পাপিয়া মিত্র
এক দিনের মধ্যে তিনটে রথ তৈরি করে দিয়েছিলেন টেকনোক্র্যাট বিশ্বকর্মা। ভাবতে অবাক লাগে, কিন্তু এটা সত্যি। আর সত্যি এই যে তিনিই ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। শ্রীজগ্ননাথের রথ গরুড়ধ্বজ চিহ্নিত। সুভদ্রার রথে পদ্মধ্বজ স্থাপন করা। নির্মল দর্পণধারী বলভদ্রের রথ তালধ্বজ নামে পরিচিত। প্রতিটি রথ সুগঠিত। ধ্বজগুলি সুশোভিত। রথ যত এগিয়ে যায়, গভীর মেঘের ডমরু বাজে।
রথ নিয়ে বাঙালির উৎসাহের শেষ নেই। আসলে রথ একটা চর্চা। রথ-সন্ধ্যায় জগন্নাথ-যাত্রার ভেঁপু পৌঁছে যায় সেই দিগন্তরেখায়, যেখানে কাশফুলের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ঢাকি আর ছোট্ট ছেলেটির হাতের কাঁসরটিকে। আর সেই সুরেই ছড়িয়ে যায় শারদকালীন আগমনী বার্তা। রথের দিনেই কাঠামোর গায় মাটি পড়ে কিনা। তাই রথের বাঁশির আড়ালেই বাজে আগমনী সুর। তালপাতার ভেঁপু। তালপাতা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওঠে সুতলির বাঁধন নিয়ে। আবার কোথাও বা তিড়িং তিড়িং তালপাতার সেপাই। তবে অনুষঙ্গ হিসেবে পাঁপড়ের ‘চরিত্র’ও অনস্বীকার্য। আর এঁদের সঙ্গে দুলতে দুলতে চলতে থাকেন জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রা। প্রকৃতির হিসেবে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রথ আসে। রঙিন লাঠি, তালপাতার সেপাই আর গোলাপি কাগজের মোড়ক দেওয়া বাঁশি বদলে দিতে পারে রথের দিনের চলমান দৃশ্য।
শিলাইদহে বসে রবীন্দ্রনাথও অনুভব করেছিলেন – বসেছে আজ রথের তলায়/স্নানযাত্রার মেলা/সকাল থেকে বাদল হল/ফুরিয়ে এল বেলা।/আজকে দিনের মেলামেশা/যত খুশি যত নেশা/সবার চেয়ে আনন্দময়/ওই মেয়েটির হাসি/এক পয়সায় কিনেছে ও/তালপাতার এক বাঁশি।

রথ মানেই চোখের সামনে এসে পড়ে দাদু-ঠাকুমা-মায়েদের পুরীর রথের গল্পকথা। লোকারণ্য পথে চলেছে তিনটে রথ –- প্রায় আকাশ-ছোঁয়া। সেই চর্চাতে ফিরে যাই। প্রতি বছর নতুন রথ তৈরি করা হয় পুরীতে। নিয়ম মেনে বসন্তপঞ্চমীতে অর্থাৎ সরস্বতী পুজোর দিনে কাঠ সংগ্রহ করা শুরু হয়। সেই সব কাঠের নানা নাম, যেমন গগভারি, আকাশি, ফাঁসি, আসন, ধৌরা ইত্যাদি দিয়ে তিন দেবতার রথ তৈরি করা হয়। বৈশাখ মাসে অক্ষয়তৃতীয়ার দিন রথ নির্মাণ করা শুরু হয়। শেষ হয় আষাঢ়ের শুক্লাদ্বিতীয়ার আগে। রথ তৈরির জন্য শ্রীজগন্নাথের কাছে অনুমতি