হিরে ভালোবাসে না এমন মানুষ বিরল। রাজারাজরা, মোগলবাদশাদের কাছে হিরে ছিল ক্ষমতাপ্রদর্শন ও রাজৈশ্বর্যের প্রতীক। শারদোৎসবের জন্য দিন গুনছে আপামর বাঙালি। কলকাতার পুজোর ময়দান এখন সরগরম। আলোর বেণু বেজে ওঠা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। শেষ মুহূর্তে তুলির টান দিতে ব্যস্ত উত্তর কলকাতার বেলেঘাটা ৩৩ পল্লীর পুজোর আয়োজকরা। বেলেঘাটা ৩৩ পল্লির এবারের থিম হল ‘কোহিনূর – অতীতের দিকে যাত্রা’।
কোহিনূর-এর ইতিহাস শোনাচ্ছিলেন বেলেঘাটা ৩৩ পল্লির কর্মকর্তা পরিমল দে। কোহিনূর বা ‘কোহ-ই-নূর’ কথার অর্থ হল আলোর পর্বত। প্রদীপ আলো ছড়ালেও প্রদীপের নীচেই সবচেয়ে বেশি অন্ধকার জমাট বাঁধে। তেমনই কোহিনূরের অর্থ আলোর পর্বত হলেও অনেক অন্ধকার জমাট যে বেঁধেছে একে ঘিরে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রায় ৮০০ বছর ধরে এই কোহিনূর হিরেকে কেন্দ্র করে কত শত রক্তক্ষয়, কত গুপ্তহত্যা, কত যুদ্ধ, কত লুঠ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মানুষের লোভ লালসার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে ওই একটুকরো কোহিনূর হিরে। অভিশপ্ত হিরেও বলে অপবাদ দেওয়া হয়েছে। মনে করা হত, যে এই কোহিনূরকে অধিকার করতে পারবে সেই নাকি হবে সমগ্র জগতের অধীশ্বর। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে যুগের যুগের পর যুগ ধরে চলেছে বহু রক্তপাত। কোহিনূর বারবার পার করেছে দেশ, মহাদেশ, সাম্রাজ্য আর ধর্মের সীমানা। বারবার বদলে গেছে তার অধীশ্বরের নাম।
কথিত আছে, কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের এক হিন্দু দেবীর মন্দিরে দেবীমূর্তির ত্রিনয়ন থেকে এই হিরে প্রথমবার চুরি করেন আলাউদ্দিন খিলজি। এরপর বহু হাত ঘুরে কোহিনূর একসময় এসে পৌঁছোয় মোগল সম্রাট বাবরের হাতে। তার নাম হয় ‘বাবর কা হীরা’। এরপর বাবর-পুত্র হুমায়ুনের হাত ধরেই এই হিরে পারস্যে চলে যায়। বহু যুগ পরে তা ফিরে আসে ভারত উপমহাদেশের দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে ও তারপর প্রায় ১০০ বছর এই হিরের কোনো সন্ধান মেলেনি।
বেলেঘাটা ৩৩ পল্লিতে এবার কোহিনূরের ইতিহাস সন্ধান।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৭৪৮ সালে মীরজুমলা নামে একজনের বণিকের হাত ধরে এই হিরে ফিরে আসে মোগলসম্রাট শাহজাহানের কাছে যা পরে শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসনে স্থান করে নেয়। বহুকাল পরে নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন। এই হিরে ফের চুরি করে নিয়ে যান পারস্যে। নাদির শাহই এর নাম দেন ‘কোহ-ই-নূর’ বা আলোর পর্বত ।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পুজারীদের মতে এই কোহিনূর নাকি আসলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্যন্তক মণি। এরপর কাশ্মীরের পথ ধরে এই অভিশপ্ত হিরে এসে পৌঁছোয় পঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিং এর কাছে। পরে এই কোহিনূর হিরে লর্ড ডালহৌসি তঞ্চকতা করে পঞ্জাবের নাবালক রাজা দিলীপ সিং-এর কাছ থেকে অধিগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ জাহাজে চেপে কোহিনূর যাত্রা করে লন্ডনে ও সেখানে কোহিনুরকে কেটে বাড়িয়ে তোলা হয় তার ঔজ্জ্বল্য। কমে যায় তার আয়তন। মহারানি ভিক্টোরিয়া ও পরবর্তী সময় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মুকুটে স্থান পায় এই হিরে। কোহিনূর আজ লন্ডনে রয়েছে। এই হিরেকে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালু রয়েছে।
বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি দুর্গাপুজো প্রাঙ্গণে এবার ‘কোহিনুর’-এর ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে। যেসব ঐতিহাসিক চরিত্র ‘কোহিনুর’-এর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন, পুজোমণ্ডপে তাদের প্রতিকৃতি তুলে ধরে ৩৩ পল্লি ইতিহাসের গন্ধমাখা অতীতে যাত্রা করছে এবার।
কোথায় এই মণ্ডপ
ইএম বাইপাসে বেলেঘাটা মোড় থেকে বেলেঘাটা মেন রোড ধরে সিআইটি মোড়ে আসুন। এবার ডানদিকে সিআইটি রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই ফুলবাগান মোড়ের আগেই পড়বে বেলেঘাটা ৩৩ পল্লির পূজামণ্ডপ।
আরও পড়ুন
দুর্গোৎসব ২০২৪: ৭৫ বছরে ‘উমাকে পাড়ে’ নিয়ে আসার বার্তা দিচ্ছে ঢাকুরিয়া শহিদনগর সার্বজনীন
দুর্গোৎসব ২০২৪: ৮২ বছরে হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব কমিটির থিম ‘শুদ্ধি’, দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ডাক
দুর্গোৎসব ২০২৪: সাতমহলা জমিদারবাড়ির অন্তঃপুরের কাহিনি শোনাতে প্রস্তুত সিংহী পার্ক সর্বজনীন