মেলাপার্বণ
ঐতিহ্যের হৈমন্তীপর্ব: হাওড়ার ভট্টাচার্যবাড়ির জগদ্ধাত্রীর বাঁ হাতে শঙ্খের জায়গায় থাকে খড়্গ
মহাস্নানে ডাবের জল আবশ্যিক কারণ সেটি দক্ষিণাচারী তান্ত্রিক আচার।

শুভদীপ রায় চৌধুরী
দেখতে দেখতে জগদ্ধাত্রীপুজোও এসে গেল। সারা বছরের ক্লান্তি ভুলে উৎসবের দিনগুলিতে মানুষ সংসারের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসে একটু আনন্দ উপভোগ করার জন্য। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখার ভিড় উপচে পড়ে পরে। একটি বার সবাই চায় মায়ের সেই জ্যোতির্ময়ী বিগ্রহকে সামনে থেকে দেখতে। হাওড়া শহরেও বেশ কিছু বনেদিবাড়ি রয়েছে যেখানে বহু কাল ধরে জগদ্ধাত্রীপুজো হয়ে আসছে।
কথা হচ্ছিল হাওড়ার ভট্টাচার্যবাড়ির সদস্য স্বয়ম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাঁদের বাড়ির পুজো এ বার ২৫৫ বছরে পদার্পণ করল। এই পরিবারের ঐতিহ্য এবং বনেদিয়ানা যেন পলকে পলকে অনুভব করা যায় ঠাকুরদালানে দাঁড়ালেই।
কথিত আছে জগদ্ধাত্রী হলেন উমা হৈমবতী দুর্গা। তিনি আদি, তিনি অনন্ত, আর তিনি মহামায়ার সাত্ত্বিক রূপ। মহামায়ার রাজসিক গুণের প্রকাশ যদি হন দুর্গা, তা হলে সাত্ত্বিক রূপ এই জগদ্ধাত্রী। সাধকের মন যখন স্থির হয়, চঞ্চলতা কেটে গিয়ে মন আত্মভিমূখে গিয়ে দেবীর চরণে নিমগ্ন হয়, তখনই শ্রীশ্রীজগদ্ধাত্রী কৃপা করেন। তিনি ধারণী শক্তি। তিনি এ জগত ধরে আছেন, না ধরলে এ জগত পড়ে যাবে কালের অনন্ত কালে।
১৭৬৫ সালের কার্তিক মাসের শুক্লানবমীতে ত্রিপুরাসুন্দরী জগদ্ধাত্রী দেবীর আরাধনা শুরু হয় আন্দুলের বিখ্যাত ভট্টাচার্য বংশীয় গোপীমোহন ভট্টাচার্যের হাত ধরে বর্তমান হাওড়া শহরের মল্লিকফটকের বাড়িতে। গোপীমোহন সেই বছরেই তাঁর বংশের প্রাচীন কূলদেবী শ্রীশ্রীশঙ্করীদুর্গা (কালীযন্ত্রের আধারে) এবং পারিবারিক দুর্গাপূজা নিয়ে আসেন তাঁদের আন্দুলের বসতবাটী থেকে। গোপীমোহনের পিতা আন্দুলের বিখ্যাত তন্ত্রসাধক ভৈরবীচরণ বিদ্যাসাগর তাঁর বসতগৃহে দুর্গাপূজা করতেন এবং তাঁর ইষ্টদেবী শঙ্করীকালীর সেবার্চনা করতেন।

তাঁর শেষ বয়সে তিনি তাঁর সম্পত্তি দুই পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দেন। বড়ো পুত্র জগমোহন বাচস্পতিকে শঙ্করীকালীর সেবা আর ছোটো পুত্র গোপীমোহনকে শঙ্করীদুর্গার সেবার দায়িত্ব দেন। গোপীমোহন দুর্গাসেবার দায়িত্ব নিয়ে হাওড়ার মল্লিকফটকে তাঁদের দ্বিতীয় গৃহে আসেন এবং ঠাকুরদালান নির্মাণ করে পারিবারিক প্রাচীন দুর্গাপূজা চালিয়ে যান। কিন্তু শাস্ত্রমতে দুর্গাপূজার শেষে আরেক শক্তিপূজা করা আবশ্যক। কিন্তু কালীসাধক বংশীয় হয়েও গোপীমোহন কালীপূজা করলেন না কারণ তাঁদের বংশীয় প্রতিষ্ঠিত শঙ্করীকালী অবস্থান করছেন আন্দুলে তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দিরে (মন্দির স্থাপনকাল ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দ), যা আজকের আন্দুলে দেবী সিদ্ধেশ্বরী শঙ্করীকালী মন্দির হিসাবে বিখ্যাত। কালীপূজার পরিবর্তে গোপীমোহন পিতৃ-আদেশ মেনে শ্রীশ্রীজগত্তারিণী জগদ্ধাত্রী দুর্গাপূজা শুরু করেন। সেই পূজাই তাঁর পুত্র রামনারায়ণ হতে সাত পুরুষ ধরে মল্লিকফটকের বাড়িতে হয়ে আসছে।
