পাপিয়া মিত্র
অবিশ্রাম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভক্তের দল চলেছে উল্টো পথে। কাঁধে বাঁক, পরনে নতুন জামাকাপড়, মুখে ব্যোম ব্যোম তারক ব্যোম /বোলে ব্যোম তারক ব্যোম। জয় বাবা বড়কাছারির জয়। উল্টো পথ এই কারণে, এ পথ তারকেশ্বরের নয়। এ পথ বড়কাছারির, দক্ষিণ ২৪পরগনার ঠাকুরপুকুর থেকে প্রায় এগারো কিলোমিটার দূরে।
কথায় বলে ভক্তের টানে ভগবান জাগ্রত হন। লোকমুখে ছড়িয়ে গিয়েছে বাবার থানের কথা। নানা মানুষের নানা সমস্যা। কেউ আসেন সন্তানের কামনায়, কেউ বা চাকরির জন্য, কেউ আবার বাড়ির সমস্যায়। কেউ কেউ জর্জরিত সাংসারিক সমস্যায়। বহু দূর থেকে নিজস্ব গাড়ি, ট্রেকার, ভ্যান রিকশায়, অটোতে দলে দলে ভক্ত আসেন ভোর থেকে। এখানে পুজো দেওয়ার কোনও ঝামেলা নেই। নিজের পুজো নিজে দিতে হয়। কোনও পাণ্ডা-পুরোহিতের দৌরাত্ম্য নেই। মনের কামনা জানিয়ে ছোটো চিঠি বা দরখাস্ত লিখে লাল সুতো দিয়ে বেঁধে দিতে হয়। সাদা বাতাসা ও ফুল-বেলপাতা সহ ত্রিশূলে জল দিতে হয়।
এখানের দেবতা তারক ব্রহ্ম অর্থাৎ মহাদেব। প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার মেলা বসে। ভিড়ের আধিক্য থাকলেও সপ্তাহের বাকি দিনও ভোর থেকে মানুষ আসতে থাকে। ত্রিবেণী থেকে আসা ললিতাদেবী বললেন, “বেশ কয়েক জনের কাছে বাবার মাহাত্ম্যের কথা শুনেছিলাম। আমার ছোটো মেয়ের কিছুতেই বিয়ে হচ্ছিল না। এখানে এসে দরখাস্ত লিখে গিয়েছিলাম। আজ এসেছি পুজো দিতে।” দুই যুবতী বেদীর চার দিক ঘুরে ঘুরে পুজো সেরে টাঙানো দরখাস্ত থেকে একটি ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করায় জানালেন, ফল হয়েছে, তাই।
শ্রাবণের সকাল, মনের ভার সরিয়ে রেখে ইলশেগুঁড়ি মাথায় নিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। সকলের সঙ্গে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। সার দিয়ে দোকান। কোথাও লুচি ভাজার গন্ধ তো কোথাও জিলিপি পড়ছে কড়াইতে। চায়ের দোকানে বেশ ভিড়। এগিয়ে যেতে দেখা গেল সত্যবানকে নিয়ে সাবিত্রী বসে আছেন দুধপুকুরের পাড়ে। এখান থেকে ভক্তরা জল নিয়ে বেদীতে ওঠার আগে তিন বার প্রদক্ষিণ করে গাছের কোলে যে ত্রিশূল আছে তাতে মালা দেন ও জল ঢালেন। এখানের দেবতা গাছ।
