলক্ষ্যে মায়েদের হাতে নতুন কাপড় তুলে দেওয়ার জন্য সহমর্মী হাজির হয়ে গিয়েছিল বালির কিছু ইটভাটা-সহ কাছাকাছি কয়েকটি অঞ্চলে। মৃন্ময়ী ‘মা’ যখন মণ্ডপে ২৫ লক্ষ টাকার গয়নায় সুসজ্জিত, তখন তাঁর সন্তানেরা দু’ মুঠো অন্নের আশায় ঝাড়খণ্ড থেকে এসে বালির ইটভাটায় লড়াই করে চলেছে।

ইটভাটায় গিয়ে যা দেখা গেল, তা কোনো ভাবেই ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ৬ ফুট বাই ৮ ফুট একটা ছোট্ট ঘরে কোনো রকমে এঁরা বাস করছেন। করোনাকালে শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে চলার কথা বলা হচ্ছে। শারীরিক দূরত্ববিধি মানা এঁদের কাছে বিলাসিতা।
সেই ছোট্ট ঘরে একটাও জানলা নেই। মেঝেতে পড়ে আছে ছোট্ট শিশুর দল। দেখলে মনে হয়, আফ্রিকার কোন দেশ থেকে এসেছে। এই আমাদের আধুনিক ভারত! চাঁদের মাটিতে আমরা যখন চন্দ্রযান পাঠাতে ব্যস্ত, তখন আমারই দেশের মানুষের এই চরম দুর্ভোগ।
বালির বিআইভিএ (BIVA), তার পর বিবিএ (BBA), বিএনএস (BNS) ও বিবিএ২ (BBA2) ইটভাটা এবং বিদ্যাসাগর কলোনিতে পৌঁছে গিয়েছিল ‘সহমর্মী’। ‘সহমর্মী’ পৌঁছে গিয়েছিল বেলানগরের ভগবানের ভাণ্ডারে।
বালির ওই সব জায়গায় ইটভাটায় ৫০ জন মহিলার হাতে শাড়ি ও খাবার এবং ১০০ জন শিশুর মুখে খাবার তুলে দেওয়া হল ‘সহমর্মী’র পক্ষ থেকে।

শুধুই বালির ইটভাটাই নয়, ‘সহমর্মী’-র আয়োজনে মহাষ্টমীর দিন গড়িয়া গড়াগাছায় ১৪০ জন শিশুর হাতে দুপুরের খাবার তুলে দেওয়া হল। এখানকার ছোট্ট দুগ্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশদের হাতে পুজোর নৈবেদ্য তুলে দিতে পেরে ‘সহমর্মী’ ধন্য ও ঋদ্ধ হল।
খবরঅনলাইনে আরও পড়ুন
পিতৃমাতৃহীন শিশুদের নিয়ে পুজোর দিনে ‘দুর্গা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’-এর অভিনব উদ্যোগ
কলকাতা
পিতৃমাতৃহীন শিশুদের নিয়ে পুজোর দিনে ‘দুর্গা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’-এর অভিনব উদ্যোগ

খবরঅনলাইন ডেস্ক: উৎসব মানেই আনন্দ, আর সেই আনন্দ আরও জোরদার হয়ে ওঠে যখন সঙ্গে থাকে প্রিয়জনেরা! সেই প্রিয়জনদের খোঁজার প্রচেষ্টাতেই ‘দুর্গা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ (Durga and Friends) একত্রিত করেছে ছোটো ছোটো কিছু পিতৃমাতৃহীন শিশুকে, যারা এক সঙ্গে বড়ো হয়ে উঠছে এই হাউসে।
আর এই ‘দুর্গা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’-কে সঙ্গ দিয়েছেন কিছু বন্ধু যাঁরা এই ছোট্ট বন্ধুদের তাঁদের মা-বাবার অভাব কোনো দিন বুঝতে দেননি।