রামনারায়ণ পুত্র উমাচরণ তৎপুত্র বরদাচরণের এক মেয়ে অভয়াবালা দেবী। অভয়াবালা দেবী বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন রমেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পিতার অকাল প্রয়াণের পর দুর্গা এবং জগদ্ধাত্রীপূজার গুরু দায়িত্ব পড়ে অভয়াবালার উপরে। ওঁর চার পুত্র এবং তাঁদের পরিবার সেই দায়িত্ব পালন করে আসছে। অভয়াবালা দেবীর সেজো পুত্র ভুপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার ১৯৮৪ সাল থেকে জগদ্ধাত্রীপূজার মূল দায়িত্ব পালন করছেন।
জগদ্ধাত্রীপূজার আচার শুদ্ধ তান্ত্রিক আচার। এই বাড়িতে শুক্লানবমীতেই সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর পূজা হয়। মহাস্নানে ডাবের জল আবশ্যিক কারণ সেটি দক্ষিণাচারী তান্ত্রিক আচার। দেবীর বাঁ হাতে শঙ্খের জায়গায় থাকে খড়্গ। আগে পাঁঠাবলি হলেও ১৯৮৪ থেকে প্রাচীন হাঁড়িকাঠে চালকুমড়ো, বাতাবিলেবু এবং আখবলি হয়। নবমীপূজায় বলিদান এবং অষ্টমীতে ২৮টি দীপ দান হয়। মাকে মাছভোগ দেওয়া হয়ে থাকে এবং ‘নবান্ন’ নৈবেদ্য নিবেদিত হয়। ‘নবান্ন’-য় জোড়া কড়াইশুঁটি, চাল আর নতুন নলেনগুড় হল আবশ্যিক।
সময় বদলেছে তার সঙ্গে বদলেছে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। খালি বদলায়নি মাতৃআবেগে ভরপুর হাওড়া তথা বাংলার এই প্রাচীন জগদ্ধাত্রীপুজো।
খবরঅনলাইনে আরও পড়ুন
ঐতিহ্যের হৈমন্তীপর্ব: সাবর্ণদের আটচালায় জগদ্ধাত্রী পুজো হচ্ছে ১৯৬৬ থেকে
কলকাতা
আলো ঝলমলে পার্ক স্ট্রিটে সন্ধের পর জনসুমদ্র, বড়োদিনে মাতল কলকাতা
মোটামুটি সবার মুখেই মাস্ক রয়েছে। কিন্তু জনসমুদ্রে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা আর সোনার পাথরবাটি বানানো, একই ব্যাপার।

খবরঅনলাইন ডেস্ক: ‘অল রোডস লিড টু রোম’-এর মতোই শুক্রবার সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে মনে হচ্ছিল, এ দিন কলকাতাবাসীর একটাই মন্ত্র ‘অল রোডস লিড টু পার্ক স্ট্রিট’। বড়োদিনের কলকাতা যেন ভেঙে পড়েছে পার্ক স্ট্রিটে। দেখে মনেই হচ্ছিল না করোনাভাইরাস নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা আছে কলকাতাবাসীর।
বছরের শেষে যেমন আসে বড়োদিন, তেমনই বলা যায় উৎসবের মরশুমের শেষে আসে বড়োদিন। করোনা-আবহ সত্ত্বেও এ বার এই বড়োদিন উৎসবে মেতে উঠল কলকাতা। কলকাতাবাসী চুটিয়ে আনন্দ করলেন বড়োদিনে।
করোনা পরিস্থিতির জন্য এ বছর দুর্গাপুজো, কালীপুজো, ছটপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজোয় আদালত ও রাজ্য সরকারের নানা নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু বড়োদিনের উৎসবে সে রকম নিয়মবিধি পালনের কোনো নির্দেশিকা ছিল না। সেই সুযোগে মানুষ মেতে উঠলেন উৎসবে।