নিতে হয়। সেই জন্য তিন জন পাণ্ডা তিনটে আজ্ঞামাল্য বহন করে নিয়ে আসেন। ‘রথ নির্মাণের কাজ শুরু হোক’ — আজ্ঞামাল্যর মাধ্যমে এই নির্দেশ এসে পৌঁছয় পুজোর স্থলে। তিন দেবতার নামে তিনটি রথ — শ্রীজগন্নাথের ‘নন্দীঘোষ’, মা সুভদ্রার রথের নাম ‘দেবদোলন’, শ্রীবলরামের ‘তালধ্বজ’। অনেকে আবার শ্রীবলরামের রথকে ‘হলধ্বজ’ও বলেন।
শ্রীজগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ। রথের রক্ষক গড়ুর। লাল ও হলুদ কাপড়ে আচ্ছাদিত রথ ষোড়শচক্রযুক্ত। চন্দ্রের ষোলো কলা রথের চাকায় সংখ্যাতত্ত্বে মিশে আছে। মা বিমলা ও মা বিরজা নন্দীঘোষের শক্তি। হনুমান, রাম, লক্ষ্মণ, নারায়ণ, কৃষ্ণ, গোবর্ধন, চিন্তামণি, রাঘব ও নৃসিংহ — এই ন’ জন পার্শ্বদেবতা দিয়ে সাজানো হয় রথ। চারটি সাদা ঘোড়া রথে জোড়া থাকে। ঘোড়াগুলির নাম শঙ্খ, বলাহ, শ্বেত ও হরিদাক্ষ। সারথির নাম মাতলি। রথের রশির নাম শঙ্খচূড়। দুই দ্বারপাল, জয় ও বিজয়, মতান্তরে ব্রহ্মা ও ইন্দ্র। রথের অধিষ্ঠিতা দেবী যোগমায়া। পতাকার নাম ত্রৈলোক্যমহিনী। এই পতাকায় হনুমান বিরাজ করেন। উচ্চতা ৩৩ হাত ৫ আঙুল।

মা সুভদ্রার রথের নাম ‘দেবদোলন’ বা ‘দর্পদোলন’। দ্বাদশ চক্রবিশিষ্ট এই রথ লাল ও কালো কাপড়ে আবৃত থাকে। চাকাগুলি বছরের বারো মাস নির্দেশ করে। পদ্মকাঠে তৈরি পদ্মধ্বজ চিহ্ন থাকে সুভদ্রার রথে। এই রথের রক্ষক জয়দুর্গা বা বনদুর্গা। সারথি অর্জুন। রথের দেবতা ভক্তিসুমেধা। রথের দেবী হলেন ‘ভূ’ ও ‘শ্রী’। রোচিকা, মোচিতা, জিতা ও অপরাজিতা নামের চারটি ঘোড়া রথে লাগানো থাকে। যে দড়ি দিয়ে সহস্র ভক্ত রথ টেনে নিয়ে যায় তার নাম স্বর্ণচূড়। শীর্ষে ওড়া পতাকার নাম ‘নাদম্বিকা’। রথের অধিশ্বরী মা সুভদ্রা। যে পার্শ্বদেবী দ্বারা রথ সজ্জিত থাকে তাঁরা হলেন সুমেধা, চামরহস্তা, বিমলা, চামুণ্ডা, ভদ্রকালী, হরচন্দ্রিকা, মঙ্গলা, বারাহী, কাত্যায়নী, জয়দুর্গা ও কালী। অন্য মতে, চণ্ডী, মঙ্গলা, বারাহী, চামুণ্ডা, উগ্রতারা, বনদুর্গা, শুলিদুর্গা, শ্যামাকালী ও বিমলা। এই রথের উচ্চতা ৩১ হাত। দেবদোলনের ধ্বজার পাশে থাকে দুই পাখি — শ্রুতি ও স্মৃতি।