এই মহৎ প্রচেষ্টার সঙ্গে যিনি নিজেকে প্রথম যুক্ত করেছেন তিনি শ্যামসুন্দর জুয়েলার্স-এর পরিচালক মাননীয় রূপক সাহা। এবং তাঁর সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন সত্যেন্দ্রনাথ মিশ্রা, সুরজিৎ কালা সোহো প্রমুখ।
প্রতি বছর এই খুদে বন্ধুদের সঙ্গে দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট দিন সকলে উপভোগ করেন অঞ্জলি দিয়ে, প্যান্ডেল ঘুরে এবং এক সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন করে।
কিন্তু এই বছরটা একটু আলাদা! করোনার কবল থেকে বাঁচাতে এই বার এগিয়ে এল লোহারুকা গ্রিন ওয়েসিস-এর (Loharuka Green Oasis) আবাসিকবৃন্দ। এই বছর ‘দুর্গা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’-এর ছোট্ট বন্ধুরা আমন্ত্রিত হলেন লোহারুকা গ্রিন ওয়েসিস-এর আবাসিকদের সঙ্গে একটি দিন উপভোগ করার জন্য!

আবাসিক প্রাঙ্গণের দুর্গাপূজায় যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়ে খুব খুশি ছোট্ট শিশুরা। তারা আবাসিক প্রাঙ্গণের অন্য শিশুদের সঙ্গে দিনটা কাটাল অঞ্জলি, খেলাধুলা ও খাওয়াদাওয়ার মাধ্যমে।
আবাসিকদের তরফ থেকে সভাপতি দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী জানালেন, পরবর্তী সময়েও লোহারুকা গ্রিন ওয়েসিস ‘দুর্গা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’-এর পাশে থাকবে।
শারদোৎসব মানেই যে মেলবন্ধন, সেই সত্যি আরও প্রমাণ করে দিলেন লোহারুকা গ্রিন ওয়েসিস-এর আবাসিকরা এবং ‘দুর্গা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’।
খবরঅনলাইনে আরও পড়ুন
দুর্গাপুজোয় সচেতনতার পরীক্ষায় উতরে গেল কলকাতা
কলকাতা
দুর্গাপুজোয় সচেতনতার পরীক্ষায় উতরে গেল কলকাতা
পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে, কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনেই, ঘরবন্দি থেকে বা নিদেনপক্ষে পাড়াবন্দি থেকে, এ বার দুর্গাপূজা উদযাপন করল কলকাতা

বিশেষ প্রতিনিধি: ভালো ভাবেই পাশ করে গেল কলকাতা (Kolkata) । আশঙ্কা ছিল, বাঙালির সব চেয়ে প্রিয় উৎসব দুর্গাপুজোর টানে কোভিড সংক্রান্ত সব বিধিনিষেধ উড়িয়ে দিয়ে বেসামাল হয়ে যাবে মহানগর। ফলত আরও বাড়বে করোনা সংক্রমণ।
দুর্গাপুজোর এই পাঁচ-ছ’ দিনে করোনা সংক্রমণ বাড়ল কি না, তা বোঝা যাবে দিন কয়েক পর। তবে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে, কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনেই, ঘরবন্দি থেকে বা নিদেনপক্ষে পাড়াবন্দি থেকে, এ বার দুর্গাপূজা (Durgapuja 2020) উদযাপন করল কলকাতা।

মহানবমীর বিকেলে আরও এক দফা নগর পরিক্রমায় বেরোনো হল। গন্তব্য ছিল উত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল সেরে দক্ষিণের প্রান্তিক এলাকা।
কলকাতার অন্যতম প্রাচীন সর্বজনীন পুজো সিমলা ব্যায়াম সমিতি বিবেকানন্দ রোডে। এই পুজো ছাড়াও এই রাস্তায় রয়েছে বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব, চালতাবাগান সর্বজনীনের মতো বেশ প্রাচীন বিখ্যাত সর্বজনীন পুজো।