শুধু শুক্রবার সন্ধ্যাতেই নয়, শহরের গির্জায় গির্জায় মধ্যরাতের প্রার্থনার পর এ দিন কলকাতা বড়োদিন উৎসবে মেতে উঠল সকাল থেকেই। বেশির ভাগ বাঙালি-বাড়িতেই প্রাতরাশে ছিল কেক। তার পর যতটা সম্ভব বেরিয়ে পড়া।

অনেকেই নিজস্ব গাড়িতে বা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়েছেন কলকাতার আশেপাশে। সারাটা দিন আনন্দ করে ফিরেছেন রাতের দিকে। আর অনেকে ভিড় জমিয়েছেন কলকাতার দর্শনীয় স্থানগুলোয়। সকাল থেকেই লোক সমাগম হয়েছিল আলিপুর চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, জাদুঘর, সায়েন্স সিটি প্রভৃতি স্থানে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বার এ সব জায়গায় ভিড় অনেকটাই কম ছিল।
কলকাতাবাসীর কাছে বড়োদিনের অন্যতম গন্তব্য হল সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রাল। বৃহস্পতিবার মধ্যেরাতে প্রার্থনা হয়েছে গির্জায়। শুক্রবার সকালে বহু দর্শনার্থী ওই গির্জায় যান। সস্ত্রীক রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ও শহরের এই গির্জায় গিয়ে যিশুর প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন। তবে অন্য বারের মতো এ বার সারা দিন খোলা ছিল না মহানগরের এই ঐতিহ্যবাহী গির্জা। সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রালের সামনে লেখা রয়েছে করোনা অতিমারির বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। দুপুর ২টোর পর দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় গির্জা।
এখন উৎসবের একটা বড়ো অঙ্গ হল সেলফি তোলা। সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রাল চার্চ হোক বা ভিক্টোরিয়া হোক কিংবা চিড়িয়াখানা হোক বা খোলা ময়দান – সব জায়গায় এ দিন বয়ে গিয়েছে সেলফির ঝড়।
অনেকেই ভিক্টোরিয়ার সামনে থেকে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ময়দানকে ঘুরে নিয়েছেন এক চক্কর। শুক্রবার বড়োদিনের উৎসবে ঘোড়ার গাড়ির সওয়ারি হতে দেখা গেল কচিকাঁচাদের।
আর সন্ধের পর থেকেই কলকাতার পার্ক স্ট্রিট যেন আলোর বন্যায় ভাসছে, আর সেই সঙ্গে জনসমুদ্র আর গাড়ির মেলা। অ্যালেন পার্কে চলছে বড়োদিনের অনুষ্ঠান। কোনো রকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে অঢেল পুলিশি বন্দোবস্ত। কলকাতা পুলিশের অবিরাম ঘোষণা চলছে মাইকে – কলকাতাবাসীকে বড়োদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি চলছে করোনা নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আবেদন। আর্জি জানানো হচ্ছে মাস্ক পরার এবং শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে চলার। মোটামুটি সবার মুখেই মাস্ক রয়েছে। কিন্তু জনসমুদ্রে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা আর সোনার পাথরবাটি বানানো, একই ব্যাপার।
