ভর্তিকা পোদ্দার নাট্য নির্দেশক, সমাজকর্মী
এ বছর ৫ সেপ্টেম্বর আমি বিদূষক নাট্য মণ্ডলীর মিউজিক্যাল প্লে ‘লাজো’ প্রথম দেখি। তার আগের পাঁচ মাসে আমি মোটে একটাই লাইভ পারফরমেন্স দেখেছিলাম। পারফরমিং আর্টস-এর ক্ষেত্রে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ। পারফরমেন্স হবে কোথায়? দর্শকই বা কোথায়? ভার্চুয়াল জগৎ আমাদের পুরোপুরি হজম করে ফেলেছে।
আমি কিন্তু এই ভার্চুয়াল জগৎটাকে এখনও হজম করে উঠতে পারিনি। একটা ভালো লাইভ শো দেখব বলে ছটফট করছিলাম। ছটফট করছিলাম চোখের সামনে একটি গল্প পরতে পরতে খুলে যাওয়ার ম্যাজিক দেখব বলে – কোনো ফিল্টার ছাড়া। ‘লাজো’ আমায় ঠিক সেটাই দিয়েছে। চাঁছাছোলা বিনোদন। অজস্র গান, নাচ, নাটক, কৌতুক এবং ইসমত চুঘতাইয়ের গল্পের আমেজের সাথে খাপে খাপ মিলিয়ে পরিবেশনা।
ইসমত চুঘতাইয়ের গল্প ‘ঘরওয়ালি’, যার উপর ভিত্তি করে ‘লাজো’ রচিত, তা যেমন হাসির তেমনি এক সপাট থাপ্পড়। জীবন যেসব আগুনের আঁচে তাকে পুড়িয়েছে, সেই আগুনেই ছোটো জাতের বেজন্মা দাসী লাজো কষিয়ে রাঁধতে জানে হৃদয়ের টক-ঝাল-মিষ্টি। যার বাড়িতে ও কাজ পেল, সেই মির্জা শুদ্ধু যে সমস্ত পুরুষ মানুষ ওর উচ্ছল চরিত্রের ছোঁয়া পেয়েছে, প্রত্যেকেই ওর খোলামেলা মুক্ত মনের নেশায় মজেছে। মির্জা শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়ে করতে রাজি করিয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক কাজ করল কোথায়!
বিবাহ প্রতিষ্ঠানের দমনমূলক চরিত্রের মুখোশ খুলে-দেওয়া সামাজিক ব্যঙ্গনাট্য ‘লাজো’ এক দিকে পবিত্রতা বনাম পরকীয়ার ধারণাটিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়, আর অন্য দিকে সামাজিক রীতিসর্বস্বতার খিল্লি উড়িয়ে দেয়। এটি এমন একটি গল্প, যা দুর্ভাগ্যবশত চিরদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে। আর আজ যখন ধর্মীয় মৌলবাদের কোলে চড়ে পিতৃতন্ত্র এক ভয়ানক চেহারা নিচ্ছে, এ নাটক আরোই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

২০১৭ সালে ‘কালো মাছের গল্প’ দেখার পর থেকে আমি বিদূষকের কাজের ভক্ত। তাদের গল্প বলার বৈশিষ্ট্য হল অনেক গানবাজনা আর অল্প কিন্তু বিচিত্র রঙিন প্রপ ও পোশাক। সঙ্গে মাইম ও চলাফেরার সঠিক মাত্রা – শৈলী কখনোই বিষয়কে ছাপিয়ে যায় না। ‘লাজো’ও সেই ধরনটিই অনুসরণ করে। প্রাণবন্ত উদ্বোধনী নাচ-গান, কুলফি বিক্রেতার ট্রে, তোতাপাখি যে তার কর্তাকে ‘হারামি রামু’ বলে ডাকতে থাকে, মর্মান্তিক বিবাহের দৃশ্যটি –এই সমস্তকিছু আমাকে চল্লিশের দশকের উত্তর ভারতের ছোটো শহরের অলিগলিতে নিয়ে যায়। ১৩ থেকে ৫০ বছরের নানা প্রজন্মের কাস্ট থাকার ফলে সেই সময়টা যেন আরও ফুটে ওঠে।