মহানবমীর বিকেলে বিবেকানন্দ রোড আর পাঁচটা সাধারণ দিনের থেকেও শুনশান। সব মণ্ডপেই ঝুলছে প্রবেশ নিষেধ বোর্ড। হাতে গোনা কয়েক জন দর্শনার্থী মণ্ডপের বাইরে থেকেই প্রতিমা দর্শন করে চলে যাচ্ছেন। কোনো কোনো প্রতিমার দর্শন হচ্ছে গাড়িতে বসেই। যে হেতু রাস্তায় তেমন ট্রাফিক নেই, তাই পুলিশের বাধাও নেই।
মানিকতলা মোড় পেরিয়ে বাঁ হাতি রাস্তা রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট। একটু যেতেই ডান দিকে পড়ল লালাবাগান সর্বজনীন। গাড়িতে বসেই এমন সুন্দর প্রতিমা দর্শন হবে ভাবাই যায়নি। ওই ব্যস্ত রাস্তায় স্বচ্ছন্দে গাড়ি দাঁড় করানো হল, প্রতিমা দর্শন হল, ছবি তোলা হল অবাধে। ভাবা যায়?

একটু এগিয়ে লালাবাগান নবাঙ্কুর-এর পুজো, একটু ভিতরে। গাড়ির জন্য রাস্তা বন্ধ। গুটি গুটি পায়ে চলেছেন নামমাত্র দু’-চার জন দর্শনার্থী।
রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে ডান দিকের পথ ধরা হল উলটোডাঙা মোড়ের উদ্দেশে। বাঁ দিকে পড়ে থাকল গৌরীবেড়িয়া সর্বজনীন। অরবিন্দ সেতু পেরিয়ে উলটোডাঙা মোড়গামী এই রাস্তা পুজোয় অগম্য হয়ে যায়। গাড়ি তো দূরের কথা, পায়ে হাঁটাও দায় হয়ে ওঠে।
এই রাস্তার আশেপাশের গলিতে বহু বিখ্যাত পুজো আয়োজিত হয় – কবিরাজ বাগান সর্বজনীন, করবাগান সর্বজনীন, উলটোডাঙা পল্লিশ্রী, তেলেঙ্গাবাগান, শুঁড়ির বাগান সর্বজনীন ইত্যাদি। এই পথ ধরে এই মহানবমীর বিকেলে একেবারে অবাধ যাত্রা। পথে নতুন পোশাক পরে কিছু মানুষ চলেছেন প্রতিমা দর্শনের উদ্দেশ্যে।

অন্যান্য বার এই বারোয়ারি পুজোগুলো দেখার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যায় উলটোডাঙা মোড়গামী মূল সড়ক থেকেই। এক একটা পুজো দেখা সাঙ্গ করতে সময় লেগে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর এ বার মণ্ডপের পথে ক’ জন হেঁটে চলেছেন, তা বোধহয় গুনে ফেলা সম্ভব।
উত্তরের পুজো কেমন হচ্ছে তার একটা আন্দাজ পাওয়া গেল। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে ফেরার পথে মনে হল একবার রাসবিহারী কানেক্টরে বোসপুকুর শীতলামন্দিরের পুজো দেখে আসা যাক। উনিশ বছর আগে মাটির ভাঁড়ের পুজো করে বিখ্যাত হয়েছিল বোসপুকুর। সেই খ্যাতি তারা আজও ধরে রেখেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে এই প্রতিমা দর্শন করতে হয়।