এ বার বো ব্যারাকে উৎসব নেই। তাই পার্ক স্ট্রিট যেন আরও বেশি করে টেনেছে কলকাতাকে।
আরও পড়ুন: নমুনা পরীক্ষা বাড়লেও আগের দিনের থেকে দৈনিক আক্রান্ত কমল রাজ্যে
দঃ ২৪ পরগনা
এ বারেও সাড়ম্বরে পূজা সাবর্ণদের মা চণ্ডীর, তবে বড়িশার মেলা হচ্ছে না
সন্তোষ রায় চৌধুরীর বংশধর মহেশচন্দ্র রায় চৌধুরী ১৭৯২ সালে নিজের বসতবাড়িতে শ্রীশ্রীচণ্ডীর আরাধনা শুরু করেন।

শুভদীপ রায় চৌধুরী
আজ ৬ পৌষ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথি। ভোরেই শুরু হয়ে গিয়েছে বড়িশায় সাবর্ণদের চণ্ডীপুজো।
সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের ঐতিহ্য এবং পরম্পরা বহু দিনের। কলকাতা-সহ সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের তৎকালীন সমাজপতি ছিলেন তাঁরা, তাঁদের জমিদারিও ছিল বিশাল অঞ্চল জুড়ে। এই বংশেরই প্রতিষ্ঠিত বহু মন্দিরও রয়েছে, যেমন কালীঘাট, করুণাময়ী, ময়দা কালীবাড়ি, বড়িশার অন্নপূর্ণামন্দির ইত্যাদি। সাবর্ণদের প্রতিষ্ঠিত চণ্ডীপুজোও আজ সর্বজনবন্দিত। সেই পুজোর ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিবারের গৌরবকে আরও তরান্বিত করে।
বলা বাহুল্য সাবর্ণদের মতন প্রভাব এবং প্রতিপত্তি খুব কম জমিদার পরিবারের ছিল। সে জন্যই শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, “এঁরা দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ চৌধুরী। এঁদের প্রতাপে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। এঁরা লোকের জাত দিতে নিতে পারতেন….”।
কবে শুরু হল চণ্ডীর আরাধনা
গৌড়ের রাজা আদিশূর কাহ্নকুব্জ বা কনৌজ থেকে যে পাঁচ ব্রাহ্মণকে এই বঙ্গে নিয়ে আসেন তাঁদের একজন হলেন বেদগর্ভ। সেই বেদগর্ভের অধস্তন পঁচিশতম পুরুষ কেশবরাম রায় চৌধুরী জমিদারি দেখাশোনার সুবিধার জন্য ১৭১৬ সালে দমদম থেকে বড়িশায় চলে আসেন। কেশবরামের চতুর্থ পুত্র ছিলেন সন্তোষ রায় চৌধুরী, যিনি কালীঘাট মন্দির তৈরি করেছিলেন। সেই সন্তোষ রায় চৌধুরীর বংশধর মহেশচন্দ্র রায় চৌধুরী ১৭৯২ সালে নিজের বসতবাড়িতে শ্রীশ্রীচণ্ডীর আরাধনা শুরু করেন। সাবর্ণদের প্রতিষ্ঠিত এই চণ্ডীপুজো কলকাতা-সহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আজ এক মহোৎসবে পরিণত হয়েছে।

সন্তোষ রায় চৌধুরী নিজ বসতবাড়ি সংলগ্ন পুকুরে স্নান করতে গিয়ে পেয়েছিলেন একটি অষ্টধাতুর কলশি। তিনি সেই কলশিটি বসতবাড়ির উঠোনে রেখে দিয়েছিলেন। তিন দিন বাদে তিনি দেবীকে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নাদেশ পেলেন অষ্টধাতুর কলশিতে এবং বছরে একটি বার মৃন্ময়ী বিগ্রহ এনে পুজো করার আদেশও পেয়েছিলেন তিনি।