দু’সপ্তাহ পরে আমি আবার ‘লাজো’ দেখি, এইবার একদল কিশোর বয়সি উর্দুভাষী মুসলিম মেয়ের সঙ্গে, যারা নিজেদের অভিনয়শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলছে। তাদের মধ্যে কেউ অল্পই বাংলা বোঝে, কেউ একটু বেশি। কিন্তু তাদের কারোরই ‘লাজো’ বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি। মহিলা হিসাবে, মুসলিম মহিলা হিসাবে, তারা অবিলম্বে মূল চরিত্রের আনন্দ ও সংগ্রাম, ক্যারিশমা ও বিভ্রান্তির সাথে একাত্ম হয়ে যাচ্ছিল। এ বার ওদের চোখ দিয়ে ‘লাজো’ দেখলাম। দেখলাম –
∙ লাজো চরিত্রটি – সাহসী, মুক্তমনা, বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ।
∙ ‘লাজো’র অভিনেত্রী – সাহসী, মুক্তমনা, বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ।
∙ হারমোনিয়াম এবং নাল বাজিয়ে তৈরি সহজ সরল অথচ মন টানা সুরতালের মূর্ছনা।
∙ মজার দৃশ্য, যখন বয়স্ক হারমোনিয়াম বাদক লাজোকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করেন, এবং সেখানে তাঁর ছাতার ব্যবহার।
∙ লাজোর তরুণ প্রেমের লাজুক উত্তেজনা, যখন মির্জা তাকে গজরা ও বিন্দি উপহার দেয় এবং যখনই সে ডাকে, ‘মির্জা সাহেব!’ (পরে দেখা গেল ওখানে গজরা নয়, কেবল একটি লাল ফিতা ছিল, তবে এমন একটি বিভ্রম তৈরি হয়েছিল) ।
∙ লম্বা-চুল মেয়েটির প্রাণবন্ত মুখের অভিব্যক্তি, বিশেষ করে যখন সে কোঠায় বসে চায়ে চুমুক দেয়।
∙ যখন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে কেউই তাদের নিজস্ব লালসার বাইরে তাকাতে পারেনি, একটি অল্পবয়স্ক ছেলে লাজোর সহমর্মী হয়ে ওঠে।
∙ মির্জার ভন্ডামি, যিনি অবৈধ লাজোর সাথে তাঁর বিয়ে বাতিল করেন, কিন্তু পরে আবার তার সাথেই ফষ্টিনষ্টি করতে যান।
∙ তিনজন সপ্রতিভ অভিনেত্রী যাঁদের বলা-করায় আমরাই কখনও কখনও লজ্জা পেলেও তাঁদের কোনও দ্বিধা ছিল না।
‘লাজো’-র আরও শো প্রয়োজন। তিন মাসে দু’টি পারফরমেন্স যথেষ্ট নয়। শুধু নাটকটিকে অভিনেতাদের শরীর-মনে আরও বেশি করে প্রবেশ করাবার জন্যই নয়, তাঁদের নিজেদের খাটুনির প্রতি ন্যায়বিচারের জন্যও বটে। সেই সঙ্গে আমার মতো লোকেদের চোখ-কানের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যেও, যারা নাটক দেখবেন বলে হাপিত্যেশ করে বসে থাকেন। এবং সর্বোপরি, যাতে আরও বেশি সংখ্যক মহিলারা তাঁদের শিকলগুলো খসিয়ে দিতে এবং মনের কথা খুলে বলতে অনুপ্রাণিত হন – মঞ্চেও, জীবনেও।
অনুবাদ: অর্ণব বাঁড়ুজ্জি/ ছবি: দেবাশিস ভক্ত
আরও পড়তে পারেন: ভিন্ন স্বাদের চার নাটক নিয়ে তেপান্তর নাট্যগ্রামে ‘নাটকের মজলিস ২’