শীলপাড়া থেকে প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে অচিন্ত্য অধিকারী যান বাবাকে ভোগ দিতে। তাঁর বাবা ফটিক অধিকারী গিয়েছেন ৪২বছর ধরে। আজ বাবার অবর্তমানে ছেলে তা পালন করে চলেছেন। আগে সোমবার যেতেন, এখন শ্রাবণ মাসে প্রবল ভিড়ের জন্য সোম, মঙ্গল, শনিবার বাদ দিয়ে যে কোনও দিনে ভোগ দেন। এক সময় এখানে ছিল মাটির ঢিবি। ঢিবির উপরে এক অশ্বত্থ গাছ। বিগ্রহহীন এই বেদীর গাছই এখনও দেবতা। কল্পতরু এই বৃক্ষ বড়কাছারির বিশেষত্ব। আগে কেউ কেউ ভূতের কাছারিও বলতেন। শোনা যায় অতীতে এই স্থানটি ছিল শ্মশান। গ্রামবাসীরা শবদাহ করত এখানে। আর স্বয়ং ভূতনাথ ভুত, প্রেত, ভৈরব, কিন্নর নিয়ে বসাতেন তাঁর কাছারি।
১৭৪০-এর বাংলায় নবাবি করছেন আলিবর্দি খান। ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে সারা বাংলা জুড়ে তখন বর্গিহানা। গ্রামবাসীরা আশ্রয় নিলেন বনেজঙ্গলে। কথিত আছে, এক সাধু এই জঙ্গল অতিক্রম করার সময় এই শ্মশানে আশ্রয় নেন। গ্রামবাসীরা তাঁকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করত। সে দিন চৈত্র মাস। নীল উৎসবের গাজনের মেলা। হঠাৎ গ্রামবাসীরা লক্ষ করলেন বেদীর উপরে উপবিষ্ট সাধুর দেহ স্থবির। সকলে চিৎকার করলেন, স্পর্শ করলেন, বুঝলেন তিনি আর নেই। ওই শ্মশানেই সমাধিস্থ করলেন সাধুবাবাকে। কিছু দিন বাদে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। ওই সমাধির ওপরে জন্ম নিল এক অশ্বত্থ গাছ। গ্রামবাসীদের স্বপ্ন দিয়ে জানান দেন, ওই গাছ কল্পতরু। তিনি এখানে আছেন ও থাকবেন। তিনি শিবশম্ভু স্বয়ং ব্রহ্ম তারকনাথ। আরও বলেন, ”আমি প্রতি দিন গভীর রাতে এখানে কাছারি বসাই। তোরা এক মনে ডাক। আমার কাছারিতে তোরা সুবিচার পাবি।” লোকমুখে শোনা যায় বাওয়ালির মণ্ডল-জমিদারদের এক গোমস্তা গভীর রাতে ভূতের কাছারির এই দৃশ্যটি দেখেন। তাই আজও প্রতি মঙ্গল ও শনিবারে ঢাকঢোল সহকারে মহাদেবের পুজ হয়। বাংলা ১৩৪২, কৃষ্ণা রজনী রাত দ্বিতীয় প্রহর বাবা স্বপ্নে জানালেন, পুরোনো কলেবর ত্যাগের কথা। জন্ম হল নতুন এক অশ্বত্থ গাছের। বাঁধিয়ে দেওয়া হল বেদি। এর মধ্যে বিবাদ বাধল উত্তরাধিকার নিয়ে। জেলার শাসন- কর্তৃপক্ষ সরেজমিনে তদন্তে পাঠালেন তৎকালীন এক ইংরেজ মহকুমা শাসককে। ভূতের কাছারিতে তিনি বসালেন তাঁর অস্থায়ী কাছারি। উত্তরাধিকার সুত্রে পেলেন অধ্যাপক বিভূতিভূষণ কাঁঠাল মহাশয়কে।
এর পরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সাসারামের জনৈক হিন্দুস্থানি ভক্ত। ঘাটের মন্দির নির্মাণ করালেন বিষ্ণুপুর নিবাসী সেবক কমলকৃষ্ণ বেরা। প্রচারিত হল বাবা বড়কাছারির নামমাহাত্ম্য।
ছবি: অরুণ লোধ
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।
বড়কাছারির তথ্য জেনে খুব ভাল লাগল , খুদেদের ঈদ বেশ লাগল।ধন্যবাদ পাপিয়া অজানা তথ্য জানাবার জন্য।