পরের দিন সন্তোষবাবু ভাটপাড়ার পণ্ডিতদের কাছে গিয়ে তাঁদের সব কথা বললেন। তাঁরা বিধান দিলেন, ইনি দেবী চণ্ডী। পূজার সমস্ত নিয়মবিধি জেনে তিনি দুর্গাপঞ্চমীতে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে দুর্গাপুজোর পঞ্চমীর দিন চণ্ডীবাড়িতে মায়ের বার্ষিক জন্মতিথি পালন করা হয়। মহেশচন্দ্র রায় চৌধুরীর পুত্র হরিশচন্দ্র রায় চৌধুরী বার্ষিক পূজার জন্য মন্দির তৈরি করে দেন বসতবাড়ি সংলগ্ন জমিতেই।
অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতে পুজো
প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির শেষে দেবগণের উত্তরায়ণ পরিক্রমা শুরু হয়। সুপ্তা দেবীকে জাগ্রত করার পক্ষে এই সময়টি বিশেষ উপযুক্ত। সে কারণে অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতে শ্রীশ্রীচণ্ডীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় বড়িশায়।
ভট্টপল্লির পণ্ডিতগণের সহায়তায় শ্রীচণ্ডীদেবীর মূর্তিটি সম্পূর্ণ ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী গঠিত হয়। তিনি নরমুণ্ডমালা বিভূষিতা, ত্রিনয়না, রক্তবসনা, তাঁর চারটি হাতে পুস্তক, রুদ্রাক্ষমালা, বরমুদ্রা এবং অভয়মুদ্রা। দেবী বন্ধুক পুষ্পবর্ণা এবং পঞ্চ অসুরের মুণ্ডের আসনে অধিষ্ঠিতা। প্রতি বছর ধুমধাম করে দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

এই বিগ্রহ তৈরির আগে শিল্পীরা চণ্ডীপুকুরে স্নান করে বিগ্রহের একটি কাঠ নিয়ে সাবর্ণদের প্রতিষ্ঠিত মঙ্গলচণ্ডীর কাছে পুজো দিয়ে আসেন। সেই কাঠটি পুজোর আগে অবধি চণ্ডীবাড়িতেই পুজো হয়। অষ্টমীর দিন ভোরবেলা পরিবারের সদস্য সেই কাঠটি নিয়ে গিয়ে মন্দিরে মূল বিগ্রহের সঙ্গে বেঁধে দিলে তবেই শুরু হয় পুজো।
এ ছাড়া অষ্টমীর দিন সাবর্ণদের বাড়ি থেকে মন্দিরে ভোগ নিয়ে যাওয়ারও বিধান রয়েছে। পুজোর দিন মাকে রাজবেশে সাজানো হয়। নানা অলংকারে সেজে তিনি জ্যোতির্ময়ী রূপে বিরাজ করেন মন্দিরে।
এ বছর করোনা ভাইরাসের কারণে সমস্ত বিধিনিষেধ মেনেই পুজো হবে বলে জানা গিয়েছে। প্রতি বছর এই পুজোকে কেন্দ্র করে বিরাট মেলার আয়োজন করা হয়। সেই মেলাও এ বার হবে না বলেই সূত্রের খবর। তবে নিষ্ঠার সঙ্গে আজও পুজো হয়ে আসছে বড়িশায়।
আরও পড়ুন: ঐতিহ্যের হৈমন্তীপর্ব: সাবর্ণদের আটচালায় জগদ্ধাত্রী পুজো হচ্ছে ১৯৬৬ থেকে
কলকাতা
করোনা আবহে বিধিনিষেধ মেনে রাসযাত্রা উৎসব পালিত হচ্ছে শোভাবাজার রাজবাড়িতে
শ্রীগোপীনাথ জিউ এবং শ্রীমতী রাধারানিকে ঘিরে রয়েছেন সখীগণ এবং নানা রকমের ফুল দিয়ে রাসমঞ্চ সাজানো – এ যেন এক ঐতিহ্যের নিদর্শন রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে।

শুভদীপ রায় চৌধুরী
দুর্গাপুজো থেকে শুরু হয়েছে বাঙালির উৎসবের আমেজ, রাসযাত্রা তার অন্তিমপর্ব। শান্তিপুর এবং নবদ্বীপের রাস যেমন বিখ্যাত ঠিক তেমনই কলকাতার বিভিন্ন বনেদিবাড়িতে সাড়ম্বরে পালিত হয় রাস উৎসব। এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে লোকসমাগম না হলেও নিয়মনিষ্ঠা মেনেই পালিত হচ্ছে রাসযাত্রা। উত্তর কলকাতার শোভাবাজারের ছোটোরাজবাড়িতে শ্রীশ্রীগোপীনাথ জিউ-এর রাস উৎসব পালিত হচ্ছে ঠাকুরদালানে।
