
অধ্যাপক, ক্রিপ্টোলজি অ্যান্ড সিকিউরিটি রিসার্চ ইউনিট, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা; প্রাক্তন অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
ছোটোবেলায় ভাবতাম ইঞ্জিনিয়ার মানে বুঝি যে ইঞ্জিন চালায়। পরবর্তীকালে নিজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ও ছাত্রদের পড়িয়ে উপলব্ধি করেছি যে কথাটা কিয়দংশে সত্য। ইঞ্জিন তো শুধু রেলগাড়িরই হয় তা নয়, এরোপ্লেন বা রকেটেরও হয়,আবার কম্পিউটারেরও হয় (যেমন, প্রসেসর)। আর চালানো মানে শেষ পর্যন্ত যে নিজের হাতে চালাতে হবে তা নয়, কাউকে দিয়ে পরোক্ষভাবে চালানোও হতে পারে।
সায়েন্স মানে যদি বিজ্ঞানের তত্ত্বমূলক অগ্রগতি বোঝায়, ইঞ্জিনিয়ারিং মানে তবে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ। একরকম ব্যবহারিক প্রয়োগ করছেন সাধারণ ব্যবহারকারীরা। যেমন, ফিজিক্স-এর অংশ মেকানিক্স যদি একটি তত্ত্বমূলক বিজ্ঞানের বিষয় হয়, তাহলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে তার অন্যতম ব্যবহারিক প্রয়োগ। রেলগাড়ি সেই প্রয়োগের একটি উদাহরণ, এবং এর সাধারণ ব্যবহারকারী হচ্ছে রেলযাত্রীরা, যাদের আমরা কখনই ইঞ্জিনিয়ার বলবো না। দ্বিতীয় ধরনের ব্যবহারিক প্রয়োগ করছেন তাঁরা, যাঁরা অঙ্ক কষে হয়তো বের করছেন কীভাবে কম শক্তি প্রয়োগ করে রেলগাড়ির চাকাগুলোকে বেশি ঘোরানো যায় অথবা রেলের এক একটি কামরা কোন ক্ষেত্রে কত বড়ো বা কত ছোটো হওয়া উচিত, কতগুলো হওয়া উচিত এবং কামরাগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে কীভাবেই বা জোড়া উচিত ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁরা হলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাহিদারও বিচিত্র বিবর্তন হয়েছে। একসময়, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিষয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। কারণ? চাকরির বাজারে বিষয়টি ছিল এক নম্বরে, ফলে কলেজগুলোতেও তার সিট ভর্তি হত সবার আগে। পরবর্তীকালে, দেশজুড়ে যতো রাস্তা, ব্রিজ এসব তৈরি হতে থাকলো, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-ও তরতর করে এগিয়ে গেলো জনপ্রিয়তায়। ক্রমশঃ দেখা গেল, মেকানিক্যাল বা সিভিল – যে কোনো শিল্প বা প্রযুক্তিই হোক না কেন, বিদ্যুৎ ছাড়া কাজ চালানো মুশকিল। তাই প্রয়োজন হল কী করে কম সময়ে কম খরচে বেশি বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, উপযুক্ত ভাবে তা ধরে রাখা যায় এবং বন্টণ করা যায়। বাজারে দাম বাড়লো ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর। তারপর বিনোদন এবং যোগাযোগের দুনিয়ায় এলো বিপ্লব – একদিকে দূরদর্শন থেকে স্যাটেলাইট টিভি, বিবিধ ভারতী থেকে এফ এম, আর অন্যদিকে টেলিফোন থেকে মোবাইল-এ উত্তরণ। সবকিছুকে ছাপিয়ে গেলো ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং।
ধীরে ধীরে দেখা গেলো, যেকোনো ইঞ্জিনিয়ারিং-ই হোক না কেন, তার পরিসর এবং প্রয়োগ এতো বৃহত্তর ক্ষেত্রে ব্যাপ্ত, এতো জটিল-ভাবে বিন্যস্ত, যে কাগজে-কলমে আর অঙ্ক কষা যাচ্ছে না। প্রয়োজন হল যন্ত্রগণক তথা কম্পিউটার-এর। শুধু যন্ত্রপাতির অঙ্ক কষাতে নয়, সাধারণ পরিষেবা যেমন ব্যাঙ্কিং, টিকিট রিজার্ভেশন, অনলাইন তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ – এসবেও কম্পিউটার অপরিহার্য হয়ে উঠলো। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর রমরমা বাড়লো।