সেই বোসপুকুর শীতলামন্দির অবাক করল। রাসবিহারী কানেক্টরের একেবারে মণ্ডপের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রতিমাদর্শন হল, ছবিও তোলা হল, পুলিশের নজরদারিতেই।
মহাসপ্তমী ও মহানবমীতে মহানগর পরিক্রমা করে বোঝা গেল হাতে গোনা কয়েকটি বিখ্যাত পুজো ছাড়া সর্বজনীন পুজোগুলো এ বার মোটামুটি ফাঁকাই থেকেছে। কলকাতাবাসী এ বার মোটামুটি ভাবে নিজের পাড়ার পুজোটিই দেখেছেন। পাড়ার চৌকাঠ পেরিয়ে দূরে পাড়ি জমাননি। আর যতটুকু অফিস-কাছারি চলছে, পুজোয় তা-ও বন্ধ। তাই এই আনলক পিরিয়ডেও বাস যে ভিড় দেখা যায়, দুর্গাপুজোর এ ক’ দিন তা-ও দেখা গেল না। সারা দিনই বাস একেবারেই ফাঁকা, তাই বেশি রাত পর্যন্ত বাসও চলেনি।
আনলক পিরিয়ডে নানা রকম বাধানিষেধের মধ্যে চলা মেট্রো রেল যত যাত্রী পরিবহণ করেছে, পুজোর দিনগুলোতে তার অর্ধেকও করেনি। মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের হিসেবে, সপ্তমীর দিন তাঁদের পরিষেবা ব্যবহার করেছেন ৩৪ হাজার যাত্রী। অথচ পঞ্চমীর দিন মেট্রোয় যাত্রীসংখ্যা ছিল ৮৪,৮০১ জন। মোটামুটি একই ছবি দেখা গিয়েছে, মহাষ্টমী ও মহানবমীতেও।

মেট্রো আধিকারিকরা জানিয়েছেন, ট্রেনে বা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কোনো ভিড়ই ছিল না। তা ছাড়া অন্যান্য বারের মতো এ বারে বেশি রাত পর্যন্ত মেট্রো চালানোও হয়নি।
কলকাতার পুজো দর্শনার্থীদের একটা বড়ো অংশ আসেন কলকাতার আশেপাশের জেলা থেকে। এ বার লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় তাঁদেরও বেশির ভাগ মহানগরে আসেননি। পুজোর দিনগুলোতে শহর শুনশান থাকার এটা একটা বড়ো কারণ।
বনেদিবাড়ির পুজোও কলকাতার পুজোর একটা বড়ো আকর্ষণ। কিন্তু শহরের বেশির ভাগ বনেদিবাড়ির পুজোতেও এ বার সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। নিজের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বনেদিবাড়ির পুজো।
দশমীও ম্রিয়মাণ বেশির ভাগ মণ্ডপে। নেই সিঁদুরখেলা, নেই বিসর্জনের শোভাযাত্রাও। সোমবার সকাল থেকেই বিসর্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোথাও তো মণ্ডপচত্বরেই প্রতিমাকে গলিয়ে ফেলা হচ্ছে পাইপের জলের তোড়ে। কোনো কোনো বারোয়ারি কমিটি তো মণ্ডপের সামনেই জলের ব্যবস্থা করে সেখানে প্রতিমা বিসর্জন করছে।
ছবি: শ্রয়ণ সেন
খবরঅনলাইনে আরও পড়ুন
নেই সিঁদুরখেলা, শোভাযাত্রা, কোভিডের আবহে রাজ্যে মনখারাপের দশমী
-
দেশ1 day ago
পশ্চিমবঙ্গে ৮ দফায় ভোট, কলকাতায় ভোট ২৬ ও ২৯ এপ্রিল
-
কলকাতা3 days ago
শুধু দড়ি বেঁধে ম্যানহোলের কাজ করতে নেমে কুঁদঘাটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, মৃত ৪ শ্রমিক
-
প্রযুক্তি3 days ago
সোশ্যাল, ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে কড়া পদক্ষেপ কেন্দ্রের
-
প্রযুক্তি2 days ago
আরবিআই-এর নতুন নির্দেশিকা, ঝক্কি বাড়বে ডেবিট, ক্রেডিট কার্ড লেনদেনে!