শ্রীগোপীনাথ জিউ এবং শ্রীমতী রাধারানিকে ঘিরে রয়েছেন সখীগণ এবং নানা রকমের ফুল দিয়ে রাসমঞ্চ সাজানো – এ যেন এক ঐতিহ্যের নিদর্শন রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে।

তবে শোভাবাজার রাজবাড়ির শ্রীগোপীনাথ কিন্তু অগ্রদ্বীপের। কী ভাবে তিনি রাজবাড়িতে এলেন? কেন এলেন? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে তৎকালীন কলকাতার স্বনামধন্য পুরুষ মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের কথা। ইতিহাসের সেই সব কাহিনি যেন আজও কথা বলে শোভাবাজার রাজবাড়িতে গোপীনাথকে দর্শন করলে।
অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের আদি বিগ্রহ বর্তমানে কলকাতার শোভাবাজারের রাজপরিবারে অবস্থান করছেন। প্রসঙ্গত ১৭৬৬ সালে রাজা নবকৃষ্ণ দেব তাঁর বাড়িতে গোবিন্দজি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর কিছু দিন পরেই তিনি শ্রীশ্রীগোপীনাথকে প্রতিষ্ঠা করলেন রাজা রাজকৃষ্ণ দেবের বসতবাড়িতে।
১৭৬২ সালে দিল্লির দরবার থেকে নবকৃষ্ণ দেব ‘মহারাজা বাহাদুর’ খেতাব এবং সেই সঙ্গে ‘হাজারি মনসবদারি’ পদ লাভ করেন। সেই সময় রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের ঠাকুরদের নিয়ে একটি সন্মেলন তথা মহোৎসবের আয়োজন করেন। সেই সম্মেলনে বিখ্যাত সমস্ত দেববিগ্রহকে আনা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে খড়দহের শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর, বল্লভপুরের রাধাবল্লভ, সাইবনের নন্দদুলাল, বিষ্ণুপুরের মদনমোহন এবং অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ অন্যতম। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে কাতারে কাতারে মানুষ যোগ দিয়েছিল সেই মহোৎসবে। জনশ্রুতি, সে দিনের সেই বিরাট সভা থেকে অঞ্চলের নাম হয় সভাবাজার এবং পরবর্তীকালে লোকমুখে হয়ে যায় শোভাবাজার। অন্য মতে শোভারাম বসাকের নাম থেকেই শোভাবাজার নামের উৎপত্তি।
বহুদিন ধরে উৎসব চলার পর সব দেবতারা ফিরে গেলেন, ফিরিয়ে দেওয়া হল তাঁদের গহনা ও জমিজমা। কিন্তু মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব অগ্রদ্বীপের গোপীনাথকে কিছুতেই ফেরত দিলেন না। অগ্রদ্বীপের মালিক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দূতকে তিনি জানালেন যে তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন, গোপীনাথ তাঁর হাতের পুজো নিতে চান। তাঁর কাছে কৃষ্ণচন্দ্রের তিন লক্ষ টাকার যে ঋণ রয়েছে তা তিনি মুকুব করে দেবেন একটি শর্তে। শর্তটি হল গোপীনাথ তাঁর কাছেই থাকবেন। কৃষ্ণচন্দ্র এই শর্ত না মেনে আদালতে মামলা করলেন। যদিও সেই সময়ে ইংরেজ মহলে নবকৃষ্ণের প্রতিপত্তি ছিল তবুও তিনি হেরে গেলেন মামলায়। তবুও আদালতের কাছে কিছু সময় চেয়ে নিলেন এবং সেই আবেদনও মঞ্জুর হল।