কম্পিউটার এবং ইলেক্ট্রনিক্স জনপ্রিয়তায় এখন উনিশ-বিশ, চাকরির বাজারেও সবার আগে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এরাই ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শেষ কথা। বরং আগের তুলনায় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এখন অনেক নতুন স্পেশালাইজেশন এসেছে, যেমন সিভিলের স্পেশালাইজেশন হিসেবে কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যালের স্পেশালাইজেশন হিসেবে পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রনিক্সের স্পেশালাইজেশন হিসেবে ইন্সট্রুমেন্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটারের স্পেশালাইজেশন হিসেবে আই টি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি। এমনকি অনেক অফ-বিট বিষয়েও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয় –যেমন, ওশেন ইঞ্জিনিয়ারিং, এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং, জেনেটিক ইঞ্জিয়ারিং, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং, ফুড টেকনোলজি এন্ড বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং ইত্যাদি ইত্যাদি।
চাহিদা এবং চাকরির বাজারে বিবর্তন এবং ওঠানামা থাকবেই। আগে যেমন দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তন আসতো, এখন দ্রুতগামী দুনিয়ায় পরিবর্তনের হারও বেশ দ্রুত। অনেক সময় তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদরাও এই পরিবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণী করতে অপারগ। তাই (বাড়ি ও পরিবার সামলানোর ইমার্জেন্সি দায়িত্ব না থাকলে) শুধুই চাকরির দিকে তাকিয়ে ইঞ্জিয়ারিং-এর বিষয় নির্বাচন বোধ হয় না করাই ভালো। উপরেই আলোচনা করেছি – এখন কত নানা রকমের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীর নিজের যাতে আগ্রহ বেশি, আত্মবিশ্বাস বেশি – আমার মতে সেটি নির্বাচন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এক একটি কলেজ আবার এক একটি বিষয়ে ভালো প্রশিক্ষণ দেয়, তাই কোন কলেজে কী পড়ার সুযোগ পাচ্ছি সেটাও বাজিয়ে নেওয়া দরকার।
পছন্দের কলেজে পছন্দের বিষয় না পেলেও কিন্তু মন খারাপ করার কিছুই নেই। অনেক কলেজেই প্রথম বছরের পর বিষয় পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে – এই নিয়মগুলি কলেজের প্রসপেক্টাস এবং কলেজ / বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে জেনে নেওয়া দরকার। তাছাড়া আধুনিক পড়াশুনো ও কাজকর্মের জগৎটা কিন্তু ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি। স্নাতকের একটি বিষয় থেকে স্নাতকোত্তরে অন্য বিষয়ে যাওয়ার সুযোগও এখন অনেক বেশি।
পরিশেষে একটি প্রাসঙ্গিক কথা বলি। উপরের সমগ্র আলোচনাটি কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইছো, সেটা ধরে নিয়ে। আমি তো বলবো – আদৌ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইছো কি না সেটাও নিজেকে যাচাই করে নেওয়া দরকার। আমি কিন্ত দেখেছি, অনেকেই পরবর্তী কালে অনুতাপ করে – ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে অন্যকিছু পড়লে ভালো হতো। এখন কিন্তু নন-ইঞ্জিনিয়ারিং সাধারণ স্নাতক স্তরেও অনেক নতুন নতুন বিষয় এসেছে, যেগুলোর চাকরির সুযোগ মন্দ নয়। তবে এই ব্যাপারে বাবা-মা / বাড়ির লোকজনেরও কিন্তু হৃদয়, মন ও বুদ্ধির জানলাগুলো একটু খোলামেলা রাখা দরকার।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।