রক্তলাল ও সবুজ কাপড়ে মোড়া রথের শীর্ষে অনন্তনাথের অবস্থান শ্রীবলরামের রথে। নাম তালধ্বজ। অনেকে হলধ্বজও বলেন। চতুর্দশ চক্রযুক্ত এই রথে সপ্তচ্ছদময় লাঙলধ্বজ চিহ্নিত। চোদ্দোটি চাকা সপ্তস্বর্গ ও সপ্তলোকের প্রতীক। উচ্চতা ৩২ হাত ও ১০ আঙুল। তীব্র, ঘোর, দীর্ঘশ্রব, স্বর্ণানাভ নামক চারটি কালো ঘোড়া রথটিকে টানছে। মতান্তরে ঘোড়াগুলির নাম স্থিরা, ধৃতি, স্থিতি ও সিদ্ধা। রুদ্র ও সাত্যকি মতান্তরে নন্দ ও সুনন্দ তালধ্বজের দুই দ্বারপাল। ব্রহ্মা ও শিব থাকেন এই রথে। পতাকার নাম উচ্ছমি। রথরজ্জুর নাম বাসুকি। হরিহর, লাটম্বর, গজস্তক, প্রলম্বারি, ত্রিপুরারি, রুদ্র, গণেশ, স্কন্ধ হলেন পার্শ্বদেবতা। ভাস্কর বা শেষাবতার হলেন রক্ষক। দারক মতান্তরে সুদ্যুম্ন হলেন রথের সারথি। রথের অধীশ্বর শ্রীবলরাম।

রথ প্রতিষ্ঠার কিছু নিয়ম আছে। রথের ঈশান কোণে নির্মল গৃহ তৈরি করা হয়। সেই গৃহের মধ্যে বেদি ও মণ্ডল থাকে। বেদি চারচৌকো, ৪ হাত চওড়া ও ১ হাত উঁচু। রথ প্রতিষ্ঠার আগের দিন শেষ রাতে শুভ মুহূর্তে দেবতাদের পুজো করতে হয়। ওই বেদির মধ্যে ‘সর্বতোমণ্ডল’ বা পদ্ম তৈরি করে দিব্য তণ্ডুল স্থাপন করা হয়। পূর্ণ কুম্ভ প্রতিষ্ঠার জন্য কুম্ভে পুণ্যতীর্থের জল ঢালা হয়। পঞ্চপল্লব, সপ্তমৃত্তিকা, নানা গন্ধদ্রব্য, পঞ্চরত্ন, নানা ওষধিতে কুম্ভ পূর্ণ থাকে। শ্রীবিষ্ণুকে স্মরণ করে পঞ্চগব্যে পূর্ণ করে কুম্ভের গলায় বস্ত্র বেঁধে ফুল-ফল-গন্ধমালা দিয়ে মঙ্গলাচারে নরসিংহদেবের পুজো করতে হয়। কুম্ভের বায়ুকোণে হোম অনুষ্ঠিত হলে পতাকা, বস্ত্র, মালা কুম্ভের জলে পবিত্র করে রথে সাজানো হয়। গন্ধচন্দন জলে রথ শুদ্ধ করা হয়। একে একে শ্রী নৃসিংহদেব, গুরুড়দেব, শ্রীবিষ্ণুর পুজো হয়। পুরুষসূক্ত মন্ত্রে শ্রীজগন্নাথ, দ্বাদশাক্ষর মন্ত্রে বলভদ্র ও লক্ষ্মীসূক্ত মন্ত্রে সুভদ্রার রথ প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
রথ নানা রঙে সেজে উঠলে রথে দেবতাদের স্থাপন করা হয়। গায়াত্রীমন্ত্র, বিষ্ণুসূক্ত মন্ত্র উচ্চারণে, জগন্নাথের জয়ধ্বনিতে, মঙ্গলবাদ্যের মূর্ছনায় রথ প্রাণ পায়। রথের রশিতে টান পড়লেই ধীরে ধীরে গুন্ডিচাবাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
জগন্নাথ একটি রূপ। তিনিই আবার একের মধ্যে বহু। তিনি যখন রত্ন সিংহাসনে আসীন তখন নারায়ণ। নবকলেবরের সময় রুদ্র, স্নানযাত্রায় গণেশ। রথযাত্রায় সূর্যদেবতার প্রধান প্রতিনিধি। শয়নোৎসবের সময়ে দুর্গা রূপ তাঁর। হিন্দুদের পঞ্চদেবতার পুজো জগন্নাথেই হয়।
ছবি: প্রতিবেদক
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।