ইতিমধ্যে তিনি দক্ষ শিল্পী দিয়ে তৈরি করালেন অবিকল আরও কয়েকটি বিগ্রহ। কৃষ্ণচন্দ্রের দূত বিগ্রহ নিতে এসে ধাঁধায় পড়ে যান – দুটি বিগ্রহই তো এক রকম। শেষে কৃষ্ণচন্দ্রের পুরোহিত একটি বিগ্রহ নিয়ে যান। সেই থেকে একটি মূর্তি রয়েছে নদিয়ায় এবং আর একটি শোভাবাজারের রাজবাটীতে। এখন আসল বিগ্রহ কোনটি তা নিয়ে বিস্তর তর্ক থাকলেও অনুমান করা হয় নবকৃষ্ণ দেব যে হেতু যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান ছিলেন, তাই তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে আসলটিই রেখে দিয়েছিলেন।

রাজবাড়ির সেই প্রাচীন যুগলমূর্তির নয়নাভিরাম রূপ, গঠনে প্রাচীনত্বের ছাপ। তার পর ১৭৮৯ সালে নবকৃষ্ণ দক্ষিণ দিকে রাজা রাজকৃষ্ণের জন্য ঠাকুরদালান-সহ বিশাল বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে গোপীনাথকে প্রতিষ্ঠা করেন। আর রাজা রাজকৃষ্ণও বিষয়সম্পত্তি ছেড়ে গোপীনাথকেই বেছে নেন। তিনি গোপীনাথকে পুত্র রূপে দেখতেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে দোতলা থেকে নেমে গোপীনাথের বাড়িতে গিয়ে চোখ খুলতেন, তার পর তাঁকে কোলে নিয়ে বসতেন। আজও রাজবাড়িতে গোপীনাথ জিউের নিত্যসেবা হয়। জন্মাষ্টমীর উৎসব, দোল উৎসব বিভিন্ন উৎসব পালিত হয় শ্রীগোপীনাথকে কেন্দ্র করে।
সেই শ্রীগোপীনাথের রাসযাত্রা পালিত হচ্ছে, রাজবেশে সেজে উঠেছেন তিনি। রাজবাড়িতে তিন দিন ধরে রাস উৎসব পালিত হয়। ঠাকুরদালান আলো করে সখীগণকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীমতীর সঙ্গে অবস্থান করছেন তিনি। রাস উৎসব উপলক্ষ্যে গোপীনাথের বিশেষ সেবা হচ্ছে, চলছে ভোগ নিবেদন, আরতি ইত্যাদি। ভোগে থাকছে লুচি, তরকারি, নানা রকমের মিষ্টান্ন ইত্যাদি। বিকালবেলায় গোপীনাথ নিজের কক্ষ থেকে এসে রাসমঞ্চে আসছেন। তার পর সেখানে মূল পূজার শেষে রাত্রে নিজ কক্ষে ফিরে যাচ্ছেন। উৎসবের আমেজে রাজবাড়ির প্রতিটি সদস্যই মেতে উঠেছেন তাঁদের গোপীনাথকে নিয়ে। রাসমঞ্চে শ্রীরাসেশ্বর রূপে বসে আছেন তিনি। করোনার জন্য নানা বিধিনিষেধ থাকলেও নিয়ম নিষ্ঠায় কোনো খামতি নেই।
খবরঅনলাইনে আরও পড়ুন
শান্তিপুরে পালিত হচ্ছে রাস উৎসব, অন্যতম আকর্ষণ রাইরাজা
-
রাজ্য1 day ago
পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করল তৃণমূল
-
গাড়ি ও বাইক2 days ago
আরটিও অফিসে আর যেতে হবে না! চালু হল আধার ভিত্তিক যোগাযোগহীন পরিষেবা
-
ভ্রমণের খবর3 days ago
ব্যাপক ক্ষতির মুখে পর্যটন, রাঢ়বঙ্গে ভোট পেছোনোর আর্জি নিয়ে কমিশনের দ্বারস্থ পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন
-
রাজ্য1 day ago
বিধান পরিষদ গঠন করে প্রবীণদের স্থান দেওয়া হবে, প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে বললেন মমতা